Print Date & Time : 18 June 2025 Wednesday 12:46 am

অতিরিক্ত তারল্য কমে ১ লাখ ৫৩ হাজার কোটিতে

রোহান রাজিব: বৈদেশিক মুদ্রার সংকট ও ব্যাংকগুলোর ঋণ অনিয়মের কারণে এ খাতের ওপর মানুষের আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে ব্যাংকিং খাতের অতিরিক্ত তারল্যের ওপর। গত বছরের নভেম্বর শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতের অতিরিক্ত তারল্য কমে ১ লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। অক্টোবরে অতিরিক্ত তারল্য ছিল ১ লাখ ৬৯ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে অতিরিক্ত তারল্য ১৬ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

খাত-সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ডলারের দাম ও আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বাড়ায় আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির কারণে সরকারি ও বেসরকারি খাতে ঋণের জোগান বেড়েছে। এছাড়া ব্যাংকিং খাতের অতিরিক্ত তারল্য কমেছে মূলত আমদানি অর্থায়নের কারণে। ঋণদাতারা এখন ঋণপত্র (এলসি) নিষ্পত্তির জন্য ডলার কিনতে স্থানীয় মুদ্রা ব্যয় করছে।

অন্যদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের জীবনযাপনের খরচ বেড়ে গেছে। এজন্য অনেকে জমানো টাকা তুলে ব্যয় মেটাচ্ছেন। সাম্প্রতিক সময়ে ঋণ অনিময়ের ফলে ব্যাংকিং খাত থেকে মানুষ ব্যাপক টাকা তুলে নিয়েছে। ফলে ব্যাংকিং খাতে অতিরিক্ত তারল্য কমেছে।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোর হাতে সিআরআর ও এসএলআর রাখার পর গত ২০২২ সালের জানুয়ারিতে অতিরিক্ত তারল্য ছিল ২ লাখ ১১ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা, যা ২০২২ সালের নভেম্বরে কমে দাঁড়ায় ১ লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকায়। অর্থাৎ ১১ মাসে অতিরিক্ত তারল্য কমেছে ৫৮ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের জুলাইয়ে ব্যাংকিং খাতে অতিরিক্ত তারল্য ছিল ১ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। সে হিসাবে পাঁচ মাসে অতিরিক্ত তারল্য কমেছে ৩৬ হাজার কোটি টাকা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার সংকট দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় ব্যাংকগুলো বর্তমানে একটি বড় তারল্য সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে। ব্যাংকিং খাতের অতিরিক্ত তহবিল কমেছে মূলত আমদানি অর্থায়নের কারণে। ঋণদাতারা এখন ঋণপত্র নিষ্পত্তির জন্য মার্কিন ডলার কিনতে স্থানীয় মুদ্রা বেশি ব্যয় করছে। এছাড়া বিভিন্ন ব্যাংকের ঋণ অনিয়মের কারণে মানুষ ব্যাংকের ওপর আস্থাহীনতায় ভুগছে। তাই অনেকে টাকা তুলে অন্য খাতে বিনিয়োগ করছে। পাশাপাশি নিজেদের কাছে টাকা রাখছে।

সূত্র জানায়, ব্যাংকিং খাতে ডলার সংকটের কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো আমদানি ব্যয় ও বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারছিল না। এ কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলারের জোগান দেয়া হয়েছে। চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ৯ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ খাতে প্রায় ৯২ হাজার কোটি টাকা বাজার থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চলে গেছে। তারল্য সংকটের এটিও একটি কারণ। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় কমেছে। বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ কমার কারণেও টাকার প্রবাহ কমেছে। গত অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৭৬২ কোটি ডলার বিক্রি করেছে। এর বিপরীতে ক্রয় করেছে মাত্র ২১ কোটি ডলার।

অন্যদিকে ডলার বিক্রির ফলে রিজার্ভে চাপ তৈরি হয়েছে। গত ২৮ ডিসেম্বর রিজার্ভ কমে ৩৩ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে এসেছে। গত বছরের একই সময় এ রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪৫ দশমিক ৮০ বিলিয়ন। গত বৃহস্পতিবার আন্তঃব্যাংক ডলার লেনদেন হয়েছে সর্বনিন্ম ১০২ টাকা ৭২ পয়সা থেকে সর্বোচ্চ ১০৭ টাকা পর্যন্ত। গত বছরের এপ্রিল থেকে ডলারের দাম বেশি বেড়েছে। গত এপ্রিলের শুরুতে প্রতি ডলারের দাম ছিল ৮৬ টাকা। সে হিসাবে গত নয় মাসে ডলারের দাম বেড়েছে ২১ টাকা।

তারল্য কমার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নিয়মিত ধার করছে ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৮ ডিসেম্বর কয়েকটি ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ১০ হাজার ৩৪ কোটি টাকা ধার নিয়েছে। এর আগে, গত ২৬ ডিসেম্বর ১৩ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকা। এজন্য ব্যাংকগুলোকে সর্বোচ্চ সুদ গুণতে হয়েছে ৫ দশমিক ৮৫ শতাংশ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার নেয়ার পাশাপাশি ব্যাংকগুলোয় স্বল্প সময়ের ঋণ কল মানি রেটের পরিমাণও বেড়েছে। গত ডিসেম্বরজুড়ে কল মানি রেট ছিল ৫ শতাংশের বেশি। গতকাল আন্তঃব্যাংক মানি মার্কেট লেনদেনের চিত্রে দেখা যায়, এদিন ৩ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে, যার রেট ছিল ৫ দশমিক ৭৯ শতাংশ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক শেয়ার বিজকে বলেন, ব্যাংকিং খাতে তারল্য কমার অন্যতম কারণ ডলার সংকট। ব্যাংকগুলোয় ডলার সংকট থাকার কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে প্রচুর ডলার বিক্রি করা হয়েছে। ফলে ব্যাংকগুলোর স্থানীয় মুদ্রা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চলে এসেছে। এতে ব্যাংকগুলোয় অতিরিক্ত তারল্য কমে গেছে।

এসব কারণের বাইরেও ব্যাংকিং খাতে তারল্য কমার সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, ‘ব্যাংকিং খাতে টাকা নেই’। এ ধরনের গুজবের শিকার হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ব্যাংকে টাকা নেই। এমন গুজবের মধ্যেও আমানতের প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। তাই গুজবে কমে না। ডলার সংকটের কারণেই কমেছে।

এর আগে গত নভেম্বরে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাংকের আমানত তুলে নেয়ার জন্য ‘ষড়যন্ত্রমূলক’ খবর প্রচারিত হচ্ছে উল্লেখ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি বিজ্ঞপ্তি দেয়। এতে বলা হয়, বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা অত্যন্ত সুদৃঢ় অবস্থায় আছে। ব্যাংকিং ব্যবস্থায় তারল্যের কোনো সংকট নেই। এতে আরও বলা হয়, কোনো ব্যাংকের তারল্য ব্যবস্থাপনায় কোনো ব্যত্যয় থাকলে বাংলাদেশ ব্যাংক তা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে নিরসন করার ব্যবস্থা নেবে। তারল্য ব্যবস্থাপনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের রেপো ও অ্যাসিউরড লিকুইডিটি সাপোর্ট নীতি সর্বদা চালু আছে উল্লেখ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে।