Print Date & Time : 22 June 2025 Sunday 3:34 am

অনলাইন খাদ্য ব্যবসায় শব্দফাঁদ প্রতারণার নতুন কৌশল

মো. বিল্লাল হোসেন: বর্তমান যুগ আধুনিক প্রযুক্তির যুগ। এ যুগে ঘরে বসেই যেকোনো ধরনের পণ্য হাতে পাওয়া সম্ভব। বিশেষত, ইন্টারনেটকে কাজে লাগিয়ে ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম ও বিভিন্ন ওয়েবসাইট ব্যবহার করে সারা বিশ্বে নানা ধরনের পণ্য বিক্রি হচ্ছে। করোনার পর থেকে অনলাইনে পণ্য বিক্রি বেড়েছে বহু গুণ। বিশেষ করে খাদ্যপণ্য বিক্রি বাড়ছে জ্যামিতিক হারে। আমাদের দেশে অনলাইনে খাদ্যদ্রব্য সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় ফেসবুকে। মূলত ফেসবুকে বিভিন্ন পেইজ, আইডি ও গ্রুপের মাধ্যমে প্রায় সব ধরনের খাদ্যপণ্য বিক্রি করা হচ্ছে। যেহেতু ফেসবুকনির্ভর বেচাকেনা (এফ কমার্স) একটি প্রায় নতুন ধারণা, তাই এখনও এফ কমার্সের নানা ধরনের ফাঁক-ফোকর রয়ে গেছে। আর এসব ফাঁক-ফোকরের মধ্য দিয়ে ব্যবসায়ীরা প্রতারণার নতুন নতুন কৌশল তৈরি করছেন। এই প্রতারণা ভোক্তাদের যেমন ক্ষতিগ্রস্ত করছে, তেমনি ব্যবসায়ীরা হচ্ছেন আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ। খাদ্য ব্যবসায় প্রতারণার রয়েছে বিভিন্ন ধরন। এর মধ্যে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে ‘শব্দফাঁদ’ প্রতারণা। ওজনে কম দেয়া কিংবা খাদ্যে ভেজাল দেয়াÑএরকম নানা ধরনের প্রতারণা অনেক আগে থেকেই আমাদের দেশে প্রচলিত। তবে এখন অনলাইন ব্যবসা প্রসারের ফলে শব্দফাঁদের প্রতারণা বেড়েছে সবচেয়ে বেশি।

আসলে এ ধরনের নতুন কৌশলকে শব্দফাঁদ প্রতারণা কেন বলছি তা একটু ব্যাখ্যা করা যাক। মূলত এ ধরনের প্রতারণার ক্ষেত্রে পণ্য বিক্রির সময় বেশ কিছু চটকদার শব্দ বা শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করে ভোক্তাদের প্রতারিত করা হয়। এ ধরনের কয়েকটি শব্দ হলো প্রিমিয়াম, অর্গানিক, হালাল, ১০০ ভাগ খাঁটি, বিষমুক্ত, ন্যাচারাল ও ভেজালমুক্ত ইত্যাদি।

বর্তমান সময়ে ফেসবুকে স্ক্রল করার সময় আমরা দেখতে পাই হাজার হাজার ফেসবুক পেজ কিংবা গ্রুপ যেখানে নানা ধরনের খাদ্যপণ্য বিক্রি করা হচ্ছে। এসব ব্যবসায়ীকে প্রায় সবাই ব্যবসার প্রচার কৌশল হিসেবে এ ধরনের চটকদার শব্দ ব্যবহার করছেন। সাধারণ ভোক্তারাও সচেতনতার ঘাটতির কারণে তাদের এসব চটকদার শব্দের ফাঁদে পড়ছেন। এসব পণ্য কিনে প্রতারিত হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। পত্রিকা খুললেও আমরা এ ধরনের প্রতারণার খবর দেখতে পাই।

