তাজুল ইসলাম: শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী কোটা সংস্কার আন্দোলন স¥রণকালের অন্যতম আন্দোলনগুলোর মধ্যে স্থান দখল করে নিয়েছে বলে আমার বিশ্বাস। এ দেশের সূচনালগ্ন থেকেই আমাদের তরুণ প্রজš§ সব সময় নৈতিক এবং যৌক্তিক আন্দোলনে ভূমিকা রেখে আসছে। যাদের রক্ত টগবগ টগবগ করে শুধু- বৈষম্য, শোষণ, অন্যায়, অত্যাচার, নিপীড়ন মোকাবিলা করার জন্য। আমাদের আছে বীরত্বের ইতিহাস, আছে গৌরবের ইতিহাস, যে ইতিহাসে ছাত্রছাত্রীরা বীরত্বের প্রথম ও প্রধান অংশীদার।
এদেশের শিক্ষার্থীরা ৫২র ভাষা আন্দোলনকে লালন করে বড় হয়, এদেশের তরুণ-তরুণীরা ৬৬-এর ছয় দফা, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৭১ এর মুক্তিকামীদের ইতিহাস পড়ে বড় হয়। তাদের এই ইতিহাস পাঠ যে শুধু পড়াতেই সীমাবদ্ধ থাকে না; এই কোটা সংস্কার আন্দোলনই তার? প্রমাণ। তারা দেশের বিপ্লবী ইতিহাস পড়ার সঙ্গে সঙ্গে লালনও করে। এই কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনসহ বিভিন্ন সংস্কার আন্দোলনই তাদের ইতিহাস লালনের প্রতিচ্ছবি।
তবে এই সংস্কার আন্দোলন যে এখন আর সংস্কারমুখী আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ নেই, তা আন্দোলনের? গতিবিধি দেখে বোঝা যাচ্ছে। এই আন্দোলনের ব্যাপকতা বুঝতে হলে অতীতে ঘটে যাওয়া গণঅভ্যুত্থানের দিকে নজর দিতে হবে। ১৯৫২ এর গণঅভ্যুত্থান থেকে শুরু করে, এখন অবধি বলা যায় পাঁচটি মোটা দাগে গণঅভ্যুত্থান হয়েছে। প্রথম ১৯৫২ সালের গণঅভ্যুত্থান সমন্ধে আমরা জানি, দ্বিতীয় গণঅভ্যুত্থানটি ছিল ১৯৬৯ সালে আইয়ুব খানের আমলে। তারপর আমরা ১৯৭১ সালের গণঅভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতা পেয়েছি। স্বাধীনতার পর নব্বইয়ে এরশাদের বিরুদ্ধে চতুর্থ গণঅভ্যুত্থান হয়েছিল। ২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যে গণঅভ্যুত্থান দেখা দিয়েছে, তা আগের চারটি গণঅভ্যুত্থানকে ছাড়িয়ে গেছে। এই বিষয়ে বর্ষীয়ান রাষ্ট্রচিন্তাবিদ, তাত্ত্বিক ও রাজনীতিবিদ বদরুদ্দীন উমর? খুব স্পষ্ট মন্তব্য তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, এ গণঅভ্যুত্থান যত ব্যাপক হয়েছে এর আগে কোনো অভ্যুত্থান এত ব্যাপক কখনও হয়নি।”অবশ্য ১৯৭১ সালের গণঅভ্যুত্থানের পরিণতি যদি বাদ দেওয়া যায় তাহলে- আগের সব গণঅভ্যুত্থানকে ছাড়িয়ে গেছে, এই কোটা সংস্কার আন্দোলনে তৈরি হওয়া গণঅভ্যুত্থান।
উন্নয়নমুখী বক্তব্য ও প্রচার অভিযান চালিয়ে কখনোই কোনো সরকার নিজেদের দুর্নীতি, জুলুম, নির্যাতন, ঢাকতে পারেনি। জনমানুষের সামনে শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন ঘটনার মাধ্যমে সরকারের কপটতার রূপ সামনে এসেছে। বলে রাখা ভালো যে, আগের সব গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন হয়েছে। যদিও এই কোটা আন্দোলন মূল উদ্দেশ্য কখনোই তেমন ছিল না। তবে ঘটনা যত সামনে যাচ্ছে, এই গণঅভ্যুত্থানও সেদিকেই এগিয়ে যাচ্ছে বলে আমার বিশ্বাস। আগের গণঅভ্যুত্থানগুলোর পরিণতি দেখলে, ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থান কোন দিকে যাচ্ছে তা কিছুটা বুঝতে সুবিধা হবে।
