রহমত রহমান: দেশের অন্যতম প্রধান তৈরি পোশাক উৎপাদন ও রপ্তানিকারী অনন্ত গ্রুপ। এই গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান অনন্ত ডেনিম টেকনোলজি লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে বন্ড সুবিধার অপব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। বন্ড সুবিধার প্রায় ২৩ লাখ কেজি কাপড় ও প্রায় ২৯ লাখ কেজি কেমিক্যাল অবৈধভাবে সরিয়ে ফেলা হয়েছে বলে নিবারক দলের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, যাতে প্রায় ১০৩ কোটি টাকার শুল্ককর ফাঁকি হয়েছে। এই শুল্ককর পরিশোধে প্রতিষ্ঠানকে দাবিনামা জারি করা হয়। তবে প্রতিষ্ঠানের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে পুনঃতদন্তে কমিটি গঠন করা হয়।

কমিটি তদন্ত শেষে গত বছরের শেষ সময়ে প্রতিবেদন দেয়, যাতে ফাঁকির পরিমাণ মাত্র ১৭ কোটি টাকা কমেছে। এর পরও অবৈধভাবে বন্ডেড কাপড় ও কেমিকেল সরিয়ে ফেলার বন্ড কমিশনারেটের দাবিকে ভিত্তিহীন বলছে অনন্ত গ্রুপ কর্তৃপক্ষ। আর তদন্ত দলের কর্মকর্তারা বলছেন, সবকিছুই যাচাই করেই প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। প্রতিবেদনের একটি কপি দৈনিক শেয়ার বিজের হাতে এসেছে।
এদিকে কমিটির প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে আবারও তদন্তের জন্য প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে দাবি জানানো হয়, যার পরিপ্রেক্ষিতে আবারও তদন্তের জন্য কমিটি গঠন করা হয়েছে। এনবিআর সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
২০১৯ সালের ৩০ মে নিবারক দলের দেয়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বন্ড সুবিধার কাঁচামাল অবৈধভাবে অপসারণ করে খোলাবাজারে বিক্রি করা হচ্ছে এমন গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ২০১৯ সালের ২১ মে ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের নিবারক দল নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও কাঁচপুর নয়াবাড়ী এলাকায় অবস্থিত মেসার্স অনন্ত ডেনিম টেকনোলজি লিমিটেড পরিদর্শন করে। এ সময় প্রতিষ্ঠানের বন্ডেড ওয়্যারহাউসে বন্ড সুবিধার ২৩ লাখ ৪১ হাজার ১৩৪ কেজি ডেনিম ফেব্রিক্স (কাপড়) ও ২৯ লাখ ১১ হাজার ৪৭৫ কেজি ডাইস কেমিক্যাল কম পাওয়া যায়। ২৩ লাখ ৪১ হাজার ১৩৪ কেজি ডেনিম ফেব্রিক্সের শুল্কায়নযোগ্য মূল্য ১০৮ কোটি ৪৩ লাখ ৩৪ হাজার ৪৪৬ টাকা, যার মধ্যে প্রযোজ্য শুল্ককর ৯৯ কোটি ৬২ লাখ ৯২ হাজার ৪১ টাকা। আর ২৯ লাখ ১১ হাজার ৪৭৫ কেজি ডাইস কেমিক্যালের শুল্কায়নযোগ্য মূল্য ১১ কোটি ১৪ লাখ ৩৫ হাজার ১৯ টাকা, যাতে প্রযোজ্য শুল্ককর চার কোটি ছয় লাখ ৭৪ হাজার ২৮৮ টাকা। কাপড় ও কেমিক্যালে মোট প্রযোজ্য শুল্ককর ১০৩ কোটি ৬৯ লাখ ৬৬ হাজার ৩২৯ টাকা।
এতে আরও বলা হয়, প্রতিষ্ঠানের ২০১৭ সালের ২৭ মে থেকে ২০১৮ সালের ২৫ মে পর্যন্ত নিরীক্ষা মেয়াদে সমাপনী মজুত ছিল ৩০ লাখ ৫৯ হাজার ৮০৩ গজ বা এক হাজার ৬৪৫ দশমিক ১১ মেট্রিক টন ডেনিম ফেব্রিক্স। এনবিআরের সিআইএস সেলের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটি ২০১৮ সালের ২৬ মে থেকে ২০১৯ সালের ২১ মে পর্যন্ত চার হাজার ৫৭২ দশমিক ৫৭ মেট্রিক টন কাপড় আমদানি করেছে। সে হিসেবে প্রতিষ্ঠানে কাপড় মজুত থাকার কথা ছয় হাজার ২১৭ দশমিক ৬৮ মেট্রিক টন। আর এই সময়ে রপ্তানি হয়েছে তিন হাজার ৫৭৬ মেট্রিক টন। পরিদর্শনের সময় ৩৫৮ দশমিক ৮৬৬ মেট্রিক টন কাপড় মজুত পাওয়া গেছে। অর্থাৎ রপ্তানি বাদেও পরিদর্শনের সময় দুই হাজার ৩৪১ দশমিক ১৩৪ মেট্রিক টন কাঁচামাল কম পাওয়া গেছে।

