রিফাত হোসেন: ফোবিয়া হলো এক ধরনের ভয় বা মানসিক অবস্থা, যা অতি সামান্য বিষয়েও যে কারও মধ্যে থাকতে পারে। আমাদের অনেকে তেলাপোকা দেখলে ভয় পায়। এতে সাধারণত আমাদের দৈনন্দিন স্বাভাবিক কাজের মধ্যে ব্যাঘাত ঘটে। আবার অনেকে অন্ধকারে চলার সময় আচমকা মানুষ দেখলে ভয়ে কাতরাতে থাকে।
ফোবিয়া অনেকের জন্মগতভাবে থাকে। বেশিরভাগ ফোবিয়াই জন্মগত নয়। কোনো বিষয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ার বা ভয় পাওয়ার পেছনে অতীতের কোনো ঘটনা নিশ্চিতভাবে জড়িত থাকে। যে জিনিসটাকে মানুষ ভয় পায়, তার সঙ্গে অতীতের কোনো ঘটনার সঙ্গে মিলিয়ে সে এক ধরনের মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে পড়ে। আর সেই মানসিক যন্ত্রণা থেকে তৈরি হওয়া আতঙ্ককে ফোবিয়া বলে।
মানুষের আচরণ ও অবস্থার ওপর ভিত্তি করে ফোবিয়ার ধরনে ভিন্নতা থাকে। হাইড্রোফোবিয়া, ট্রাইফোবিয়া, হিমোফোবিয়া, জেনোফোবিয়া, অ্যাগ্রোফোবিয়া, মনোফোবিয়া, রক্তভীতি, তেলাপোকাভীতি, ইনজেকশনভীতি ও একাকিত্বভীতি হলো উল্লেখযোগ্য কিছু ফোবিয়া। এই ফোবিয়াগুলো কমবেশি সব মানুষের মাঝেই বিদ্যমান থাকে।
মনোফোবিয়ার আদলে বর্তমানে একাকিত্বভীতি একটি চরম পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। একাকিত্ব হলো নীরব ঘাতকের মতো। একাকিত্ব নামক এই ঘাতকের ছোঁয়া কমবেশি সবারই থাকে। কিন্তু যখন একাকিত্বের ছোঁয়া দীর্ঘস্থায়ী হয়, তখন শুরু হয় বিষণœতা, হতাশা, অস্বস্তিবোধ ও সংকোচবোধের মতো মানসিক ও শারীরিক অবস্থা, যা মানুষকে দিন দিন একঘেয়েমির দিকে নিয়ে যায়।
একসময় এই মানসিক অবস্থাগুলো দীর্ঘস্থায়ী হয়। শ্বাসকষ্ট, বুকে চাপ অনুভব, হাত-পা ব্যথা, মাথা ঘোরা, বমি-বমি ভাব প্রভৃতি শারীরিক অসুস্থতা দেখা দেয়। বাহ্যিকভাবে অনেক সময় একাকিত্বে ভোগা মানুষ শারীরিকভাবে অসুস্থ হয় না। শারীরিকভাবে নিরাপদ বোধ করলেও মানসিকভাবে ঠিকই তারা ভয়ের মধ্যে থাকে।
নীরব ঘাতক ফোবিয়া থেকে বাঁচতে মানুষ আজকাল বেছে নিচ্ছে অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমকে ব্যবহার করে মানুষ একাকিত্ব ঘোচানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ততার অভাবে মনোফোবিয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে একাকিত্বকে মোচন করা সব মানুষের পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছে না। এর প্রভাব এবং একই সঙ্গে অনলাইন ফোবিয়ার দীর্ঘস্থায়ী প্রভাবÑএই দুইয়ে মিলে মানুষ চরম বিষাদ ও বিষন্নতায় ভুগছে। একসময় এই বিষন্নতা রূপ নিচ্ছে আত্মহত্যার মতো ভয়ংকর অবস্থায়।
অনলাইন-নির্ভরতা একাকিত্বকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। অটোফোবিয়া বা মনোফোবিয়ার প্রভাবে মানুষ যতই একাকিত্ব ঘোচানোর চেষ্টায় অনলাইন-নির্ভরতা বাড়াচ্ছে, ততই একাকিত্ব আরও খোলস পাল্টাচ্ছে। তাই একাকিত্ব দূর করার জন্য সবার আগে আমাদের অনলাইন-নির্ভরতা কমিয়ে আনতে হবে।