ভাষাকে কেন্দ্র করে ১৯৫২ সালের যে গণঅভ্যুত্থান সমন্ধে আমরা জেনেছি তাতে অবশ্য সরকার পরিবর্তন সরাসরি না হলেও রাজনৈতিক দলগুলো একসঙ্গে সংগঠিত? হয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে এবং ১৯৫৪ সালে মুসলিম লীগ সরকাকে নির্বাচনে পরাজিত করে। জেনারেল আইয়ুব খানের আমলে ১৯৬৯ সালে যে গণঅভ্যুত্থান হয়েছিল, তাতেও আইয়ুব খানের সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল ইয়াহিয়া খানের সরকার।
আমরা জানি, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের লড়াই প্রথমে শুরুই হয়েছিল গণঅভ্যুত্থান দিয়ে। ১৯৭১ সালের শুরুতেই গণআন্দোলনের শুরু হয়েছিল। ’৭১ এর গণআন্দোলনের কারণে পাকিস্তান সরকার পরে তাদের কার্যক্রম আর স্বাভাবিকভাবে চালাতে পারেনি এবং সেনাবাহিনীর কার্যক্রম শুরু হয়েছিল বলেও আমরা জানি! এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল যে, সরকার তার স্বাভাবিক কার্যক্রম চালিয়ে যেতে আর সক্ষম ছিল না। তবে ঘটনা মোড় নিয়েছিল- ২৫ মার্চের পর। তারপর শুরু হয় যুদ্ধ। বলাই বাহুল্য, ওই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে- সরকার নয়, রাষ্ট্রে পরিবর্তন আসে এবং বাংলাদেশের জš§ হয়।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর, জেনারেল এরশাদের আমলেও আমরা গণআন্দোলনের পরিস্থিতি দেখেছি। এই আন্দোলনের বিষয়ে বদরুদ্দীন উমরের একটি মন্তব্য খুব প্রাসঙ্গিক। তিনি বলেন, এরশাদের সময়ে আন্দোলন কিন্তু দেশব্যাপী বিশাল আন্দোলন ছিল না। ওই আন্দোলন ছিল মূলত নাগরিক অভ্যুত্থান। কারণ গ্রামাঞ্চলে এরশাদবিরোধী আন্দোলন ছিল না। এ আন্দোলন ছিল ঢাকা শহর এবং অন্যান্য শহরকেন্দ্রিক। এমন একটি আন্দোলনেও জেনারেল এরশাদের পতন হয়েছিল। তিনি বর্তমান কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে বলেন, বর্তমানে যে গণঅভ্যুত্থান হয়েছে, এর ফলে চারদিকে এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে, তাতে এ সরকারের পক্ষে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ এ গণঅভ্যুত্থান যত ব্যাপক হয়েছে এর আগে কোনো অভ্যুত্থান এত ব্যাপক কখনো হয়নি।”
ইতিহাস বলছে, এদেশ সৃষ্টি হওয়ার আগে এবং পরে, কখনোই কোনো সংস্কার আন্দোলনে ২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের মতো- হত্যা ও হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। ১৯৭১ এর গণআন্দোলন মাধ্যমে স্বাধীনতা আন্দোলন ছাড়া। জার্মানভিত্তিক টিভি চ্যানেল- ডয়েচে ভেলের তথ্য অনুযায়ী, এখন অবধি মোট মৃত্যু সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২১০ জনে। অথচ ৫২-এর ভাষা আন্দোলনে শহীদদের সংখ্যা ছিল ৩৯ জন। আন্দোলনে যে ২১০ জন না ফেরার দেশে চলে গেছেন, তাদের মধ্যে বেশির ভাগই সাধারণ শিক্ষার্থী, সাধারণ মানুষ এবং ছোট ছোট মাসুম শিশু। শিশুগুলো জানতেও পারেনি, তাদের কেন গুলি করে হত্যা করা হলো! একটি গণতান্ত্রিক সরকারের অধীনে, একটি দেশে- এ ধরনের হত্যাযোগ্য আন্দোলনের পরিবেশ তৈরি হবে, তা সবার কল্পনাতীত ছিল।
