Print Date & Time : 26 June 2025 Thursday 3:05 pm

অগ্রগতির সঠিক তথ্য নেই পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজের!

ইসমাইল আলী: পদ্মা সেতুর মূল অবকাঠামো নির্মাণে চুক্তি সই হয় ২০১৪ সালের জুনে। চলতি বছর নভেম্বরে এ কাজ শেষ করার কথা ছিল। যদিও নির্মাণকাজ শেষ করতে অতিরিক্ত ৩১ মাস সময় চেয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি। তবে জুন পর্যন্ত সেতুটির কাজ কতটুকু সম্পন্ন হয়েছে তার সঠিক কোনো তথ্য নেই। নির্মাণকাজের অগ্রগতি নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য উঠে এসেছে সেতু বিভাগ ও ঠিকাদারের প্রতিবেদনে।
তথ্যমতে, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত মূল সেতু নির্মাণকাজের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯২ দশমিক ৪৬ শতাংশ। সেতু বিভাগ বলছে জুন পর্যন্ত ৬৫ শতাংশ নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে। তবে ঠিকাদারের তথ্যের ভিত্তিতে ব্যবস্থাপনা পরামর্শক বলছে, জুন পর্যন্ত মূল সেতুর অগ্রগতি ৬০ দশমিক ২৭ শতাংশ। যদিও এ অগ্রগতি আর্থিক ভিত্তিতে হিসাব করা। বাস্তব তথা ভৌত অগ্রগতি কতটুকু হয়েছে তা নিশ্চিত নয়। ফলে বর্তমানে এ কাজ কতটুকু পিছিয়ে রয়েছে তা নির্ধারণ করা যাচ্ছে না। একই অবস্থা নদী শাসন প্যাকেজেরও।
প্রকল্পটির নদী শাসন প্যাকেজের চুক্তি সই হয় ২০১৪ সালের নভেম্বরে। চলতি বছর ডিসেম্বরে এ কাজ শেষ করার কথা ছিল। আর জুন পর্যন্ত নদী শাসনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৮০ দশমিক ৮৪ শতাংশ। তবে সেতু বিভাগ বলছে, উল্লিখিত সময় পর্যন্ত কাজ হয়েছে ৪১ দশমিক ৩৮ শতাংশ। আর ঠিকাদারের তথ্যের ভিত্তিতে ব্যবস্থাপনা পরামর্শক বলছে, জুন পর্যন্ত নদী শাসনের অগ্রগতি ৩৮ দশমিক শূন্য পাঁচ শতাংশ।
নদী শাসন শেষ করতে অতিরিক্ত ১৮ মাস সময় চেয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চীনের সিনোহাইড্রো করপোরেশন। তবে কবে নাগাদ এ কাজ শেষ হবে তা পুরোই অনিশ্চিত বলে মনে করছে পদ্মা সেতুর ব্যবস্থাপনা পরামর্শক রেন্ডাল অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস। সম্প্রতি বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেওয়া প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
এতে বলা হয়, জুনে মূল সেতুর কাজ হয়েছে মাত্র দশমিক ৯৪ শতাংশ। যদিও ওই মাসে লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক দশমিক ৭৩ শতাংশ। আর জুনে নদী শাসনের কাজ হয়েছে দশমিক ৯৫ শতাংশ। যদিও ওই মাসে লক্ষ্যমাত্রা ছিল দুই দশমিক ৯২ শতাংশ।
এদিকে মূল সেতুর নির্মাণকাজ শেষ করার জন্য অতিরিক্ত ৩১ মাস সময় চেয়ে গত ১ মে কর্মপরিকল্পনা জমা দেয় চায়না মেজর ব্রিজ। এক্ষেত্রে ২০২১ সালের জুনে নির্মাণকাজ শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। তবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে সেতু বিভাগ বর্ধিত এ সময় দিতে রাজি হয়নি। এক্ষেত্রে পরবর্তী ১২ মাস কাজ পর্যবেক্ষণ করে বর্ধিত সময় নির্ধারণের কথা জানায় সেতু বিভাগ।