নিবারক দলের প্রতিবেদন অনুযায়ী বন্ড কমিশনারেট থেকে ২০১৯ সালের ৪ জুলাই দাবিনামা-সংবলিত কারণ দর্শানোর নোটিস জারি করা হয়। এরই প্রেক্ষিতে একই বছরের ৭ জুলাই প্রতিষ্ঠানের বন্ডেড ওয়্যারহাউস পুনঃপরিদর্শনের অনুরোধ জানিয়ে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে এনবিআরে আবেদন করা হয়। এনবিআর ওই বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর ১০ সদস্যের কমিটি গঠন করে। কমিটি ওই বছরের ১৪ অক্টোবর প্রতিষ্ঠানের বন্ডেড ওয়্যারহাউস পরিদর্শন করে। পরে কমিটি একটি সভা করে।
এতে সিদ্ধান্ত হয়, প্রতিষ্ঠানটি চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস দিয়ে ২০৯টি শিপিং বিল এবং ঢাকা কাস্টম হাউস দিয়ে ১৬টি শিপিং বিলের মাধ্যমে পণ্য রপ্তানি করেছে, যা সিআইএস সেল থেকে পাওয়া যায়নি। তবে দুটি কাস্টম হাউস থেকে এসব শিপিং বিল যাচাইয়ের সিদ্ধান্ত হয়। নিবারক দল সিআইএস সেলের তথ্যমতে যে রপ্তানি হিসাব উপস্থাপন করেছিল, তার মধ্যে ২২৫টি শিপিং বিলের হিসাব দাখিল করা প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। ফলে এই শিপিং বিল যাচাইয়ের জন্য ৩ ডিসেম্বর দুটি কাস্টম হাউসে চিঠি দেয়া হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা কাস্টম হাউস ১৬টি এবং চট্টগ্রাম কাস্টম ২০৯টি শিপিং বিল সঠিক বলে জানায়। একটি শিপিং বিল এই প্রতিষ্ঠানের নয়। অর্থাৎ ২২৪টি শিপিং বিলের আওতাধীন রপ্তানি পণ্যের ওজন ৩৯৯ দশমিক ৩১৪ মেট্রিক টন। ফলে প্রতিষ্ঠানের ওয়্যারহাউসে কম পাওয়া দুই হাজার ৩৪১ দশমিক ১৩৪ মেট্রিক টন থেকে ৩৯৯ দশমিক ৩১৪ মেট্রিক টন বাদ দিলে বাকি থাকে এক হাজার ৯৪১ দশমিক ৮১৯ মেট্রিক টন। এই কাঁচামাল প্রতিষ্ঠানটি অবৈধভাবে অপসারণ করেছে, যার শুল্কায়নযোগ্য মূল্য ৮৯ কোটি ৯৩ লাখ ৮৫ হাজার ৪৪২ টাকা। এতে শুল্ককরের পরিমাণ ৮২ কোটি ৬৩ লাখ ৫৯ হাজার ৯৪৯ টাকা।
সিআইএস সেলের তথ্যমতে, প্রতিষ্ঠানটি ২০১৮ সালের ২৬ মে থেকে ২০১৯ সালের ২১ মে পর্যন্ত ২৯ হাজার ১১ হাজার ৪৭৫ কেজি ডাইস ও কেমিক্যাল আমদানি করেছে। তবে তা ইন-টু বন্ড রেজিস্টারে এই কেমিক্যাল এন্ট্রি করেনি। আর নিবারক দলের সদস্যরা পরিদর্শনের সময় ওয়্যারহাউসে ওই কেমিক্যাল পাননি। তদন্ত কমিটির সদস্যরাও ওই কেমিক্যাল পাননি। ফলে ওই কেমিক্যালের প্রযোজ্য শুল্ককর চার কোটি ছয় লাখ ৭৪ হাজার ২৮৮ টাকা আদায়ে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেন তারা। ডেনিম ফেব্রিক্স ও কেমিক্যাল থেকে মোট ৮৬ কোটি ৭০ লাখ ৩৪ হাজার ২৩৭ টাকা শুল্ককর আদায়ে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে কমিটি সুপারিশ করে। অর্থাৎ পুনঃপ্রতিবেদনে প্রতিষ্ঠানের প্রমাণের পরিপ্রেক্ষিতে মাত্র ১৬ কোটি ৯৯ লাখ ৩২ হাজার ৯২ টাকার শুল্ককর কমেছে।
এ বিষয়ে অন্তত গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরীফ জহীর শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমাদের প্রতি বছর রপ্তানি বাড়ছে। এছাড়া এত বড় কারখানা। দুই দিনেও কর্মকর্তারা কাপড়ের হিসাব মিলাতে পারবেন না। অথচ বন্ড কর্মকর্তারা ইফতারের আগে গিয়ে সামান্য হিসাব করে একটা প্রতিবেদন দিয়েছেন, যাতে বলেছে, প্রায় ২৯ লাখ কেজি কেমিক্যাল ও ২৩ লাখ কেজি কাপড় নেই। আমাদের তো অডিট হয়েছে, যাতে আমাদের সব কিছু আপ-টু-ডেট। এর পরও কীভাবে বলেÑকাপড় ও কেমিক্যাল কম আছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের একটা ডিমান্ড দিয়েছে। আমরা চিঠি দেয়া ও সাবেক চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করার পর কমিটি হয়েছে। সেই কমিটি সব হিসাব করে দিয়েছে, তা কমিশনারেট আমলে না নিয়ে আবার একটা প্রতিবেদন দিয়েছে। আমি বর্তমান চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করে বলেছি, আমরা ফেয়ার জাজমেন্ট চাই, কারণ আমরা ফাঁকি দিই না। চেয়ারম্যান ন্যায়বিচারের আশ্বাস দিয়েছেন।’
যদিও কমিটির একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেয়ার বিজকে বলেন, অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। এর পরও প্রতিষ্ঠানের প্রশ্ন তোলায় আমরা হতবাক।