অটিজম কোনো প্রতিবন্ধিতা নয়

আশরোফা ইমদাদ: মিশকাত আলম, বয়স ৭ বছর। বাবা মিশাদ আলম ব্যাংকার ও মা মনিরা আলী এক্সিকিউটিভ হিসেবে কর্মরত আছেন। মনিরা- মাতৃত্বের সাধ পূর্ণ হলেও ৭ বছর পরও সে সন্তানের মুখ থেকে ‘মা’ ডাকটি শুনতে পায়নি। মিশকাতের ৪ বছর বয়স হওয়ার পরও যখন ওর মুখে বুলি ফোটেনি, তখন আত্মীয়স্বজনরা ডাক্তারের কাছে নিতে বলেছিল। এই ৪ বছর বয়স পর্যন্ত মিশকাত ওর মা-বাবাকে ইশারায় সবকিছু বোঝানোর চেষ্টা করত। মিশকাতের কথা মা-বাবা বুঝতে না পারলে বা কোনো কিছু ওর মতের বাইরে হলেই মিশকাত অস্বাভাবিকভাবে চিৎকার শুরু করে ও হাত-পা ছুড়তে থাকে। এটা-ওটা ভাংচুর করতে থাকে। আর গোঁ গোঁ শব্দ করতে থাকে। অবশেষে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার পর নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ডাক্তার তাদের অপ্রত্যাশিত উত্তর দেয়, তাদের আদরের সন্তান, নয়নের মণি অটিজমে আক্রান্ত।

‘অটিজম’ অর্থ বহির্বিমুখিতা বা আত্মমগ্নতা রোগ বা অসুস্থ কল্পনা মগ্নতা। অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার (এএসডি) একটি স্নায়ুবিকাশজনিত সমস্যা মস্তিষ্কের বিকাশের সঙ্গে সম্পর্কিত এমন একটি অবস্থাকে বোঝায়, যা কোনো ব্যক্তি কীভাবে অন্যের সঙ্গে উপলব্ধি ও সামাজিকীকরণ করে তার ওপর প্রভাব ফেলে, সামাজিক ও সাধারণ যোগাযোগের ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি করে।

অটিজমের লক্ষণগুলো সাধারণত ১২ মাস থেকে ২৪ মাস বয়সের মধ্যে স্পষ্ট হয়। এসব লক্ষণ আরও আগেও উপস্থিত হতে পারে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটি ১৮ মাসের প্রথম দিকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়। গবেষণা করে দেখা গেছে শিশুকালেই প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা গেলে, পরবর্তী জীবনে ইতিবাচক ফলাফল পাওয়া যায়। দেখা গেছে, অটিজমে আক্রান্ত দেয়া তাদের বুদ্ধি অনেক বেশি। প্রচলিত পড়াশোনার পাশাপাশি এদের কিছু বিশেষ দক্ষতা থাকে। পৃথিবীতে অনেক সফল মানুষই অটিস্টিক হয়েও খ্যাতির শিখরে পৌঁছেছেন অথচ সচেতনতার অভাবে এই নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিসঅর্ডার বুঝতেই পারেন না অর্ধেক অভিভাবক। দেশে ৫৮ জন শিশুর মধ্যে একজন অটিজম নিয়ে জš§ায়। ছেলেরা মেয়েদের চেয়ে চারগুণ বেশি এ রোগে আক্রান্ত হয়। উপসর্গ হিসেবে বলা যায়, অটিজমে আক্রান্ত শিশুরা অতিঘনিষ্ঠ ছাড়া মেলামেশা করে না। বয়সের তুলনায় এরা অনেক দেরিতে কথা বলতে শেখে। চোখে চোখ রেখে কথা বলতে না পারা, একই কথা বা কাজ বারবার বলা বা করা, একঘেয়ে রুটিনে আসক্তি, রগচটা ব্যবহার, যন্ত্রণা ও উত্তাপ গ্রাহ্য না করা, নির্দিষ্ট শব্দ ও গন্ধ সম্পর্কিত অতিসংবেদনশীলতা ইত্যাদি। অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত ক্ষেত্রে কোনো কারণ জানা যায়নি। ধারণা করা হয়, এটি মস্তিষ্কের গঠন বা ফাংশনে অস্বাভাবিকতার জন্য ঘটে। এই ধরনের ব্যাধির জটিলতা, লক্ষণ ও তীব্রতা পরিবর্তনের জন্য সম্ভবত অনেক কারণ রয়েছে।

কিন্তু গবেষণায় বোঝা যায়, অটিজম জিনগত, নন-জেনেটিক বা পরিবেশগত প্রভাবের সংমিশ্রণ থেকে বিকাশ লাভ করে। এছাড়া রয়েছে বেশি বয়সে সন্তান ধারণ করা অর্থাৎ পিতামাতার বয়স বেশি হওয়া একাধিক গর্ভাবস্থা যেমনÑসময়-বাচ্চা গর্ভকাল কম হওয়া (২৬ সপ্তাহের আগে জন্ম নেয়া শিশু) পরিবারের কেউ অটিজমে আক্রান্ত, জেনেটিক ডিজঅর্ডারস, জš§গ্রহণের সময় কম ওজনের শিশু, অ্যালকোহল ও ধূমপান করা, ভিটামিন ডি-এর অভাব ইত্যাদি। একটি শিশু অটিজমে আক্রান্ত কিনা তা শনাক্ত করা যায় কয়েকটি টেস্টের মাধ্যমে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑডেভেলপমেন্ট স্ক্রিনিং, ডিএনএ টেস্ট, অকুপেশনাল থেরাপি স্ক্রিনিং ও দেখা বা শোনার টেস্ট। এ রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ডাক্তাররা সাধারণত একটি বিশেষজ্ঞ দল তৈরি করে যেখানে শিশু মনোবিজ্ঞানী, পেশাগত থেরাপিস্ট এবং ভাষা রোগ বিশেষজ্ঞরা থাকেন।