জানতে চাইলে পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম শেয়ার বিজকে বলেন, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে সেতুটি যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়ার কথা ছিল। এজন্য মাসভিত্তিক অগ্রগতির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। যদিও বাস্তবে তার চেয়ে নির্মাণকাজ কিছুটা পিছিয়ে রয়েছে। ঠিকাদাররা বাড়তি সময় চেয়েছে। তবে তাদের বাড়তি সময় প্রদান করা হয়নি। সব দিক বিবেচনা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে ২০১৮ সালের শেষ দিকে সেতুটি উদ্বোধনের লক্ষ্য ধরা হয়েছিল। তবে নির্মাণকাজের ধীরগতির কারণে এখন সে লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। বরং ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে অর্ধেক সেতুও দৃশ্যমান হবে কি না সন্দেহ রয়েছে। মূলত নকশা জটিলতায় এ কাজ পিছিয়ে গেছে। আর নদী শাসনে সিনোহাইড্রো শুরু থেকেই ছিল অনেক শ্লথ। ফলে এটি দ্রুত এগিয়ে নিতে চীনে প্রতিষ্ঠানটির মূল অফিসে যোগাযোগের সুপারিশ করেছে ব্যবস্থাপনা পরামর্শক রেন্ডাল অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস।
সেতু বিভাগের তথ্যমতে, মূল অবকাঠামোর জন্য নদীতে ৪০টি পিলারের জন্য ২৪০টি পাইল নির্মাণের ছিল। তবে ২২টি পিলারের পাইলের তলদেশে কাদার স্তর ধরা পড়ায় সেগুলোর নকশায় পরিবর্তন আসে। এতে একটি করে পাইলের সংখ্যা বাড়ানো হয়। এতে ৪০ পিলারের জন্য পাইলের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৬২টি। এর মধ্যে ১৫০টির নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। আর পিলার নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে ১০টি। এর মধ্যে জাজিরা প্রান্তে ছয়টি পিলারের ওপর পাঁচটি স্প্যান বসানো হয়েছে। আরও ১০টি স্প্যান নির্মাণ করা হচ্ছে।
এদিকে মূল সেতুর জন্য মাওয়া ও জাজিরায় শেষ প্রান্তের দুই পিলারে ১৬টি করে ৩২টি পাইল করতে হবে। এর মধ্যে ২২টি সম্পন্ন হয়েছে। আর জাজিরা ভায়াডাক্টে (উড়ালপথ) পিলার হবে ৪০টি ও মাওয়া ভায়াডাক্টে ৩৭টি। এজন্য যথাক্রমে ১৯৩টি ও ১৭২টি পাইল করতে হবে। এর মধ্যে জাজিরা ভায়াডাক্টের মাত্র চারটি পাইল সম্পন্ন হয়েছে। সার্বিকভাবে সেতুর নির্মাণকাজের অগ্রগতি ৫৫ দশমিক ৬৩ শতাংশ।
উল্লেখ্য, প্রকল্পটির আওতায় মূল সেতু নির্মাণের চুক্তি মূল্য ধরা হয়েছে ১২ হাজার ১৩৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। নদী শাসনের চুক্তি মূল্য আট হাজার ৭০৭ কোটি ৮১ লাখ টাকা। জুন পর্যন্ত দুই প্যাকেজের আওতায় ব্যয় হয়েছে যথাক্রমে ছয় হাজার ৯০৭ কোটি ৮১ লাখ ও তিন হাজার ৪০৫ কোটি ৭১ লাখ টাকা। আর কয়েক দফা বৃদ্ধির পর পুরো প্রকল্পটি বাস্তবায়নে বর্তমানে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। তবে বাস্তবায়ন বিলম্বে সেতুটির নির্মাণ ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা।