অনলাইনে অবৈধ এমএলএম ব্যবসায় ঝুঁকছে তরুণরা

মেহেদী হাসান: ঘরে বসে আয় করুন লাখ টাকা। এ স্লোগান বাংলাদেশে এখন নতুন কিছু নয়। আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে ঘরে বসে লাখ টাকা আয় করা এখন অসম্ভব কিছুই নয়। তবে কোনো কাজ না করে শুধু বিজ্ঞাপন দেখলেই অ্যাকাউন্টে জমা হবে ডলার। ‘ভিউক্যাশ’ নামক একটি ওয়েবসাইটে অ্যাকাউন্ট খুললেই এ ব্যবসা করা যাবে। লোভনীয় আর চমকপ্রদ এ অবৈধ এমএলএম ব্যবসায় ঝুঁকে পড়ছে তরুণ প্রজন্ম।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভিউক্যাশ নামক একটি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন করে অ্যাকাউন্ট খুললেই এ ব্যবসা করা যায়। তবে অ্যাকাউন্ট খুলতে একটি স্পন্সর আইডি প্রয়োজন। অর্থাৎ এ ওয়েবসাইটে অ্যাকাউন্ট আছে এমন কারও আইডি ব্যবহার করতে হবে। আর এই আইডি ব্যবহার করলে তিনটি ক্যাটাগরিতে সর্বোচ্চ ১০০ ডলার বা আট হাজার টাকা খরচ করতে হবে। ভিউক্যাশে যাদের অ্যাকাউন্ট আছে তাদের কাছ থেকে এ ডলার কিনতে হবে। এভাবে ভিউক্যাশের সদস্য হওয়ার পরে সদস্যদের আইডিতে অ্যাড কর্নার আসবে। যেখানে ক্লিক করলেই বিভিন্ন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির অ্যাড বা বিজ্ঞাপন দেখা যাবে। এ আইডিতে প্রতিদিন ২৯টি বিজ্ঞাপন দেখলেই দুই থেকে তিন ডলার জমা হবে ব্যবহারকারী সদস্যের অ্যাকাউন্টে। তবে এ ডলারের অর্ধেক চলে যাবে আবার স্পন্সর আইডিধারী সদস্যদের অ্যাকাউন্টে।

ভিউক্যাশে যাদের আইডি আছে তাদের টার্গেট থাকে নতুন নতুন সদস্য সংগ্রহ করা। কেননা নতুন সদস্যদের আয়ের অংশ পাবে স্পন্সর আইডিধারীরা। এভাবেই তারা ভিউক্যাশ ওয়েবসাইটে বিজ্ঞাপন দেখে ডলার আয়ের পাশাপাশি অতিরিক্ত ডলার আয়ের জন্য ভিউক্যাশের সঙ্গে নতুন সদস্য যুক্ত করেন। একজনের মাধ্যমে আরেকজন যুক্ত হন ভিউক্যাশে। উদ্দেশ্য, বিনা পরিশ্রমে ঘরে বসে অর্থ উপার্জন করা।

রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাহাত রায়হান। ১০০ ডলার খরচ করে ভিউক্যাশে অ্যাকাউন্ট খুলে ঘরে বসেই ডলার আয় করছেন তিনি। জানতে চাইলে তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, ‘এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ঘরে বসেই বিনা পরিশ্রমে আয় করার সুযোগ রয়েছে। এই ওয়েবসাইটে আইডি খুলে বিজ্ঞাপন দেখার মাধ্যমে ডলার আয় করা যায়। তবে এই ডলার টাকায় ক্যাশ করা একটু কঠিন। ব্যাংকের মাধ্যমে এই টাকা তুলতে অনেক সময় লাগে। তবে ভিউক্যাশে যাদের অ্যাকাউন্ট আছে তাদের মাধ্যমে ডলার ট্রান্সফার করা সম্ভব।’

তিনি বলেন, ‘এ ওয়েবসাইটটা চলছে পাঁচ থেকে ছয় মাস ধরে। এই সাইটের কোনো গ্যারান্টি নেই। আজ আছে তো, কাল নেই। এমন অনেক কোম্পানি এসে আবার চলে গেছে। এটাও হয়তো কিছুদিন থাকবে। তাই যত দিন পারি আয় করছি।’

কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের ছাত্র রাজন আহমেদ তার ভিউক্যাশ আইডির মাধ্যমে বেশ কিছু ডলার আয় করেছিলেন। তবে তিনি এখন আর তার ওয়েবসাইটে ঢুকতে পারছেন না। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ভিউক্যাশের ওয়েবসাইটে এখন সমস্যা চলছে। এটি এখন আর খোলা যাচ্ছে না।’

