অচিরেই পুঁজিবাজারে আসছে বৃহত্তম লুব্রিক্যান্টস ব্র্যান্ড ‘বিএনও’

দেশের প্রথম লুব্রিকেটিং গ্রিজ উৎপাদক ও রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানের জনক মোহাম্মদ ইউসুফ। তার কর্মদক্ষতা, যোগ্যতা ও চার দশকের অক্লান্ত পরিশ্রমে নির্মিত লুব ব্ল্যান্ডিং প্লান্ট (এলবিপি) লুব-রেফ (বাংলাদেশ) লিমিটেডের উৎপাদিত লুব্রিকেটিং সামগ্রী বাজারজাত করা হচ্ছে ‘বিএনও’ ব্র্যান্ডে। সাফল্যের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে পুঁজিবাজার থেকে ১৫০ কোটি টাকা মূলধন উত্তোলন করতে চায় বেসরকারি খাতের দেশের প্রথম লুব্রিক্যান্ট ব্ল্যান্ডিং কোম্পানি লুব-রেফ (বাংলাদেশ) লিমিটেড। সম্প্রতি নিজ কার্যালয়ে কোম্পানির ইতিহাস, বর্তমান কার্যক্রম, ব্যবসায়িক সম্ভাবনা ও পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেন শেয়ার বিজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাইফুল আলম

অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আজ আপনি একজন সফল উদ্যোক্তা। উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার শুরুর গল্পটা কেমন ছিল?

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৪ (১৯৭২ ব্যাচ) সালে অর্থনীতি বিষয়ে মাস্টার্স শেষ করি। এ সময় ড. মুহাম্মদ ইউনূস স্যারসহ অন্যান্য শিক্ষক আমাদের চাকরি না খুঁজে উদ্যোক্তা হওয়ার অনুপ্রেরণা জোগাতেন। আর পরামর্শ দিতেন কোনো কাজে লেগে যাওয়ার। কারণ তখন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের শিল্প-কারখানাগুলো জাতীয়করণের ফলে ব্যক্তি-উদ্যোগে ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ ছিল না; কর্মসংস্থানের সুযোগ ছিল সীমিত, অবকাঠামো এত উন্নত ছিল না। সরকারি চাকরির সুযোগ ছিল সামান্য। তখন আমি আর আমার বন্ধু প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক ভাবতাম মধ্যপ্রাচ্যে চলে যাই। কিন্তু প্রতিনিয়ত উদ্যোক্তা হওয়ার ভাবনা মাথায় ঘুরপাক খেত। এরই  মধ্যে নিউ এরা স্টিল মিলসের জিএম রফিকুল আলম চৌধুরীর সঙ্গে পরিচয়। তিনি তার প্রতিষ্ঠানে গ্রিজ সরবরাহের সুযোগ করে দেন। সদরঘাটের দেশি-বিদেশি লুব্রিক্যান্টস বিক্রয়  প্রতিষ্ঠান প্যারাগন অয়েল থেকে প্রতি ড্রাম গ্রিজ আট হাজার টাকায় কিনে তা আট হাজার ২০০ টাকায় নিউ এরা ও বিএসআরএমে সরবরাহ করতে থাকি। এতে খরচ বাদ দিয়ে লাভ হয় ১৫০ টাকা। সেই থেকে আমার স্বপ্নও বড় হতে থাকে। ১৯৭৬ সালে উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে যৌথভাবে একটি কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ প্রতিষ্ঠা করি। সেই থেকে লুব্রিকেন্টসের ব্যবসায় যুক্ত হই এবং গ্রিজ ও লুব্রিক্যান্টস সম্পর্কে প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে থাকি। ১৯৮০ সালে তৎকালীন শিল্প ব্যাংকের এমডি কামাল উদ্দিন ও জিএম সৈয়দ আশরাফুল হকের প্রেরণায় একটি ঋণ প্রস্তাব দাখিল করি। যা পরবর্তীকালে ব্যাংকের এমডি যথাক্রমে মহীউদ্দীন আলমগীর ও তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর আনুকূল্যে গ্রিজ হাউজ লিমিটেডের একটি ঋণ প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড এ প্রকল্পের মূলধন জোগাত। এরপর জার্মানির সর্ববৃহৎ তেল কোম্পানি ফুক্স পেট্রোলুব এ’জির সঙ্গে যৌথ মালিকানায় তৎকালীন বিদ্যুত সচিব  তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী ও সাবেক মন্ত্রী মেজর জেনারেল (অব.) নূরউদ্দিন খানের সহায়তায় সর্ববৃহৎ লুব ব্ল্যান্ডিং প্লান্ট ফুক্স-জিএইচএল লুব্রিক্যান্টস (বাংলাদেশ) লিমিটেড গঠন করি। এখনও সময় ও সুযোগ পেলেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আমি লুব্রিক্যান্টস, পেট্রোকেমিক্যাল সম্পর্কিত কর্মশালায় অংশগ্রহণ করে থাকি, যা বর্তমান অবস্থানে উপনীত হতে সাহায্য করেছে।

