নিজস্ব প্রতিবেদক: ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে কুইক রেন্টাল ও অদক্ষ বিদ্যুৎকেন্দ্র ফেইজ আউট বা বন্ধের প্রস্তাব দিয়েছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সংগঠন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটি জানায়, ভর্তুকি কমানোর জন্য সরকার বিদ্যুতের বিল বাজারভিত্তিক সমন্বয়ের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বসিয়ে বসিয়ে ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হচ্ছে যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিপরীতে, সেগুলো বন্ধ করে দেয়া উচিত।
রাজধানীর মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টারে গতকাল ‘বাংলাদেশে জ্বালানি পরিবর্তনের জন্য চ্যালেঞ্জ এবং সুযোগ: একটি নাগরিক ইশতেহার’ শীর্ষক সভায় এ প্রস্তাব দেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। এ সময় তিনি জ্বালানি রূপান্তরে সরকারকে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেয়ার আহ্বান জানান। পাশাপাশি সিপিডির পক্ষ থেকে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি জ্বালানি রূপান্তর প্রস্তাব দেয়া হয়।
গোলাম মোয়াজ্জেম উল্লেখ করেন, বিদ্যমান বাস্তবতার নিরিখে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারে জ্বালানি খাতের বিষয়ে যতটা গুরুত্বারোপ করা দরকার ছিল, তা করা হয়নি। তিনি উল্লেখ করেন, সরকার ২০৪০ সাল নাগাদ ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এর মধ্যে ৪০ শতাংশ বা ২৪ হাজার মেগাওয়াট নবায়নযোগ্য খাত থেকে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নেয়া হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা মাত্র এক হাজার মেগাওয়াট। নবায়নযোগ্য উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে যে হারে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, তাতে ২০২৪ সালের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হওয়া কঠিন।
জ্বালানি রূপান্তরের ক্ষেত্রে সরকার ভুল নীতিতে অগ্রসর হচ্ছে বলে উল্লেখ করে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, রূপান্তরের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে সরকার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতের দিকেই বেশি অগ্রসর হচ্ছে। অথচ নবায়নযোগ্য উৎসের ওপর বেশি জোর দেয়ার কথা ছিল। তিনি বলেন, সরকার বিদ্যুতের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়ার উদ্যোগ নিচ্ছে। এক্ষেত্রে প্রান্তিক পর্যায়ের ভোক্তাদের ওপর যেন বাড়তি বোঝা চাপানো না হয়, তা নিশ্চিত করতে তিনি অদক্ষ বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ বন্ধ করে দেয়ার প্রস্তাব দেন।
সিপিডির স্বল্পমেয়াদি বা আগামী জুনের মধ্যে বাস্তবায়নযোগ্য প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছেÑজ্বালানির চাহিদা পূর্বাভাস সংশোধন করা, জ্বালানির মূল্য পরিশোধ স্থানীয় মুদ্রায় করা, বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র আহ্বান করা, সোলার সামগ্রীতে শুল্ক কমানো, বায়োগ্যাস ব্যবহার করা প্রভৃতি। মধ্যমেয়াদি বা ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে কুইক রেন্টাল ও অদক্ষ বিদ্যুৎকেন্দ্র, যেগুলো এখনও বিদ্যমান ‘ফেইজ আউট’ তালিকায় নেই, সেগুলো দেরি না করে ফেইজ আউট করা।
এছাড়া সিপিডির মধ্যমেয়াদি প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছেÑবিদ্যুৎ ও জ্বালানি পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দুতে নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে অন্তর্ভুক্ত করা, অভিন্ন লক্ষ্যমাত্রাসহ সমন্বিত জ্বালানিনীতি গ্রহণ করা, প্রকৌশলীদের জন্য নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিষয়ে জাতীয় প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করা, পাওয়ার প্ল্যান্ট ইনডিমিনিটি অ্যাক্ট বাতিল করা। এছাড়া জ্বালানির জন্য আলাদা সেল করা, স্রেডা ও বিইআরসিকে শক্তিশালী করাসহ একাধিক দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তাব দিয়েছে সিপিডি।
জ্বালানির রূপান্তরে রাজনৈতিক দলগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি, নির্বাচনী ও নাগরিক সমাজের ইশতেহার শীর্ষক মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করে ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, নির্বাচনে জ্বালানির গুরুত্ব আগেও ছিল, আগামীতেও থাকবে। বিগত কয়েকটি নির্বাচনের ইশতেহার বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দলগুলো বিদ্যুৎ উৎপাদন ও জ্বালানি আমদানিতে মনোযোগী। এর বিপরীতে দেশীয় উৎস থেকে জ্বালানি অনুসন্ধান ও আহরণে আগ্রহ নেই বললেই চলে। পাশাপাশি নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে তাদের মনোযোগ কম।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, প্রতিটি সেক্টরের কার্যক্ষমতা নির্ভর করে বিদ্যুৎ খাতের ওপর। অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে বিদ্যুৎ খাতের গুরুত্ব অপরিসীম। এই বাস্তবতা বিবেচনায় রেখে তিনি একটি দক্ষ জ্বালানি মিশ্রণ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেন।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সিরাজগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য তানভীর শাকিল জয় বলেন, রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে এখন বেশ সমালোচনা হচ্ছে এগুলোর নানা ধরনের অদক্ষতার কারণে। কিন্তু ২০০৯ সালে যখন দেশে বিদ্যুতের জন্য হাহাকার চলছিল তখন ত্বরিত গতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করা ছাড়া কোনো গত্যন্তর ছিল না। তিনি বলেন, এক্ষেত্রে যে কিছু ভুল-ভ্রান্তি হয়নি, তা নয়। আমরা এখন সেসব ভুল শোধরানোর চেষ্টা করছি।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. এম তামিম বলেন, ইউরোপের অনেক দেশ নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে তাদের পুরো ব্যবস্থা রূপান্তর করেছে। কিন্তু তাদের বাস্তবতা আর আমাদের বাস্তবতা এক নয়। ওখানে যে ধরনের অবকাঠামো গড়ে উঠেছে, আমাদের এখানে এখনও তা গড়ে ওঠেনি। কাজেই এখনই নবায়নযোগ্য উৎসের ওপর বড় আকারে নির্ভর করার সুযোগ নেই। ধীরে ধীরে নবায়নযোগ্য উৎসের দিকে অগ্রসর হতে হবে।