জরিপে দেখা গেছে, কভিডকালে ঘরে থাকার কারণে মানুষের অনলাইন-নির্ভরতা সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এই করোনাকালে মানুষের আত্মহত্যার পেছনে কারণ হিসেবে দেখা যায় সবচেয়ে বেশি মানুষ আত্মহত্যা করেছে বিষন্নতা ও একাকিত্বের কারণে। অনলাইন বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম-নির্ভরতা থেকে মানুষ এখনও পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে পারেনি। ফলে একাকিত্বের পিছুটান মানুষকে ছাড়ছে না।
অনলাইন-নির্ভরতা কমিয়ে আনা ছাড়াও একাকিত্ব দূর করার জন্য কিছু পন্থা রয়েছে। যেমনÑক. নিজেকে জানতে হবে। ভীতিকে কাছে না এনে আগে নিজেকে নিয়ে একটু ভাবতে হবে। আপন সত্তা নিয়ে ভাবলে যেকোনো সমস্যাই সমাধান করা যায়; খ. খেলাধুলা করতে হবে। একাকিত্ব কমিয়ে আনার জন্য অনলাইন-নির্ভরতা কমিয়ে খেলাধুলার প্রতি একটু মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। একই সঙ্গে ব্যায়ামও করা যায়, যা রাগ, দুঃখ ও হতাশাকে কমিয়ে দেবে; গ. বাড়তি চাপ না নেয়া। ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে পারিবারিক দ্বন্দ্ব-কলহ প্রভৃতির বাড়তি চাপ না নেয়া; ঘ. নিজের শখ লালন করা। বিষন্নতা ও হতাশা থেকে বাঁচতে প্রয়োজন নিজের যা শখ রয়েছে, তা লালন করা। এজন্য বাগান করা বা সাইক্লিং করা যায়; ঙ. প্রকৃতির সঙ্গে সময় কাটানো। সমুদ্র, পাহাড় বা ধারেকাছের কোনো পার্কে যেকোনো জায়গায় ঘুরে আসতে পারেন। এটি আপনার একাকিত্ব দূর করতে কাজ করবে; চ. পরিবার বা বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে অনুভূতি ভাগাভাগি করা। মনকে হালকা করতে প্রয়োজন পরিবার, আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুদের সঙ্গে নিজের অনুভূতি শেয়ার করা। এতে একাকিত্বের বোঝা হালকা হয়।
ফোবিয়ায় আক্রান্ত বা একাকিত্বে থাকা ব্যক্তির জন্য উপায়গুলো অর্থহীনও বটে, যদি তার পরিবার, সমাজ বা বন্ধুবান্ধব ওই ব্যক্তিকে সময় বা সাপোর্ট না দেয়। পরিবার ও বন্ধুবান্ধবের মধ্যে শুধু অনলাইন বা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে খবরাখবর নেয়ার মাধ্যমে যোগাযোগ সীমাবদ্ধ থাকলে হবে না। নিকটাত্মীয়দের উচিত তাদের পরিবারের সবাইকে একান্তে সময় দেয়া এবং তাদের সঙ্গে কথোপকথন ধারাবাহিকভাবে বজায় রাখা। প্রত্যেকের উদারপন্থি মনমানসিকতা এই কাজকে আরও অনেক সহজ করে দেবে।
আত্মহত্যার মতো ঘৃণ্য কাজ কখনও মানুষের সর্বময় সমাধান হতে পারে না। আবার আত্মহত্যার জন্য দায়ী মনোফোবিয়া বা একাকিত্বের মতো অবস্থাকে আমাদের পরিহার করাও দরকার। আর এই অবস্থাকে পরিহার করতে প্রয়োজন সম্মিলিত সহযোগিতা।
শিক্ষার্থী, সমাজতত্ত্ব বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়