লুব-রেফের বর্তমান কার্যক্রম নিয়ে কিছু বলুন…

লুব-রেফ (বাংলাদেশ) লিমিটেড বর্তমানে দেশের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য লুব্রিক্যান্টস প্রস্তুতকারক ও বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে এরই মধ্যে ভোক্তাদের আস্থা অর্জন করেছে। বর্তমানে বার্ষিক ১২ হাজার ৫৫০ টন সক্ষমতার ব্ল্যান্ডিং প্লান্ট দেশের মোট চাহিদার পাঁচ শতাংশ পূরণ করছে।  যা ২০১৯ সালে ২০ শতাংশে উন্নীত করার আশা রাখি। অন্যদিকে ১০ হাজার মেট্রিক টন ক্ষমতাসম্পন্ন রি-রিফাইনিং ইউনিটের ৯১ দশমিক ৮৫ শতাংশ সক্ষমতাই ব্যবহƒত হচ্ছে। যা ২০১৫ সালে ছিল ৬৫ দশমিক ৬৭ শতাংশ। আর ৩০ জুন, ২০১৭ সমাপ্ত হিসাববছরে লুব-রেফের বিক্রি ছিল ১১৮ কোটি ৬৭ লাখ টাকা ও কর-পরবর্তী মুনাফা ১৫ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরে ৯০ কোটি ১৬ লাখ টাকা বিক্রির বিপরীতে তাদের মুনাফা ছিল ৯ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। এখন আমরা মোট ৩৫ ধরনের লুব্রিক্যান্টস সামগ্রী তৈরি করছি। এসব পণ্যের সর্বোচ্চ মান বজায় রাখার জন্য আমাদের আছে অত্যাধুনিক অ্যাক্রিডিয়েটেড ল্যাবরেটরি। এ ল্যাবরেটরিতে উন্নত বিশ্বের সেরা কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে ব্যয়বহুল সব যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে। এটি অনেক প্রতিষ্ঠানের টেকনিক্যাল স্বীকৃতি পেয়েছে। নিজেদের পণ্যের সেরা মানটি নিশ্চিতের পাশাপাশি দেশের সবচেয়ে আধুনিক টেস্টিং ল্যাব হিসেবে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকেও আমরা টেস্টিং সেবা দিচ্ছি।

লুব্রিক্যান্টস বাজার সম্ভাবনা সম্পর্কে কিছু বলুন…

ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক গতিশীলতার সঙ্গে বাড়ছে লুব্রিক্যান্টের চাহিদাও। আগামীতে এ চাহিদা আরও কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে। কারণ দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের অংশ হিসেবে সম্প্রসারিত রেলপথ, বিদ্যুৎকেন্দ্র, সড়ক পরিবহন, জাহাজ, উড়োজাহাজ চলাচল, ম্যানুফ্যাকচারিং কারখানা প্রত্যেক ক্ষেত্রে প্রচুর লুব্রিক্যান্ট ব্যবহার হচ্ছে এবং হবে। ক্রমবর্ধমান এ চাহিদার বিপরীতে আমরা আমাদের ব্র্যান্ডটিকে একটি শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য সম্প্রসারণ ও সহায়ক বেশ কিছু প্রকল্প নিয়ে এরই মধ্যে কাজ শুরু করতে যাচ্ছি। ইনশাল্লাহ আমরা সফল হব বলে দৃঢ়ভাবে আশাবাদী।

