রহমত রহমান: ইএফডি মেশিন ও এসডিসি স্থাপন করার পরও হোটেল, রেস্তোরাঁর ভ্যাট ফাঁকি থামানো যাচ্ছে না। ফাঁকি দিতে প্রতিনিয়ত নতুন কৌশল নেয়া হচ্ছে। এমনই একটি কৌশল হলো অনলাইনে খাবার বিক্রি। করোনার ভয়, সশরীরে গিয়ে খাবার বিড়ম্বনা এড়াতে অনেকেই ফুডপান্ডা, পাঠাও ফুড, সহজ ফুডসহ অন্যান্য খাবার ডেলিভারি অ্যাপসের মাধ্যমে অনলাইনে খাবার অর্ডার করছেন। হোটেল, রেস্তোরাঁ এসব অ্যাপসে আসা অর্ডারের খাবার সরবরাহের সময় ভ্যাট নেয়। কিন্তু অ্যাপসে খাবার বিক্রির তথ্য ইএফডি বা এসডিসিতে দেখানো হচ্ছে না। এমনকি অ্যাপসে খাবার বিক্রির তথ্য ভ্যাট রিটার্নেও দেখাচ্ছে না দেশের নামিদামি হোটেল, রেস্তোরাঁ। এর মাধ্যমে ফাঁকি দেয়া হচ্ছে ভ্যাট।
ঢাকা দক্ষিণ ভ্যাট কমিশনারেট তথ্য যাচাই করে ভ্যাট ফাঁকির প্রমাণ পেয়েছে। ৩১৮টি হোটেল, রেস্তোরাঁয় স্থাপিত ইএফডি, এসডিসির তথ্য ও এসব হোটেল, রেস্তোরাঁর ভ্যাট রিটার্ন যাচাই করছে। বার্গার এক্সপ্রেস, কাদেরিয়া ক্যাফে, স্ট্রিট ওভেন, চিজ রেস্টুরেন্ট, ভূতের বাড়ি, পিৎজা কিংয়ের মধ্যে নামিদামি হোটেল, রেস্তোরাঁর ভ্যাট ফাঁকি ইতোমধ্যে উদ্ঘাটন করেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এছাড়া ফুডপান্ডা, পাঠাও ফুড, সহজ ফুডসহ অন্যান্য অনলাইন ফুড সার্ভিস প্রোভাইডার প্রতিষ্ঠানের যোগসাজসে এসব হোটেল, রেস্তোরাঁ ভ্যাট ফাঁকি দেয়া হচ্ছে কি না-তা খতিয়ে দেখছে ভ্যাট ঢাকা উত্তর কমিশনারেট (এসব প্রতিষ্ঠান উত্তর কমিশনারেটের আওতাধীন)। এসব সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
ভ্যাট ঢাকা দক্ষিণ কমিশনারেটের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনলাইন ফুড ডেলিভারি অ্যাপসের মাধ্যমে তথ্যের আড়াআড়ি যাচাই করা হয়েছে। এই কমিশনারেটের অধিক্ষেত্রে স্থাপিত ইএফডি ও এসডিসি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ৩১৮টি হোটেল-রেস্টুরেন্টের অনলাইনে বিক্রি করা খাবারের তথ্য যাচাইয়ের লক্ষ্যে ফুডপান্ডা, পাঠাও ফুড, সহজ ফুড ইত্যাদি থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এসব তথ্য দাখিলপত্রের সঙ্গে আড়াআড়ি যাচাই কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ইতোমধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান থেকে ১৬ লাখ ৭১ হাজার ৮২৪ টাকার ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটন করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো দাখিলপত্রে যে বিক্রি দেখিয়েছে, অ্যাপসে এর চেয়ে কয়েকগুণ বেশি বিক্রি হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম বেইলি রোডের বার্গার এক্সপ্রেস। প্রতিষ্ঠানটি জানুয়ারি মাসে দাখিলপত্রে খাবার বিক্রির বিপরীতে ভ্যাট দেখিয়েছে মাত্র ২৯ হাজার টাকা। অথচ ফুডপান্ডা, পাঠাও ফুড, সহজ ফুডসহ অন্যান্য অ্যাপসের মাধ্যমে খাবার বিক্রির বিপরীতে প্রযোজ্য ভ্যাট হয়েছে তিন লাখ ৬০ হাজার ১৮২ টাকা। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটি শুধু জানুয়ারি মাসে অ্যাপসের মাধ্যমে খাবার বিক্রির বিপরীতে ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে তিন লাখ ৩১ হাজার ১৮২ টাকা।