অটিজমের কোনো নিরাময় নেই। তবে সুচিকিৎসা অটিজমের লক্ষণগুলো হ্রাস করতে পারে। সমস্ত চিকিৎসা প্রয়োগের লক্ষ্য হলোÑঅটিজম আক্রান্ত বাচ্চাদের দুর্বলতা কমানো এবং স্বাবলম্বী হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ানো। গবেষণায় দেখা গেছে, যত দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা হবে, তত শিগগিরই ফলাফল পাওয়া যেতে পারে। অটিজমের চিকিৎসা হিসেবে, আচরণগত ব্যবস্থাপনা থেরাপি, জ্ঞানমূলক আচরণ থেরাপি, যুগ্ম মনোযোগ থেরাপি, পেশাগত থেরাপি, শারীরিক থেরাপি, সামাজিক দক্ষতা প্রশিক্ষণ, কথা ভাষা থেরাপি, পুষ্টিবিধান থেরাপি ও খেলাধুলা থেরাপি উল্লেখযোগ্য। অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের ক্ষেত্রে দেখা যায় কিছু কিছু ব্যায়াম যা বাচ্চারা করতে পছন্দ করে, তা বাচ্চাদের হতাশা দূর করে ও সামগ্রিক সুস্থতার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে খেলার মাঠে হাঁটা ও মজা করা দুটোই করা যেতে পারে।

অটিস্টিক শিশুদের শিক্ষাব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য বাংলাদেশের সরকার ৪২২২.৩৪ কোটি টাকা ব্যয়ে অটিজমের জন্য একটি একাডেমি তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে, যা অটিজম ও নিউরো উন্নয়ন প্রতিবন্ধী জাতীয় একাডেমির আওতায় ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

স্ব-কর্মসংস্থানের অটিজম আক্রান্ত শিশুদের স্কলারশিপ, বিভিন্ন প্রশিক্ষণ, আবাসিক সুবিধা ও আইসিটি সুবিধা প্রদান করা হবে।

‘অটিজম ও নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার বাংলাদেশ’-এর জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারপারসন সায়মা ওয়াজেদ হোসেন পুতুলের নেতৃত্বে জাতীয় স্টিয়ারিং কমিটিকে অগ্রাধিকার, নকশা কর্মসূচি, বাস্তবায়ন কৌশল নির্ধারণ, সংস্থানসমূহের যথাযথ ব্যবহার সম্পর্কে গাইডেন্স প্রদান এবং প্রয়োজনীয় সংস্থান চিহ্নিতকরণে সহায়তা করা। অটিজমের উদীয়মান ও ক্রমবর্ধমান সমস্যা নিরসনে যথাযথ নীতি এবং সামাজিক সচেতনতা কর্মসূচি গ্রহণে বাংলাদেশ প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ বিষয়টি জাতীয় ও বিশ্বব্যাপী এগিয়ে নিতে গভীর আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এরই অংশ হিসেবে ১৬ নভেম্বর ১৯৯৯ তারিখে ‘জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন’ গঠিত হয়; যা বাংলাদেশের সব ধরনের প্রতিবন্ধী নাগরিকের সমমর্যাদা অধিকার পূর্ণ অংশগ্রহণ ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করে। 

এছাড়াও অটিস্টিক শিশুদের জন্য বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে ‘নিউরো ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী কর্নার’ স্থাপন, অটিজম রিসোর্স সেন্টার স্থাপন, ফ্রি স্কুল ফর চিলড্রেন উইথ অটিজম, ভ্রাম্যমাণ ওয়ান স্টপ থেরাপি সার্ভিস, টেলিথেরাপি সার্ভিস প্রবর্তন, ব্রেইল ভাষায় ফাউন্ডেশনের, কার্যক্রম মুদ্রণ, ঋণ ও অনুদান কার্যক্রম জাতীয় প্রতিবন্ধী কমপ্লেক্স, প্রতিবন্ধী ক্রীড়া কমপ্লেক্স, প্রতিবন্ধী উন্নয়ন অধিদপ্তর গঠন করা হয়েছে। অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের সর্বাঙ্গীণ সুরক্ষার লক্ষ্যে ‘প্রতিবন্ধিতা সম্পার্কিত সমন্বিত বিশেষ শিক্ষা নীতিমালা’ প্রণয়ন করেন বাংলাদেশ সরকার। এছাড়াও ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন-২০১৩’ জাতীয় সংসদ কর্তৃক অনুমোদন লাভ করেছে। 

–পিআইডি নিবন্ধ

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০