অধরাই থাকছে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার অধিকাংশ লক্ষ্য

মো. মাসুম বিল্লাহ:যেসব পরিকল্পনার ভিত্তিতে বাংলাদেশে উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়, তার মধ্যে শীর্ষে রয়েছে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা। মূলত অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও সেগুলোর লক্ষ্য-উদ্দেশ্যগুলো এ পরিকল্পনায় সন্নিবেশিত করা হয়। পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকে বলা হয় সরকারের ‘ফ্ল্যাগশিপ’ পরিকল্পনা দলিল। কারণ এ দলিলের ওপর ভিত্তি করেই সরকারের সার্বিক উন্নয়ন ও কল্যাণমূলক কার্যক্রম পরিচালিত হয় বলে সরকার দাবি করে। আর এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হয় মূলত জাতীয় বাজেটের মাধ্যমে। কিন্তু বাজেটে যেসব প্রক্ষেপণ দেয়া হয় এবং বাজেটের মাধ্যমে যে উন্নয়ন অগ্রগতি অর্জন হয়, তার সঙ্গে সঙ্গতি থাকছে না পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার।

সম্প্রতি জাতীয় সংসদে উত্থাপিত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতি পর্যালোচনা করে এমনটিই জানা গেছে। পর্যালোচনায় দেখা যায়, পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বছরভিত্তিক মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির যে প্রক্ষেপণ দেয়া হয়েছে প্রকৃত জিডিপি প্রবৃদ্ধি তার চেয়ে কম। পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল সাত দশমিক চার শতাংশ। ওই অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ছয় দশমিক ৯৪ শতাংশ। এর পরের অর্থবছর প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ছিল সাত দশমিক সাত শতাংশ। অর্থবছরটিতে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে সাত দশমিক এক শতাংশ। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করা হয়েছে আট শতাংশ। সাময়িক হিসাব অনুযায়ী, অর্থবছরটিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ছয় দশমিক শূন্য তিন শতাংশ। পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন করা আছে আট দশমিক ৩২ শতাংশ। কিন্তু অর্থনীতির চলমান ধীরগতির কারণে প্রস্তাবিত বাজেটে এ প্রবৃদ্ধির প্রক্ষেপণ কিছুটা হ্রাস করে সাড়ে সাত শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হওয়া নিয়েও সংশয় রয়েছে। আর পরিকল্পনার শেষ বছর ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন করা হয়েছে আট দশমিক ৫১ শতাংশ। এত উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হবে কিনা সেটি সে সময়ের বাস্তবতার ওপর নির্ভর করবে।

অষ্টম পরিকল্পনায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে জিডিপির অনুপাতে বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৩৪ শতাংশ। কিন্তু বাস্তবে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৭ দশমিক ৮৪ শতাংশ। পরিকল্পনায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ৩৪ দশমিক ৯৪ শতাংশ। আর অর্থবছরটির জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে মোট বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ, যা পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কম। আর এ লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে কেবল বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে যা মাত্র ২১ দশমিক ৮৫ শতাংশ। মাত্র এক বছরের ব্যাবধানে জিডিপির প্রায় ছয় শতাংশ বিনিয়োগ বৃদ্ধির কোনো নজির এর আগে নেই। আর বিদ্যমান বাস্তবতায় এত বেশি বিনিয়োগ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।

বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির ক্ষেত্রে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা ছিল তিন লাখ ৬ হাজার কোটি টাকা। আর অর্থবছরটির জন্য ঘোষিত বাজেটে এ ক্ষেত্রে বরাদ্দ রাখা হয়েছে দুই লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। সাধারণত বাজেটে এডিপির যে ঘোষণা দেয়া হয়, চূড়ান্ত বিচারে তার ৮০ শতাংশের কাছাকাছি বাস্তবায়ন হয়। কাজেই ঘোষিত এই এডিপিও যে পুরোপুরি বাস্তবায়ন হবে না সে বিষয়ে নিশ্চিত করেই বলা যায়। সে ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় এডিপি বাস্তবায়ন অনেক কম হবে।

সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) ক্ষেত্রে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে আট দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু বর্তমানে প্রতি বছর গড় এফডিআইয়ের পরিমাণ তিন বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। এমন পরিস্থিতিতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলারের এফডিআইয়ের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে, যা কোনোভাবেই বাস্তবায়নযোগ্য নয় বলে বিশ্লেষকরা মনে করে। অন্যদিকে সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় যে প্রক্ষেপণ দিয়েছিল, বর্তমান মূল্যস্ফীতি তার চেয়ে অনেক বেশি। বর্তমানে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে মাসিক মূল্যস্ফীতির হার প্রায় ১০ শতাংশ। অথচ এমন বাস্তবতার মধ্যেও সরকার মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের মধ্যে আটকে রাখার ঘোষণা দিয়েছে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে। আর পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা পাঁচ শতাংশেরও নিচে। এছাড়া আমদানির যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তার চেয়ে আমদানি ব্যয় অনেক বেশি হয়েছে বিগত ২০২১-২২ অর্থবছরে। এর ফলে বাণিজ্যের আড়ালে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে গেছে বলে স্বয়ং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরই স্বীকার করেছেন।

তবে এতকিছু ক্ষেত্রে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার লক্ষ্যমাত্রা অর্জিন না হলেও দারিদ্র্য নিরসেনর ক্ষেত্রে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল, তা ঠিকই অর্জিত হয়ে গেছে। যদিও প্রবৃদ্ধির সঙ্গে দারিদ্র্য হ্রাসের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। তা সত্ত্বেও কাক্সিক্ষত প্রবৃদ্ধি ব্যতিরেকে কী উপায়ে দারিদ্র্য এত দ্রুত হ্রাস পেল, তা নিয়ে নীতি বিশ্লেষকদের মধ্যে প্রশ্ন রয়েছে।

সরকার পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হচ্ছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে পরিকল্পনা মন্ত্রী এমএ মান্নান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘অর্জনের জন্য কিছু লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু সবক্ষেত্রে যে সেগুলো শতভাগ অর্জন করা সম্ভব হবে, তেমনটি প্রত্যাশা করা ঠিক নয়। এক্ষেত্রে সরকারকে ব্যর্থ বলা যাবে না। সরকার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে এবং অনেক ক্ষেত্রেই সফলভাবে নানা লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নও করছে।’

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০