Print Date & Time : 17 June 2025 Tuesday 2:18 am

অত্যধিক মূল্যস্ফীতিতে সুনাগরিকের বিড়ম্বনা

মো. জিল্লুর রহমান: বর্তমান সরকারের অন্যতম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে দ্রব্যমূল্য হ্রাস ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। সরকার ক্ষমতায় আসার পর বারবার বলছে মূল্যস্ফীতি সাড়ে সাত শতাংশে নামিয়ে আনা হবে, কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে এটি নিয়ন্ত্রণে আসছে না। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে প্রথমেই সরকারের সদিচ্ছা ও রাজনৈতিক অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করা দরকার। তাদের পরামর্শ হচ্ছে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদের হার আরও বেশ হারে বাড়াতে হবে, পাশাপাশি সার্বিক অর্থনীতির স্বার্থে দরকার বাজার তদারকি, ব্যাংক খাতের সংস্কার, রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির পদক্ষেপ নেয়া এবং ব্যবসাবান্ধব বিনিয়োগ পরিবেশ সৃষ্টি করা। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে সুদের হার বাড়ানো দরকার এবং সুদহার বৃদ্ধির মাধ্যমেই মূল্যস্ফীতি কমাতে হবে। সুদহার বাড়ালে ডলারের বিনিময় হারেও স্থিতিশীলতা ফিরবে, ব্যাংকের তারল্যসংকটেরও সমাধান হবে। তখন বাইরে থাকা টাকাও ব্যাংকে ফিরে আসবে।

মুদ্রাস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে এমনিতেই ভোক্তাদের জীবন ওষ্ঠাগত। বাজারে চাল, ডাল, ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ, আলু, শীতকালীন শাকসবজি থেকে শুরু করে এমন কোনো নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য নেই, যার দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে না। দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণহীন ও লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি জনজীবনকে সত্যিই অতিষ্ঠ করে তুলছে। বাজারে অগ্নিমূল্যে ভোক্তারা নির্বিকার; বিশেষভাবে নিম্নআয়ের মানুষ যা আয় করছে, তার পুরোটাই জীবনধারণের জন্য ন্যূনতম খাদ্যদ্রব্য ক্রয় করতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা প্রভৃতির জন্য ব্যয় করার মতো অর্থ তাদের হাতে আর থাকছে না।

অর্থনীতিবিদরা সর্বদা মুদ্রাস্ফীতিকে অর্থনীতির সবচেয়ে বড় শত্রু হিসেবে গণ্য করেন। কারণ মুদ্রাস্ফীতি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে দেয়, মধ্য ও নিম্নবিত্ত আয়ের মানুষের কষ্ট বাড়িয়ে দেয় এবং ভোক্তাদের জীবনমানকে দুর্বিষহ করে তোলে। মানুষ একসময় হতাশায় নিমজ্জিত হয় এবং সামাজিক অস্থিরতা বেড়ে যায়। নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি মুদ্রাস্ফীতির অস্থিরতাকেও ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের পেঁয়াজ, আলু, ডিম, সবজি ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে টানা ১৪ মাস ধরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে। ২০২৩ সালের মার্চ মাসে প্রথম মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশ ছাড়ায়। এরপর তা আর কখনোই ৯ শতাংশের নিচে নামেনি। সর্বশেষ ২০২৪ সালের এপ্রিলে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, তবে বিভিন্ন কারণে সেগুলো কার্যকর হচ্ছে না। মূল্যস্ফীতি হচ্ছে ভোক্তাদের জন্য একধরনের বাড়তি চাপ, যা ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবার ওপর চাপ বাড়ায়। উচ্চ মূল্যস্ফীতি এখন অর্থনীতির অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। সর্বশেষ ২০২৪ সালের এপ্রিলে  খাদ্য মূল্যস্ফীতি আবারও ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে।

আমাদের দেশে আয় যে হারে বাড়ছে, তার চেয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য কয়েকগুণ বেশি হারে বৃদ্ধি পায়। কারণ একটাই, তা হচ্ছে বাজারের ওপর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কার্যকর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। নেই বাজার মনিটরিং, তদারকি এবং সে অনুযায়ী প্রতিকারের ব্যবস্থা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সব থেকে বেশি কষ্টকর পরিস্থিতিতে পড়ে নিম্নবিত্ত, অবসরপ্রাপ্ত সৎ সরকারি কর্মচারী, প্রবীণ জনগোষ্ঠী ও নিম্নআয়ের প্রান্তিক মানুষ। অধিকাংশ প্রবীণ সবচেয়ে বেশি কষ্টকর পরিস্থিতিতে রয়েছে। যেসব চাকরিজীবী সৎভাবে চাকরিজীবন কাটিয়েছে, তাদের অবস্থা আরও শোচনীয়। কারণ চাকরিজীবনের সঞ্চয়, পেনশন বা গ্র্যাচুইটির টাকাই তাদের একমাত্র সম্বল। জীবনের শেষ সম্বল এ সঞ্চয়ের টাকা দিয়ে তারা সঞ্চয়পত্র কিনেছে। এ সঞ্চয়পত্রের মুনাফার টাকা দিয়ে তাদের সংসার ও জীবনযাত্রা সম্পূর্ণভাবে নির্বাহ করতে হয়। যেন নুন আনতে পানতে ফুরায় অবস্থা, কিংবা মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা!