একই প্রতিষ্ঠান ফেব্রুয়ারি মাসে বিক্রি করা খাবারের বিপরীতে দাখিলপত্রে ভ্যাট দেখিয়েছে ২৯ হাজার টাকা। অথচ অ্যাপস যাচাই করে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি ফেব্রুয়ারি মাসে যে খাবার বিক্রি করেছে তার বিপরীতে প্রযোজ্য ভ্যাট হয়েছে তিন লাখ এক হাজার ৮৯২ টাকা। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটি ফেব্রুয়ারি ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে দুই লাখ ৭২ হাজার ৮৯২ টাকা।
একই প্রতিষ্ঠান মার্চ মাসে যে খাবার বিক্রি করেছে, তার বিপরীতে রিটার্নে ভ্যাট দেখিয়েছে ৫৯ হাজার ৩২১ টাকা। তবে অ্যাপস যাচাই করে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি মার্চ মাসে যে খাবার বিক্রি করেছে যার বিপরীতে প্রযোজ্য ভ্যাট হয় দুই লাখ ৯৬ হাজার ৪২৬ টাকা। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটি মার্চ মাসে ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে দুই লাখ ৩৭ হাজার ১০৫ টাকা।
প্রতিবেদনে আরও দেখা গেছে, পূর্ব রামপুরার আল কাদেরিয়া ক্যাফে। প্রতিষ্ঠানটি জানুয়ারি মাসে যে খাবার বিক্রি করেছে তার বিপরীতে রিটার্নে ভ্যাট দেখিয়েছে ১৯ হাজার ৩০০ টাকা। তবে অনলাইনে খাবার বিক্রি করা অ্যাপসগুলো যাচাই করে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি জানুয়ারি যে খাবার বিক্রি করেছে তার বিপরীতে প্রযোজ্য ভ্যাট দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার ৭৫৭ টাকা। অর্থাৎ জানুয়ারি মাসে প্রতিষ্ঠানটি ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে ১১ হাজার ৪৫৭ টাকা।
বেইলি রোডের স্ট্রিট ওভেন লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি জানুয়ারি মাসে খাবার বিক্রির বিপরীতে ভ্যাট ৪ হাজার ৩৫০ টাকা, ফেব্রুয়ারি মাসে ৮ হাজার ৪০০ টাকা ও মার্চ মাসে ১০ হাজার ১২০ টাকা দেখিয়েছে। কিন্তু অ্যাপস থেকে এই প্রতিষ্ঠানের খাদ্যপণ্য বিক্রি যাচাই করে দেখা গেছে, জানুয়ারি মাসে খাবার বিক্রির বিপরীতে প্রযোজ্য ভ্যাট ছিল এক লাখ ১৬ হাজার ৬৪৫ টাকা, ফেব্রুয়ারি মাসে এক লাখ ৫ হাজার ৪৫৪ টাকা ও মার্চ মাসে প্রযোজ্য ভ্যাট ছিল ৯৮ হাজার ৬৬৫ টাকা। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠান জানুয়ারি এক লাখ ১২ হাজার ২৯৫ টাকা, ফেব্রুয়ারি মাসে ৯৭ হাজার ৫৪ টাকা ও মার্চ মাসে ৮৮ হাজার ৫৪৫ টাকা ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে।
ধানমন্ডির চিজ রেস্টুরেন্ট। প্রতিষ্ঠানটি মার্চ ও এপ্রিল-এই দুই মাসে যে খাবার বিক্রি করেছে, তার বিপরীতে রিটার্নে ভ্যাট দেখিয়েছে তিন লাখ ৬৫ হাজার ৮১৫ টাকা। তবে ফুডপান্ডা, পাঠাও ফুড, সহজ ফুডসহ অন্যান্য অ্যাপস যাচাই করে দেখা গেছে, রেস্টুরেন্টটি এই দুই মাসে যে খাবার বিক্রি করেছে, তার বিপরীতে প্রযোজ্য ভ্যাট হয় সাত লাখ ৬৬ হাজার ৬১ টাকা। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটি দুই মাসে অ্যাপসে খাবার বিক্রির বিপরীতে চার লাখ ২৪৬ টাকা ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে।
