বিদেশ যাওয়ার খরচ মেটাতে লাগে এক বছরের মজুরি

জাকারিয়া পলাশ: দক্ষিণ এশিয়ার শ্রমিকরা সবচেয়ে কম মজুরি পান মধ্যপ্রাচ্য ও মালয়েশিয়াসহ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে। তার ওপর কর্মীদের অভিবাসন ব্যয় অস্বাভাবিক। ফলে একদিকে স্বল্প মজুরি, অন্যদিকে অভিবাসন ব্যয়ের উচ্চহার এসব শ্রমিকের ভাগ্যোন্নয়নে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বাংলাদেশের কর্মীরা। বাংলাদেশ থেকে একজন শ্রমিকের দুবাই বা কুয়েত যেতে যে ব্যয় হয়, তা আয় করতে ৯ মাস থেকে এক বছরও লেগে যাচ্ছে।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সম্প্রতি প্রকাশিত ‘এশিয়ার উন্নয়নে অভিবাসন ও রেমিট্যান্স’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এ-সংক্রান্ত তথ্য দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়, অভিবাসী প্রেরক দেশগুলো অভিবাসন ব্যয় কমানোর পক্ষে সব সময়ই কথা বলে আসছে। তাদের নানা রকম উদ্যোগও রয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এসব ব্যয় কমছে না। বিশেষ করে কম দক্ষতাসম্পন্ন শ্রমিকদের ক্ষেত্রে এ সমস্যা হচ্ছে সবচেয়ে বেশি।
তথ্যমতে, এশিয়ার মধ্যে সৌদি আরব, কুয়েত, আরব আমিরাত ও মালয়েশিয়ায় অভিবাসন ব্যয় সর্বাধিক। দেখা গেছে, একজন বাংলাদেশি শ্রমিকের কুয়েত যেতে যে ব্যয় হয়, তা সেখানে যাওয়ার পর তার ৯ মাসের আয়ের সমান। সে সঙ্গে একজন শ্রমিক বিদেশে যেতে যেহেতু ব্যাংক থেকে ঋণ পান না, সেহেতু তাকে অপ্রাতিষ্ঠানিক সূত্র থেকে অর্থ ঋণ নিতে হয়। এজন্য সুদ বা অন্যান্য লভ্যাংশ দেওয়া প্রয়োজন হয়। ফলে তার ব্যয় আরও বেড়ে যায়। সব মিলিয়ে দেখা যায় প্রায় এক বছরের আয় চলে যায় শুধু বিদেশ যাওয়ার ব্যয় নির্বাহ করতে। বাংলাদেশ ছাড়া পার্শ্ববর্তী অন্যান্য দেশের মধ্যে পাকিস্তানের শ্রমিকদের অভিবাসন ব্যয় দেখা গেছে অপেক্ষাকৃত বেশি। সৌদি আরবে একজন পাকিস্তানি শ্রমিকের অভিবাসন ব্যয় তার ১১ মাসের আয়ের সমান বলে তথ্য পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশ থেকে সর্বাধিক মাত্রার অভিবাসন ব্যয়ের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান সচিব ড. নমিতা হালদারও। জানতে চাইলে তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের ন্যূনতম অভিবাসন ব্যয় বেঁধে দেওয়া আছে। কিন্তু এজেন্সিগুলো তা মানছে না। এজেন্সির লোকেরা বলে দালালরা দাম বাড়াচ্ছে। কিন্তু ওই দালালরাও এজেন্সির সঙ্গে সম্পৃক্ত। তারা মিলেমিশে যৌথভাবেই একটি চক্র তৈরি করেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি নিজে দেখেছি, তারা আরব দেশগুলোতে ভিসা ট্রেডিং করে। পাকিস্তান যে দামে ভিসা নেয়, আমাদের দেশের দালালরা প্রতিযোগিতা করে তার চেয়ে বেশি দামে ভিসা কেনে। পরে সেটার ভুক্তভেুাগী হয় শ্রমিকরা। এক লাখ ৮০ হাজার টাকা ন্যূনতম ব্যয় বেঁধে দেওয়া থাকলেও তারা ছয়-সাত লাখ টাকা নিচ্ছে। আবার এ নিয়ে কোনো শ্রমিক অভিযোগ করতে চায় না। জেলা প্রশাসকের দফতরে আমাদের ডেস্ক আছে। কিন্তু সেখানেও কেউ অভিযোগ করেন না। দালাল ও এজেন্সির লোকেরা শ্রমিকদের নানাভাবে বুঝিয়ে ফেলে। সব মিলিয়ে আমরা দেখছি, সচেতনতার বড় অভাব রয়েছে।’
জানা গেছে, অভিবাসন ব্যয় কমাতে দেশগুলোর বিভিন্ন উদ্যোগ রয়েছে। এজন্য অনেকেই বেসরকারি জনশক্তি রফতানিকারক কোম্পানিগুলোর ওপর লাগাম টানার ব্যবস্থা নিয়েছে। ভারতীয় শ্রমিকের ৪৫ দিনের মজুরির চেয়ে বেশি অর্থ অভিবাসন সেবার জন্য ফি হিসেবে নেওয়া যাবে না। আবার শ্রীলঙ্কায় সব এজেন্টকে নিয়ন্ত্রণের জন্য নিজস্ব ব্যবস্থা রয়েছে। ভিয়েতনামের কোম্পানিগুলোর সমিতি থেকেই এ বিষয়ে নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। পাকিস্তানে এ বিষয়ে একটি শ্রমবাজার তথ্যকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। এসব উদ্যোগ নেওয়া সত্ত্বেও বাস্তবে অভিবাসন ব্যয় কমানো সম্ভব হচ্ছে না।
রিক্রুটিং এজেন্ট ও দালালদের দৌরাত্ম্যের পাশাপাশি অভিবাসী শ্রমিকদের সচেতনতার অভাবকে এর কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এদিকে যেসব দেশের শ্রমিক প্রযুক্তি ও দক্ষতার দিক থেকে পিছিয়ে, তারাই এ ক্ষেত্রে বেশি ভুক্তভোগী হচ্ছেন বলে প্রতিবেদনে বলা হয়। কেননা, অদক্ষ ও আধা-দক্ষ শ্রমিকদের মজুরি কম হয়ে থাকে। ফলে তাদের মজুরি দিয়ে অভিবাসন ব্যয় মেটাতে দীর্ঘদিন লেগে যায়।
এদিকে গন্তব্য দেশগুলোতে শ্রম অধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টিও প্রতিবেদনে উঠে আসে। এতে বলা হয়, শ্রমিকদের সঙ্গে চুক্তি না করেই অনেককে কাজে নিযুক্ত করা হয়। পরে দেখা যায় তাদের মজুরি ও নিরাপত্তার বিষয়ে নানাভাবে ঠকানো হয়। এ অবস্থা উন্নয়নে এডিবির প্রতিবেদনে দেশগুলোর প্রতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি, শ্রমবাজার-সংক্রান্ত তথ্যভাণ্ডার উন্নয়ন, তথ্যের স্বচ্ছতা নিরূপণ, শ্রমিক অধিকারের আইনি কাঠামো তৈরি ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কোন্নয়নের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

 

 

 

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০