সম্প্রতি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার জন্য রোড শো করেছেন। পুঁজিবাজারে আসার কারণ…

আমি ব্যবসায় আসি দেশের সেবা করার জন্য, আমদানিনির্ভর পেট্রোকেমিক্যাল ও লুব্রিক্যান্ট ট্রেডিং হতে পেট্রোকেমিক্যাল ও লুব্রিক্যান্ট শিল্পে রূপান্তরের জন্য। এ রূপান্তরে বিনিয়োগকারীদের আমরা সহযাত্রী হিসেবে পেতে চাই। বর্তমানে স্থানীয় লুব্রিক্যান্ট বাজারের প্রায় পাঁচ শতাংশ বিএনও ব্র্যান্ডের দখলে। এ বর্ধিত সক্ষমতা ও বিপণন প্রচেষ্টা সফল হলে এ হার ২৫ শতাংশে উন্নীত করা সম্ভব। এতে আমাদের আয়ও কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে। এ জন্য পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হচ্ছি। আমাদের ব্যাপক সম্প্রসারণ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে বেইজ অয়েল রিফাইনারি, ট্যাংক টার্মিনাল, বার্থ অপারেটিং জেটি, বিটুমিন প্লান্ট, হাইড্রোজেন প্লান্ট ও পাওয়ার প্লান্ট স্থাপনও আছে। আর বছরে ৭০ হাজার টন ক্ষমতাসম্পন্ন বেইজ অয়েল রিফাইনারিটি হয়ে গেলে দেশের লুব্রিক্যান্ট ইন্ডাস্ট্রিতে একটি নতুন মাত্রা যোগ হবে। এতে শিল্পের সুরক্ষা ও প্রযুক্তি হস্তান্তর, মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে অনেক প্রযুক্তিবিদ তৈরি হবেন।

আইপিওর অর্থ ব্যবহার সম্পর্কে…

নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদন পেলে আইপিওর ১৫০ কোটি টাকার মধ্যে ৯৮ কোটি টাকা কোম্পানির সম্প্রসারণ প্রকল্পগুলোয় বিনিয়োগ করা হবে। উচ্চসুদের ঋণ পরিশোধে ব্যয় হবে ৪৬ কোটি টাকা। বাকি ছয় কোটি টাকায় আইপিও প্রক্রিয়াসহ অন্যান্য ব্যয় নির্বাহ করা হবে। তবে সম্প্রসারণের জন্য তাদের কোনো জমি কেনা বা পূর্ত প্রকল্প প্রয়োজন হবে না। আইপিওর অর্থ হাতে পাওয়ার পর যন্ত্রপাতি আমদানির প্রক্রিয়া শুরু করব। এক্ষেত্রে প্রস্তাবিত যন্ত্রপাতির কোটেশন নেওয়া হয়েছে। এক বছরের মধ্যে তা স্থাপন করে সেখানে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করা হবে। ঋণ শোধের জন্য নির্ধারিত অর্থ আইপিওর তহবিল হাতে পাওয়ার পরপরই ব্যবহার করা হবে।

বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে কিছু বলুন…

লুব-রেফ (বাংলাদেশ) লিমিটেড পর্যাপ্ত ইকুইটি বিনিয়োগে স্থাপিত একটি শিল্প প্রকল্প। এটি বিনিয়োগকারীদের জন্য শতভাগ নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান। আমাদের আছে পেট্রোকেমিক্যাল ও লুব্রিক্যান্টস শিল্পে চার দশকের বাস্তব অভিজ্ঞতা। আমরা স্থানীয় প্লান্টে বিশ্বমানের লুব্রিক্যান্ট প্রস্তুত করে ইতোমধ্যে ক্রেতাদের আস্থা অর্জন করেছি। বিএনও বর্তমানে অধিক পরিচিত একটি লুব্রিক্যান্টস ব্র্যান্ড। আর প্রতিযোগিতামূলক দামে দেশে অটোমোটিভ, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ও মেরিন লুব্রিক্যান্টস বিক্রি প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া সম্প্রসারণ প্রক্রিয়া শেষ হলে দেশের সীমানা পেরিয়ে বহির্বিশ্বে রফতানির প্রচেষ্টা এগিয়ে  নেবে লুব-রেফ।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০