অনলাইন আসক্তিতে কমছে বইপড়ার অভ্যাস

মাদক দ্রব্যাদির প্রতি আসক্তি সম্পর্কে জানলেও অনেকে অনলাইন গেম সম্পর্কে অনেকেই ওয়াকিবহাল নন। বর্তমানে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে এই আসক্তি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ভিডিও গেমসের প্রতি তীব্র আসক্তিকে বিশেষ ধরনের মানসিক অসুস্থতা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এর নাম দেয়া হয়েছে গেমিং ডিসঅর্ডার।

সাম্প্রতিক এক সমীক্ষা অনুযায়ী সারা পৃথিবীতে প্রতি মাসে এখন প্রায় ২২০ কোটি মানুষ নিয়মিত বা অনিয়মিতভাবে ভিডিও গেমস খেলে থাকে। তাদের অধিকাংশই হচ্ছে অল্প বয়সী কিশোর-কিশোরী বা তরুণ-তরুণী। মূলত তাদের কারণেই গ্লোবাল ভিডিও গেম বাজারের আর্থিক মূল্য দাঁড়িয়েছে ১০৯ দশমিক ৯০ মিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থ উপার্জনকারী সেক্টর হচ্ছে মোবাইল গেমিং। এক্ষেত্রে বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই। দেশের শিশু-কিশোর-তরুণদের ওপর ঢাকার ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগ পরিচালিত জরিপের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২ কোটি ৬০ লাখ ছাত্র-তরুণ নিয়মিত বিভিন্ন অনলাইন গেম খেলে থাকে। অনলাইন গেমের বাজার গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান ‘নিউজুর’-এর তথ্য অনুযায়ী দক্ষিণ এশিয়ায় অনলাইন গেমের বাজারে বাংলাদেশ তৃতীয় স্থানে রয়েছে।

ডিজিটালাইজেশনের কল্যাণে বর্তমানে অনলাইন গেমগুলো এতটাই রিয়েলিস্টিক হয়েছে, অনলাইনেই তারা গড়ে তুলেছে আলাদা একটা জগত। আরেকটা উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে বেশিরভাগ জনপ্রিয় অনলাইন ভিডিও গেমের মূল থিমটা হচ্ছে টিকে থাকার লড়াই, হত্যা, লুটপাট এবং ছিনতাই। যার ফলে এ বিষয়গুলো কিশোর-কিশোরীদের কাছে সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে এটি তাদের সহিংস করে তুলছে। যার ফলে বাড়ছে কিশোর অপরাধ। অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, এভাবে দীর্ঘসময় ধরে ‘ভার্চুয়ালি’ খুন-সন্ত্রাসের মতো ঘটনায় জড়িত থাকায় এসব খেলোয়াড় বাস্তব দুনিয়ায়ও অপরাধ জগতে জড়িয়ে পড়ে। ডেইলি স্টার থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গত ১৬ আগস্ট কক্সবাজার শহরের বইল্যাপাড়া বৌদ্ধবিহার এলাকায় মোবাইল ফোনে গেম খেলাকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের ছুরিকাঘাতে সেজান নামে এক যুবক নিহত হয়েছে। এর আগে ৯ আগস্ট পাবনার সাঁথিয়ায় মোবাইল ফোনে গেম খেলতে না দেয়ায় ছোট ভাই ও বড় বোনকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে জখম করে সৈকত নামে এক যুবক। একই কারণে ৩১ জুলাই চুয়াডাঙ্গার দর্শনায় বন্ধুর বাবাকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে সুজন নামে এক যুবক।

এছাড়া এসব গেমের বিভিন্ন চরিত্র কেনার জন্য উপকরণ (ডায়মন্ড) সহজে বিক্রির জন্য তৈরি হয়েছে একটি মধ্যস্বত্বভোগী চক্র। এরা ফেসবুকে গ্রুপ ও পেজ খুলে বিকাশ এবং নগদের মাধ্যমে এসব উপকরণ বিক্রি করছে। ফলে আর্থিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এসব তরুণ ও তাদের পরিবার। অনেক অল্প বয়সী কিশোর-কিশোরী এসব গেম খেলার জন্য মা-বাবার কাছে মোবাইল ফোনের আবদার করে থাকে এবং বাবা-মা মোবাইল কিনে দিতে অপারগতা জানালে অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে দ্বিধা বোধ করে না। গত মে মাসে বগুড়ার শিবগঞ্জে ফ্রি-ফায়ার গেম খেলার জন্য বাবার কাছে স্মার্টফোনের আবদার করে না পেয়ে আত্মহত্যা করে আখিরুল ইসলাম নামে অষ্টম শ্রেণির ছাত্র।

একটা সময় ছিল যখন তরুণদের অনেকেরই অবসর কাটত বই পড়ে। নতুন বইয়ের ভাঁজ খুলে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উল্টে পড়ার মধ্যে তারা অন্য রকম এক আনন্দ পেত। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে একটা গল্পের বই কিংবা উপন্যাস পড়ে শেষ করার আশায় থাকত। কিন্তু এখন সেই সময়টা কিশোর-কিশোরীরা মগ্ন থাকে মোবাইল ফোনে।

বিকালে যে সময়টা খেলার মাঠে কাটানোর কথা, সে সময় কাটছে অনলাইন ভিডিও গেমে মগ্ন থেকে। সন্ধ্যা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাগরিবের নামাজ পড়ে পড়তে বসার যেই রেওয়াজ ছিল, এখন সে সময়টায় গ্রাম মহল্লায় কিশোরদের দেখা যায় পুলের ওপর কিংবা রাস্তার ধারে বসে অনলাইনে গেম খেলতে। ফলে কমছে বই পড়া। বিভিন্ন ধরনের অনলাইন ভিডিও গেমস এখন শিক্ষিত তরুণ সমাজের দিনরাত্রির সঙ্গী। ফলস্বরূপ মননশীলতা চর্চার অভাবে সুকুমার বৃত্তিগুলো যেন হারিয়ে যেতে বসেছে। কমছে বুদ্ধিভিত্তিক জ্ঞানচর্চাও।

বই মানুষকে চিন্তাশীল করে। নিজের ভিতরের সুপ্ত সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তুলে। শিশু-কিশোরদের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটানোর জন্য বইয়ের বিকল্প নেই। মানুষের মনের উৎকর্ষ লাভের জন্য বই পড়া বাড়াতে হবে। সে জন্য প্রযুক্তির এই অপব্যবহার দূর করতে হবে। আর মনের উৎকর্ষ লাভ হলেই একজন মানুষ মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন প্রকৃত মানবে পরিণত হতে পারে। তাই এখনই আমাদের সচেতন হতে হবে এবং বই পড়া আর পাঠাগার স্থাপনে আগ্রহ বাড়াতে হবে এবং ছোটদেরও উৎসাহিত করতে হবে বেশি বেশি বই পড়তে। পিতা-মাতাদের তাদের সন্তানদের প্রতি আরও সচেতন হতে হবে। তাদের গেমের আসক্তি থেকে বিরত রাখতে হবে এবং তাদের মানসিক ও নৈতিক বিকাশের দিকে গুরুত্ব দিতে হবে।

আলা উদ্দিন আফছার

শিক্ষার্থী, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০