আসলে সরকার দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বিষয়ে একদম নির্বিকার। ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে বিভিন্ন অজুহাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে সাধারণ মানুষকে বিপাকে ফেলছে। একবার যে পণ্যের দাম বাড়ে, তা আর কমে না। সরকারি বিভিন্ন সংস্থা এ ব্যাপারে কাজ করলেও তা তেমন কার্যকর ভূমিকা না রাখায় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আসছে না। কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) নামে একটি সংস্থা রয়েছে; কিন্তু তাদের কার্যক্রমও তেমন লক্ষণীয় নয়। ভোক্তাদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য এটি প্রতিষ্ঠিত হলেও বাস্তবে তারা ভোক্তাদের অধিকার সংরক্ষণ কতটুকু করছে, তা সর্বসাধারণের বিচার্য। তাদের কার্যক্রম অনেকটা লোকদেখানো।

বর্তমানে চাল, তেল, পেঁয়াজ, আলু, শাকসবজি ইত্যাদি নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়েই চলছে। প্রতিটি পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণ হিসাবে ব্যবসায়ীরা একেকটি অজুহাত দাঁড় করায় এবং সরকারও তাদের সঙ্গে সমস্বরে সুর মেলায়। অথচ কিছু পণ্য আছে সরবরাহে ঘাটতি না থাকার পরও দাম বেড়ে যায়। তাছাড়া অতিরিক্ত টাকা দিলে এমন কোনো পণ্য নেই, যা বাজারে পাওয়া যায় না, অর্থাৎ আড়াল থেকে কলকাঠি নাড়াচ্ছে একদল দুর্বৃত্তের সিন্ডিকেট। আর এর মাশুল গুনছে সাধারণ মানুষ। নিত্যদিন তাদের পকেট কাটা হচ্ছে, কিন্তু দেখার কেউ নেই; ভোক্তারা নির্বিকার ও চরম অসহায়।

পণ্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে বর্তমানে ন্যায়সংগত মূল্যে কোনো পণ্যই আর পাওয়া যায় না। প্রতিটি পণ্যেই যেন অধিক মূল্যের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। সরকারের ভুল অর্থনৈতিক নীতি ও পরিকল্পনা সংকটকে আরও প্রকট করছে। পুরো অর্থনীতিতে এখনো ডলার সংকটের মারাত্মক প্রভাব। এর ফলে সরকারের লেনদেনে দেখা দিয়েছে রেকর্ড ঘাটতি, কমছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, ঋণ পরিশোধের খরচ বেড়েছে, দেখা দিয়েছে জ্বালানিসংকট, অসহনীয় হয়ে উঠেছে মূল্যস্ফীতির চাপ। গোটা অর্থনীতিতে টাকার মান কৃত্রিমভাবে ধরে রাখার খেসারত দিতে হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের বিনিময় হার বহু বছর ধরে রেখেছিল, সম্প্রতি বাজার চাহিদার ভিত্তিতে পেগিং রেট চালু করেছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার বাজার আরও অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে।  অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এখন সরকারের অগ্রাধিকার হতে হবে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা। কিন্তু তা না করে প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর নীতিতেই আগ্রহ বেশি সরকারের। এতে সংকট আরও বাড়ছে। মুদ্রাস্ফীতির চাপে পিষ্ট হচ্ছে ভোক্তাসাধারণ।

বাংলাদেশ ব্যাংক অবশ্য মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের জন্য এরই মধ্যে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অগ্রাধিকার হচ্ছে যেকোনো মূল্যে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতি সুদহার বা পলিসি রেট বৃদ্ধি করেছে। ফলে এখন থেকে ব্যাংকগুলোকে বাড়তি সুদ দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হবে এবং গ্রাহকদের বাড়তি রেটে ঋণ গ্রহণ করতে হবে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতি সুদহার বা রেপো বাড়ানো হয়। মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে থাকায় বাংলাদেশ ব্যাংক এ সংকোচনমূলক নীতি অনুসরণ করছে। এ নিয়ে ২০২২ সালের মে মাস থেকে বেশ কয়েকবার নীতি সুদহার বাড়িয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাজারে অর্থের সরবরাহ বাড়ার কারণে মূল্যস্ফীতির সূচক বাড়লে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার বৃদ্ধি করে। এর ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের যে ঋণ দেয়, তার সুদহার বাড়ে। নীতি সুদহার বেশি থাকলে ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ধার করতে নিরুৎসাহিত হয়।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করতে হলে সর্বপ্রথম রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। অবৈধভাবে দ্রব্য পাচার রোধ ও মজুতদারি রোধ করতে পারলে পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাবে না। বাংলাদেশের কৃষিনির্ভর সমাজব্যবস্থায় কৃষির উৎপাদন বাড়াতে এবং উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে কৃষিজমি থেকে সর্বোত্তম ফসল লাভের জন্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ, উন্নত বীজ, প্রচুর সার ও সেচ ব্যবস্থার সমন্বয় করতে হবে। কৃষিজাত পণ্যের উৎপাদন বাড়লে দাম এমনিতেই স্থিতিশীল থাকবে। বাজারের ওপর সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে। মুনাফাখোরদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। দেশে লাগামহীন দুর্নীতির অবসান ঘটাতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, দেশের সব মানুষকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজ স্বার্থ ত্যাগ করে দেশের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করতে হবে।

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির ও কষ্টের সম্মুখীন হয় স্বল্প আয়ের মানুষরা। সুতরাং তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। বাজারের ওপর সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে। অসাধু ব্যবসায়ী যাতে তার ইচ্ছামতো দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি করতে না পারে, সেজন্য দেশের জনগণকেও সচেষ্ট থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, মুনাফাখোর সমাজের উন্নয়নের পথে প্রধান অন্তরায়। তাই অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে হলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান সব সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে সাধারণ ও নিম্নআয়ের মানুষের ভালোভাবে বেঁচে থাকার অধিকার ও নিরাপত্তা। মুদ্রাস্ফীতির জাঁতাকলে পিষ্ট হওয়া থেকে ভোক্তাদের রক্ষা করতে হবে।

ব্যাংকার ও কলাম লেখক

ুৎনননঢ়Ñমসধরষ.পড়স