নাজমুল হুসাইন: গত কয়েক দিনের অবিরাম বর্ষণে বরিশাল জেলার ১০ উপজেলায় শত শত একর জমির বোরো ধান পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এর মধ্যে জেলার বিলাঞ্চলের প্রায় দুই হাজার একরেরও বেশি জমি রয়েছে। একই সঙ্গে জেলার বানারীপাড়া, বাকেরগঞ্জ, হিজলা, মুলাদী, মেহেন্দীগঞ্জ, উজিরপুর, আগৈলঝাড়া, বাবুগঞ্জ ও গৌরনদী উপজেলার নিন্মাঞ্চলের অধিকাংশ জমির ধান এখন পানির নিচে। এতে এসব ইরি-বোরোর পাকা ও আধাপাকা ধান চলমান বর্ষণের সঙ্গে বৈশাখী ঝড়ে পড়ে যাচ্ছে। ফলে দিশাহারা হয়ে পড়েছে কৃষক।
দেশে শুধু হাওরই নয়, টানা বর্ষণে কয়েক দিনে প্লাবিত হয়েছে সারা দেশের নিম্নভূমিসহ বিলাঞ্চল। এখন পর্যন্ত শুধু হাওরে বন্যায় দুই লাখ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে, যেখান থেকে ছয় লাখ মেট্রিক টন চাল পাওয়া যেত। সঙ্গে চলমান পরিস্থিতিতে ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়ছে। এ ভারি বর্ষণে বরিশালের মতো দেশের বিভিন্ন বিলাঞ্চলসহ নি¤œাঞ্চলগুলো প্লাবিত হচ্ছে। দমকা হাওয়ায় পড়ে যাচ্ছে আধাপাকা ধান। ফলে প্রতিদিন ক্ষতির শঙ্কা বাড়ছে, যা আরও কয়েক দিন দীর্ঘায়িত হলে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে কৃষি অর্থনীতিতে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সরেজমিন উইংয়ের অতিরিক্ত পরিচালক (মনিটরিং ও বাস্তবায়ন) কৃষিবিদ আলহাজ উদ্দিন আহাম্মেদ শেয়ার বিজকে বলেন, ‘সারা দেশে বর্ষণ আরও দীর্ঘায়িত হলে ক্ষতির বড় শঙ্কা রয়েছে। এখন কিছু বিলাঞ্চলে ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। তবে বৃষ্টি না হলে সেই পানি নেমে যাবে। আর কিছু বিল এলাকায় আগাম ধান হয়; সেসব কাটা শুরু হয়েছে। কিছু এলাকায় সেসব পানিতে তলিয়ে থাকায় সমস্যা হচ্ছে।’
জানা গেছে, গতকাল সোমবার পর্যন্ত দেশের এক লাখ ৯৮ হাজার ৯২৮ হেক্টর জমি প্লাবিত হয়েছে। এর মধ্যে হাওর এলাকা প্রায় এক লাখ ৪১ হাজার হেক্টর। বাকি প্রায় অর্ধলাখ হেক্টর জমি হাওরের পাশে নি¤œভূমিসহ বিভিন্ন বিলাঞ্চল। সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনার হাওর এলাকা ছাড়াও দেশের বেশ কয়েকটি জেলায় আধা-পাকা ধান প্লাবিত হয়েছে। সেসব এলাকা থেকে সমতল ভূমি প্লাবনের খবর পাওয়া আসছে। তবে সে পরিমাণের সঠিক পরিসংখ্যান এখনও পাওয়া যায়নি।
কয়েক দিন ধরে সারা দেশে আবহাওয়ার যে বিচিত্র আচরণ চলছে, তা কমপক্ষে বুধবার পর্যন্ত চলবে বলে গতকাল আভাস দিয়েছেন আবহাওয়াবিদরা। কয়েক সপ্তাহ থেকে বৃষ্টি হলেও গত শুক্রবার থেকে ঢাকাসহ সারা দেশেই মাঝারি থেকে ভারি বৃষ্টি চলছে অবিরাম। সঙ্গে প্রায় রাতেই চলছে দফায় দফায় কালবৈশাখীর দমকা হাওয়া। গতকালও ঢাকা বিভাগে সকাল ৬টা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত ২১ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করেছে আবহাওয়া অধিদফতর। এছাড়া এ সময় দেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টি হয়েছে পটুয়াখালী ও কুতুবদিয়ায় ৬২ মিলিমিটার।