রবিউল ইসলাম নামের আরেক শিক্ষার্থী অভিযোগ করে বলেন, ‘ভিউক্যাশের মাধ্যমে আয় করা ডলার ব্যাংকের মাধ্যমে ক্যাশ করা যাচ্ছে না। ভিউক্যাশে আইডিধারীদের কাছে ডলার ট্রান্সফার করে টাকা ক্যাশ করা যায়। যেহেতু এখানে ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন করা যায় না। তাই এটি একটি অবৈধ ব্যবসা।’

ভিউক্যাশের বিষয়ে জানতে চাইলে তথ্যপ্রযুক্তিবিদ মোস্তাফা জব্বার শেয়ার বিজকে বলেন, ‘এ ধরনের ওয়েবসাইটের নাম আমি প্রথম শুনেছি। তবে সব কিছুই দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী করা উচিত। দেশের প্রচলিত আইনের বাইরে কোনো লেনদেনকে আমরা সমর্থন করি না। তাই এসব বিষয়ে তরুণদের সচেতন করতে হবে।’

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশে বহুস্তর বিপণন (এমএলএম) পদ্ধতির সব কোম্পানিই এখন বেআইনি। সরকার লাইসেন্স দিয়েছে এমন একটিও এমএলএম কোম্পানি আর নেই। এমএলএম পদ্ধতিতে কেউ ব্যবসা করলে আইনত দণ্ডনীয় হবেন। প্রায় দেড় যুগ ধরে চললেও এমএলএম পদ্ধতিতে ব্যবসা করার কোনো আইন ছিল না দেশে। অথচ যৌথ মূলধনি কোম্পানি ও ফার্মগুলোর নিবন্ধকের কার্যালয় (রেজসকো) থেকে নিবন্ধন নিয়ে শতাধিক এমএলএম কোম্পানি গড়ে ওঠে দেশে। তবে ডেসটিনি গ্রুপের অনিয়ম-দুর্নীতি ও প্রতারণার ফাঁদ ধরা পড়ার পর ২০১২ সালে সরকার প্রথম এটি আমলে নেয়।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ভিউক্যাশ নামের ওয়েবসাইটটির পুরো নাম ‘ভিউ ক্যাশ বিজনেস অর্গানাইজেশন লিমিটেড’। যার ঠিকানা দেওয়া আছে রাশিয়া। তবে ভিউক্যাশ ছাড়াও এমন আরও অনেক ওয়েবসাইট আছে, যা বিভিন্ন দেশে ডোমেইন কিনে ওয়েবসাইট খুলে অবৈধ ব্যবসা পরিচালনা করছে বলে জানান কয়েকজন আইটি কর্মকর্তা। ‘ভিউক্যাশ বাংলাদেশ’ নামে ফেসবুকে একটি পাবলিক গ্রুপ রয়েছে। যে গ্রুপে প্রায় তিন হাজার ১০৮ জন সদস্য রয়েছে। যাদের অধিকাংশ সদস্যই ভিউক্যাশে আইডি খুলেছেন। এ গ্রুপের কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেছে, ভিউক্যাশসহ এমন অনেক ওয়েবসাইটের মাধ্যমে সহজে অর্থ উপার্জন করতে যারা আইডি খুলেছেন তাদের বেশিরভাগই তরুণ শিক্ষার্থী। এদের কেউ কেউ টাকা ধার করে, কেউ আবার ঋণ নিয়ে কেউ বা আবার গরু-ছাগল বিক্রি করে ভিউক্যাশে আইডি খুলছেন। অনেকে ডলার আয় করছেন আবার কেউ কেউ প্রতারিত হচ্ছেন।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এবং সমাজ গবেষক মো. তৌহিদুল হক শেয়ার বিজকে বলেন, ‘বর্তমানে আমারও লক্ষ করছি তরুণ প্রজš§ বিশেষ করে কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অনলাইন ব্যবসায় ঝুঁকে পড়ছে। অনলাইনে তারা এমন কিছু ব্যবসায় জড়াচ্ছে যার কোনো ধরনের আইন বা নীতিমালা নেই। বাহারি বিজ্ঞাপনের ফাঁদে পড়ে এর মাধ্যমে অনেকে প্রতারিত হচ্ছেন। এছাড়া অনলাইন বিজনেসের নামে কেউ কেউ সারাদিন অনলাইনে পড়ে থাকে। ফলে তাদের দেহে বিভিন্ন রোগের উপসর্গ দেখা দিতে পারে। সমাজেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।’

 

 

Add Comment

Click here to post a comment

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০