মো. রফিকুল ইসলাম: রোমান রোহিঙ্গা শিশু। বয়স মাত্র সাড়ে পাঁচ। জগতের ভালো-মন্দ কোনো কিছু বোঝার আগেই মিয়ানমারে মা-বাবাকে হারিয়ে এখন সে অনাথ। দেশটির সেনাবাহিনী গত ২৪ আগস্ট মংডুর নাকপুরা বাজারে প্রথমে তার বাবা মোহাম্মদ রফিককে গুলি করে হত্যা করে। কোরবানির ঈদের আগে সেনাবাহিনীর হাতে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা যান মা ইয়াছমিনও। এরপর ৭০ বছরের বৃদ্ধা নানি ছিরিলুক বেগমের সঙ্গে পাড়ি জমায় বাংলাদেশে। ১০ দিন পায়ে হেঁটে না খেয়ে বাংলাদেশের উখিয়ার কুতুপালংয়ে একটি তাঁবুতে আশ্রয় নেয় রোমান।
ওই তাঁবুতে কথা হয় রোমানের নানীর সঙ্গে। এ সময় বস্ত্রহীন শীর্ণ শরীরে পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল অনাথ রোমান। তার চোখে-মুখে ভাবান্তর নেই। নাম জানতে চাইলে সে মৃদু হাসে। নানী ছিরিলুক বললেন, ‘ও (রোমান) ভালো করে কথা বলতে পারে না। এখন অনেকটা বোবা হয়ে গেছে। ইশারা-ইঙ্গিতে প্রায় সময় মায়ের কথা বলে। বাবার কথাও জানতে চায়। কিন্তু আমরা সঠিক করে তাকে কোনো কথা বলি না। বানিয়ে মিথ্যা কথা বলতে হয়। এতে সে কিছুটা আশ্বস্ত হয়।’
এ অবস্থা শুধু রোমানের নয়, তার মতো হাজার হাজার রোহিঙ্গা শিশু ও কিশোর আজ ভাগ্যহত হয়ে এতিম বা অনাথ হয়েছে। তারা মিয়ানমার সেনাবাহিনী, বিজিপি ও সেখানকার স্থানীয় মগ-চাকমাদের নৃশংসতার শিকার হয়ে মা-বাবা ও স্বজনদের চিরতরে হারিয়ে অনাথ পরিচয় ধারণ করেছে। তবে আশার কথা বাংলাদেশ সরকার মিয়ানমারের এসব অনাথ শিশুকে খুঁজে বের করে তালিকা তৈরির কাজ শুরু করেছে। এরই মধ্যে সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ঐকান্তিক সদিচ্ছায় সমাজসেবা অধিদপ্তর, কক্সবাজার জেলা কার্যালয়ের পক্ষ থেকে উখিয়া-টেকনাফ ও নাইক্ষ্যংছড়ির বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের তাঁবুতে গিয়ে এসব অনাথ শিশুর তালিকা তৈরি করছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই অনাথ শিশুদের জন্য উখিয়াতে ২০০ একর জায়গায় পৃথক একটি শিশুপল্লি গড়ে তোলার নির্দেশ দিয়েছেন, যেখানে দেশে ফিরিয়ে না নেয়া পর্যন্ত অত্যন্ত আনন্দময় পরিবেশে এসব শিশুর জন্য খেলাধুলা, পড়ালেখা ও থাকা-খাওয়ার সুযোগ থাকবে।
জানা গেছে, এতিম রোহিঙ্গা শিশুদের তালিকা তৈরির কাজ শুর করে জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তর। বাবা-মাহীন অনাথ শিশুর তালিকা তৈরি করা হয়েছে, যাদের মধ্যে এক হাজার ২৯৪ জনের ছবিসহ ডেটা এন্ট্রি করা হয়েছে। সমাজসেবা অধিদপ্তরের ৯০ কর্মী মাঠপর্যায়ে তাঁবুতে তাঁবুতে গিয়ে এ ধরনের শিশুদের তথ্য সংগ্রহের কাজ করছেন, যাদের পেছনে রয়েছে ১০-১২ জনের একটি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার দল। অনাথ শিশুদের মুখে ভবিষ্যতে হাসি ফোটানোর জন্য তারা দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। সমাজসেবা অধিদপ্তর, কক্সবাজার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রস্তাবিত শিশুপল্লির বর্তমান অগ্রগতি ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। এতে সমাজসেবা অধিদপ্তর চলমান কাজের অগ্রগতি তুলে ধরবে। রোহিঙ্গা এতিম শিশুদের তালিকা প্রণয়ন ও শিশুপল্লি গড়ে তোলা প্রসঙ্গে সমাজসেবা অধিদপ্তর, কক্সবাজারের সহকারী পরিচালক মো. ফরিদুল আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন এতিম রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য