চলতি বোরো মৌসুমে হাওরের ফসলহানি এখন জাতীয় অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলছে। গতকাল পর্যন্ত শুধু হাওরে এর আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে বলে জানিয়েছে একাধিক সংস্থা। বর্তমানে দেশের প্লাবিত এসব এলাকা দুর্যোগপ্রবণ এলাকা ঘোষণা করে নানা সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। এসব এলাকায় হাওরাঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্ত জরুরি বরাদ্দের বাইরেও পাঁচ লাখ পরিবার খাদ্য সহায়তা পাবে। এখন পর্যন্ত জরুরি ত্রাণ সহায়তা হিসেবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় তিন হাজার ৩২৪ মেট্রিক টন চাল ও নগদ এক কোটি ৯৩ লাখ ৯৭ হাজার টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।
কৃষি অধিদফতর জানায়, চলতি বছর দেশে এক কোটি ৯১ লাখ টন বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। এ মৌসুমে আবাদ সম্পূর্ণ হয়েছিল ৪৭ লাখ ৯৭ হাজার হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে গতকাল পর্যন্ত তলিয়ে গেছে এক লাখ ৯৮ হাজার হেক্টর আবাদি জমি। তাদের হিসাবে হাওরে ধানের ক্ষতি হবে পাঁচ লাখ ৯৬ হাজার ৭৮৪ টন।
হাওরের বাইরে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার কৃষক এনামুল বলেন, ‘শুধু বৃষ্টিতে এ এলাকায় কয়েকশ একর ধানক্ষেত তলিয়ে গেছে। ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকার সীমান্তবর্তী রৌমারী উপজেলার লাঠিয়ালডাঙ্গা কালাপানির বিল, বেকরি বিল, সীমান্ত ঘেঁষা দক্ষিণ আলগারচর, উত্তর আলগারচর, দর্নির বিল, ডিসি সড়কের দুদিকের খাল, জাদুরচর ইউনিয়নের ক্ষেরভাঙ্গি বিল, লালপুরার খালসহ আরও কয়েকটি বিলের ক্ষেত পানিতে তলিয়ে গেছে। এ বিলগুলো বছরে মাত্র তিন মাস শুকনো থাকে। সেখানে বছরে ইরি-বোরো এক মৌসুম ফসল হয়। কিন্তু আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় অতিবৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে ফসল।’
এদিকে আবহাওয়াবিদরা বলছেন, প্রশান্ত মহাসাগরে উপরিভাগের পানির তাপমাত্রার পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তন ‘এল নিনো’ শেষে আরেক চাপ ও ‘লা লিনা’র অবস্থান কাছাকাছি পর্যায়ে চলে এসেছে। ফলে পূবালী প্রবাহ শক্তিশালী হওয়ায় পশ্চিমা লঘুচাপের সঙ্গে মিলিত হয়ে প্রচুর জলীয় বাষ্প সৃষ্টি হচ্ছে। এর ফলে অতিবর্ষণ হচ্ছে।
তবে আগামী দু’দিনের মধ্যে পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার আশা জানিয়ে আবহাওয়া অধিদফতরের আবহাওয়াবিদ আবদুল মান্নান বলেন, এল নিনোর প্রবাহ গত বছর জুন-জুলাইতে শেষ হয়ে গেছে। এখনও এটা কোনোটাই হয়নি, লা নিনার প্রবাহ আসেনি, মাঝামাঝি অবস্থা চলছে। পূবালী ও পশ্চিমা লঘুচাপের মিশেলে মৌসুমের আগেই একটু বেশি বৃষ্টি হচ্ছে। এটা ব্যতিক্রম হলেও অস্বাভাবিক বলা যাবে না। বেশ কিছু বছর পরপর এমন আবহাওয়ার দেখা মেলে। তবে এখন পর্যন্ত যে তথ্য-উপাত্ত দেখছি, তাতে আগামী ২৬ তারিখের পর থেকে আবহাওয়ার উন্নতি হবে বলে মনে করি।