সরকারপ্রধান নিজেও জানতেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন কতটা সময় উপযোগী এবং যৌক্তিক ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও ক্ষমতাবলে- ঘুমন্ত, নিরস্ত্র, অসহায় শিক্ষার্থীদের ওপর আক্রমণ হলো- সরকারি পুলিশ বাহিনী দিয়ে। নিরাপত্তার কথা বলে, আন্দোলন দমানোর চেষ্টায়, একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক সরকারের আওতায় কি এমন হামলা চলতে পারে? পারে না। পৃথিবীর কোনো গণতান্ত্রিক সরকারই স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে হস্তক্ষেপ করে নিরস্ত্র মানুষের ওপর হামলা করতে পারে না। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে যা ঘটেছে তাই সবার কাছেই দৃশ্যমান। তবে কি আসলেই সরকার চায়নি কোটার সংস্কার হোক? সরকার বার বার বলেছে তারাও কোটার সংস্কার চায়, তবে শিক্ষার্থীদের ওপর এতো হামলা কেন? এত লাশ কেন? এত বাবা-মায়ের আহাজারি কেন তৈরি করা হলো? সরকারের কাছে কি উত্তর আছে!
আমার মনে হয়, সরকার বেশি খেপেছে মুক্তিযোদ্ধা কোটার বিষয়টি নিয়ে। গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সরকারপ্রধানের কথায়ও তা বেশ অনুমেয়। শিক্ষার্থীদের ঢালাওভাবে রাজাকার ও রাজাকারের নাতিপুতি বলার অভিযোগ উঠেছে, তাতে শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষও ক্ষেপেছে। তার পরেই মূলত আন্দোলনের বেগ দ্বিগুণ বেড়েছে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা কোটার পরিমাণ কমানো কি খুব বেশি অযৌক্তিক দাবি ছিল শিক্ষার্থীদের? না। সময় ও আমাদের বর্তমান রাষ্ট্র ব্যবস্থা অনুযায়ী, মুক্তিযোদ্ধা কোটা কমানোসহ অনান্য কোটা কমিয়ে সীমিত আকারে কোটা রাখার দাবি খুবই যৌক্তিক।
আমি বিশ্বাস করি, মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান করা দেশের প্রতিটি নাগরিকের নৈতিক দায়িত্ব। কারণ তাদের আত্মত্যাগ ও অকুতোভয় দুঃসাহসিকতার জন্য আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছি। মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ অসম্মান করলে তা আমাদের গায়ে লাগা উচিত। দেশের তরুণ প্রজšে§র এতটা অধঃপতন মনে হয় এখনো হয়নি যে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ভুলে তারা মুক্তিযুদ্ধের বীর সৈনিকদের অমর্যাদা করবে। সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধাদের সবসময় আত্মত্যাগী রূপেই দেখেছি। আমার বিশ্বাস শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কারের আন্দোলনের সঙ্গে বেশির ভাগ মুক্তিযোদ্ধারাই একমত। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের কেউই দেশ স্বাধীনের পর, কোনো সরকার থেকে কোনো ধরনের সহযোগিতা নেয়ার জন্য হাত পাতেননি। কারণ তাদের আত্মমর্যাবোধ বলে দেয় তারা কোনো ধরনের সুবিধা নেয়ার জন্য দেশ স্বাধীন করেননি। তারা দেশ স্বাধীন করেছেন, পরবর্তী প্রজš§কে- সুন্দর, বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক, স্বাধীনতা দেশ উপহার দেয়ার জন্য। কিন্তু শেখ হাসিনার সরকার কি আসলেই মুক্তিযোদ্ধাদের এবং স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে পেরেছেন?
উন্নয়ন ও নারী অধিকার উন্নয়ন কর্মী এবং শিক্ষার্থী কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়