আমরা মূলত এসব শব্দ ব্যবহারের কারণে ধরেই নিচ্ছি খাদ্যটি আসলে প্রিমিয়াম কিংবা অর্গানিক। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমাদের দেশে প্রিমিয়াম, অর্গানিক কিংবা শতভাগ বিশুদ্ধ খাবার বাজারে নিয়ে আসা বেশ দুরূহ। এছাড়া এটি ব্যয়বহুলও বটে। কারণ, একটি পণ্যকে অর্গানিক হতে হলে তার উৎপাদন থেকে শুরু করে ভোক্তার হাতে পৌঁছানো পর্যন্ত বিশেষ মান নিশ্চিত করতে হয়। যেমন, এক প্যাকেট মসলাকে অর্গানিক আখ্যা দিতে হলে, তা উৎপাদনে উচ্চফলনশীল জাতের বীজ নয়, বরং দেশি জাত ব্যবহার করতে হবে। জৈব উপাদান ছাড়া কোনো প্রকার রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও প্রিজারভেটিভ দেয়া যাবে না। প্রাকৃতিক বা সহজে পচনশীল উপাদানে তৈরি মোড়কে বাজারজাত করতে হবে। তাহলে, ভেবে দেখুন, একটি পণ্যকে অর্গানিক উপায়ে চাষ, সংরক্ষণ বা বাজারজাতকরণ কতটা কঠিন হতে পারে। এজন্য এ ধরনের পণ্যের দাম সাধারণ পণ্যের তুলনায় অনেক বেশি হয়। সেটা যুক্তিসংগতও বটে। কিন্তু এসব শর্ত না মেনে একেবারেই সাধারণ মানের পণ্যকে অর্গানিক বলে ঘোষণা দিয়ে উচ্চ দাম হাঁকালে তা মেনে নেয়া যায় না। তাছাড়া পণ্যটি যে আসলেই অর্গানিক বা প্রিমিয়ামÑতা প্রমাণ করার দায় মূলত ব্যবসায়ী বা বিক্রেতার। কিন্তু তেমনটা দেখা যায় না বললেই চলে। অবশ্য বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান হয়তো আসলেই প্রিমিয়াম কিংবা অর্গানিক খাবার বাজারজাত করছে। তবে তার সংখ্যা যে খুবই কমÑতা নিশ্চিত।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এমনও দেখা যাবে, যে ব্যবসায়ী অনলাইনে খাদ্যপণ্যের ব্যবসা করছেন এবং তার পণ্যের বাজারজাতকরণ ও প্রসারে প্রিমিয়াম, অর্গানিক, হালাল কিংবা শতভাগ খাঁটি এ ধরনের শব্দ ব্যবহার করছেন, তিনি জানেনই না এ শব্দগুলো প্রকৃত অর্থ কী! অথচ নিজের পণ্যকে হাইলাইট করে বিশেষ আবেদন তৈরির জন্য এসব শব্দ ব্যবহার করছেন। প্রিমিয়াম, অর্গানিক কিংবা শতভাগ খাঁটি খাদ্যপণ্য হতে গেলে কী কী শর্ত মেনে চলতে হয় সেসবের কিছুই জানেন না তারা। বেশিরভাগ অনলাইন খাদ্য ব্যবসায়ীর ক্ষেত্রে এই হলো সাধারণ চিত্র।

সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে তারা এসব শব্দ ব্যবহার করে শব্দ ফাঁদ তৈরি করছে আর সেই ফাঁদেই আমরা পা দিচ্ছি এবং সেসব প্রতারক ব্যবসায়ীর নানা ধরনের খাদ্যপণ্য আমরা কিনে খাচ্ছি। ফলাফলস্বরূপ আমাদের দেহে নানা ধরনের জটিল রোগ দেখা দিচ্ছে কিন্তু আমরা বুঝতে পারছি না।

সাম্প্রতিককালে ফাংশনাল ফুডস (যেসব খাবারে ঔষধি গুণাগুণ আছে) ও নিউট্রাসিউটিক্যালস (যেসব খাবারের পুষ্টি ও ফার্মাসিউটিক্যাল গুণাগুণ আছে)  এর বাজার প্রসারিত হচ্ছে খুব দ্রুত। ফেসবুকে বিভিন্ন পেইজেও নানা ধরনের ফাংশনাল ফুডস ও নিউট্রাসিটিক্যালস জাতীয় খাদ্য বিক্রি হচ্ছে। এমনটি আমরা দেখতে পাই হানি নাটস কিংবা সজিনা পাতার ক্ষেত্রে। শুধু বিক্রেতাদের শব্দ ফাঁদের কৌশলে এই দুটি পণ্য দেদার বিক্রি হচ্ছে অনলাইন মার্কেটে। আর এই সুযোগকে ব্যবহার করে প্রতারণা করছেন অনলাইন ব্যবসায়ীরা।