রাজধানীর লালবাগ এলাকার ভূতের বাড়ি রেস্টুরেন্ট। প্রতিষ্ঠানটি মার্চ ও এপ্রিল মাসে যে খাবার বিক্রি করেছে, তার বিপরীতে রিটার্নে ভ্যাট দেখিয়েছে মাত্র ২৭ হাজার ৯৩৩ টাকা। অথচ অ্যাপস যাচাই করে দেখা গেছে, এই প্রতিষ্ঠানের অ্যাপসের মাধ্যমে বিক্রি করা খাবার বিক্রির ওপর প্রযোজ্য ভ্যাট হয় ৫৬ হাজার ৯৫ টাকা। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠান দুই মাসে ২৮ হাজার ১৬২ টাকা ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে।
লালবাগ এলাকার পিৎজা কিং। প্রতিষ্ঠানটি মার্চ ও এপ্রিল মাসে যে খাবার বিক্রি করেছে, তার বিপরীতে রিটার্নে ভ্যাট দেখিয়েছে মাত্র এক লাখ ৭ হাজার ১৭০ টাকা। তবে অ্যাপস যাচাই করে দেখা গেছে, এই প্রতিষ্ঠানের অ্যাপসের মাধ্যমে বিক্রি করা খাবার বিক্রির ওপর প্রযোজ্য ভ্যাট হয়েছে দুই লাখ ৫৬ টাকা। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটি দুই মাসে ৯২ হাজার ৮৮৬ টাকা ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এসব প্রতিষ্ঠান হতে জরিমানাসহ ভ্যাট আদায়ের বিচারিক কার্যক্রম চলমান রয়েছে। সব অনলাইনভিত্তিক খাবার সরবরাহের অ্যাপ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে দাখিলপত্রের সঙ্গে আড়াআড়ি যাচাই করা সম্ভব হলে একদিকে যেমন বিপুল পরিমাণ ভ্যাট ফাঁকি প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে, অন্যদিকে ইএফডি বা এসডিসির মাধ্যমে রাজস্ব আদায় প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হবে।
এ বিষয়ে ভ্যাট ঢাকা দক্ষিণ কমিশনারেটের একজন কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, হোটেল, রেস্তোরাঁসহ যেসব জায়গায় ইএফডি ও এসডিসি স্থাপন করা হয়েছে, তা কঠোরভাবে তদারকি করা হচ্ছে। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠান অনলাইনে খাবার বিক্রির তথ্য ইএফডি, এসডিসিতে দেখাচ্ছে না। এমনকি রিটার্নেও নয়। এতে অনলাইন ফুড সার্ভিস প্রোভাইডার প্রতিষ্ঠানগুলোর যোগসাজশ থাকতে পারে। অনলাইন ফুড সার্ভিস প্রোভাইডার প্রতিষ্ঠানগুলো ভ্যাট ঢাকা উত্তর কমিশনারেটের আওতাধীন। তাদের তথ্য যাচাই করতে উত্তর কমিশনারেটকে চিঠি দেয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে ফুডপান্ডার কাছে লিখিত প্রশ্ন দেয়া হলে ফুডপান্ডার পক্ষ থেকে জানানো হয়, ‘ফুডপান্ডা বাংলাদেশের যথাযথ নিয়ম ও আইন মান্য করে পরিচালিত আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান। আমরা ভ্যাট আইনসহ সব আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। ভ্যাট আইন অনুযায়ী কাস্টমারদের কাছ থেকে প্রাপ্ত টাকা ভ্যাটসহ ফুডপান্ডা রেস্টুরেন্টের কাছে হস্তান্তর করে।’ একই প্রশ্ন পাঠাও ফুড কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হলেও তারা জবাব দেননি।