শব্দফাঁদের বাইরেও আরও এক ধরনের প্রতারণা বাংলাদেশে শুরু হয়েছে এফ কমার্সের ক্ষেত্রে। সেটি হলো প্যাকেজিংয়ের রং পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রতারণা। বিষয়টা একটু জটিল মনে হলেও আসলে খুবই সহজ। বিভিন্ন ধরনের খাদ্য পণ্যে যেসব প্যাকেজিংয়ের জন্য যে মোড়ক ব্যবহার করা হয়, তাতে সবুজ রঙের আধিক্য রাখা হয় এবং মোড়কগুলোকে ইকো ফ্রেন্ডলি তকমা দিয়ে দিচ্ছেন। এ কৌশল বেশ কাজও করছে। ক্রেতারা খুব সহজেই সবুজ রঙের পণ্যের দিকে আকৃষ্ট হন। কেননা সবুজ রং আমাদের চোখের জন্য প্রশান্তিদায়ক। তাছাড়া আমাদের মনে সবুজ রঙের ব্যাপারে একটি পরিবেশগত ইতিবাচক ইমেজ আছে। ফলে নিম্নমানের খাদ্যপণ্যকে সবুজ রঙের জার কিংবা প্যাকেটে বাজারজাত করে ‘ইকো ফ্রেন্ডলি’ ট্যাগ দিয়ে কোটি কোটি টাকা মুনাফা তৈরি করছেন অনেক ব্যবসায়ী। ব্যাপারটি আপাতদৃষ্টিতে খুব ক্ষুদ্র মনে হলেও এটি আসলে ব্যবসায়ীদের জন্য বিশাল একটি মওকা।

এভাবে অনলাইন খাদ্য ব্যবসায়ীরা আমাদের মতো সাধারণ ভোক্তাদের অসচেতনতা কিংবা অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে প্রতারণা করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। এ প্রতারণার হার দিন দিন বেড়েই চলেছে। কারণ অনলাইন নির্ভর খাদ্য ব্যবসার জন্য আমাদের দেশে নির্দিষ্ট কোনো সরকারি নীতিমালা নেই কিংবা আইন নেই যার মাধ্যমে এসব ব্যবসাকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আবার যেটুকু নীতিমালা আছে সেটা মানতে নারাজ এসব অনলাইন খাদ্য ব্যবসায়ীরা।

তাই কর্তৃপক্ষের উচিত ভোক্তার অধিকার সুরক্ষায় অনলাইন ব্যবসা, বিশেষত খাদ্য ব্যবসার জন্য নির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন ও এর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা। এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনস, বাংলাদেশ ফলিত পুষ্টি ও গবেষণা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর প্রভৃতি। সরকারের সব সংস্থা ও জনগণ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করলে সুফল আসবেই। নিশ্চিত হবে নিরাপদ খাদ্য।

তাই আমাদের সবার উচিত শব্দ ফাঁদের বিরুদ্ধে সজাগ হওয়া। কেমন দামে কেমন মানের পণ্য পাচ্ছিÑভোক্তা ও ক্রেতা হিসেবে তা বুঝে নেয়ার দায়িত্ব আমাদেরই। তাহলে অসাধু ব্যবসায়ীরা চটকদার শব্দ ব্যবহার করে খাদ্যপণ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের মান নিয়ে প্রতারণা করতে পারবে না। সুস্থ ও নিরাপদ জীবনযাপনের জন্য গাল ভরা বাহারি বিশেষণে বিভ্রান্ত না হয়ে সচেতন হতে হবে।

প্রভাষক

খাদ্য প্রকৌশল ও প্রযুক্তিবিদ্যা বিভাগ

স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