দ্রুত একটি শিশুপল্লি গড়ে তুলবে সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই এই উদ্যোগের খোঁজখবর নিচ্ছেন। অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন আমাদের সব কর্মী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। কুতুপালং ব্লক ডি এ ইউনিসেফের একটি স্কুলে দেখা গেছে, পাঁচটি শ্রেণিকক্ষে অন্তত দেড় শতাধিক রোহিঙ্গা শিশুকে পড়ানো হচ্ছে। তাদের অনেকেই বাবা-মা হারিয়েছে মিয়ানমারে। আবার কেউ কেউ ভাই-বোনসহ পরিবারের অন্য স্বজনদের হারিয়েছে। ইউনিসেফ শিশুদের মিয়ানমারের সিলেবাসে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার বই পড়াচ্ছে। এ ছাড়া ইংরেজি, অঙ্কসহ চিত্রাঙ্কনও করানো হচ্ছে। ছড়ায় ছড়ায় মিয়ানমারের ভাষায় শারীরিক শিক্ষাও দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশকারী মিয়ানমার থেকে আগত শরণার্থীদের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতার অন্ত নেই। আগত শরণার্থীদের বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে নিবন্ধন, সাময়িকভাবে আশ্রয় ব্যবস্থা, রোগীদের জন্য মেডিকেল সার্ভিস, গর্ভবতী মায়েদের জন্য মাতৃত্বকালীন সেবা, জন্ম বিরতিকরণ নানা উপকরণ, সাময়িকভাবে বসবাসের (তাঁবু, বাঁশ, ত্রিপল) নির্মাণসামগ্রী প্রদান, ওষুধ সরবরাহ এবং স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখার ব্যবস্থা করেছে সরকার। মিয়ানমার কর্তৃক নির্যাতিত নাগরিকরা পালিয়ে আসার সময় অনেক মা-বাবা হারিয়েছে তাদের সন্তান। আবার অনেকের মা বেঁচে নেই, অথবা মা-বাবা কেউই বেঁচে নেই। এসব এতিম শিশু জীবনে চলার পথে যাতে পথভ্রষ্ট না হয়, সেজন্য সরকার এ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এতে শিশুরা তাদের মা-বাবাকে হয়তো ফিরে পাবে না, কিন্তু অভিবাবক হিসেবে তো কাউকে পাবে। জীবনে চলার কণ্টকময় পথ কিছুটা হলেও সুগম হবে। সরকারের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে দেশবাসী ।
কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে অবস্থান নেয়া রোহিঙ্গা এতিম শিশুদের জন্য গড়ে তোলা হচ্ছে শিশুপল্লি। এরই মধ্যে এই প্রকল্পের কাজ শুরু করেছে সরকার। এই প্রকল্পের আওতায় প্রথমে ছয় হাজার এতিম শিশুর পুনর্বাসন করা হবে। মানবিকতার অনন্য দৃষ্টান্ত হিসাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে এরই মধ্যে কাজও শুরু করেছে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। সরেজমিনে গিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মিয়ানমারে অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা মা-বাবার হারানো এতিম শিশুদের পুনর্বাসনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রচেষ্টায় সম্প্রতি একটি মহৎ প্রকল্প হাতে নেয় সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়।
শরণার্থীদের পুনর্বাসন এবং ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম সমন্বয়ের জন্য ১৪ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নিয়মিত বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মুখ্য সচিব মন্ত্রিসভার ১৭নং সিদ্ধান্তে এতিম রোহিঙ্গা শিশুদের তালিকা প্রণয়ন ও কল্যাণ নিশ্চিতের লক্ষ্যে সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের নিয়ে টিম গঠন করেন। এ টিম শিশুদের নিবন্ধনের কাজ করছে।
শেখ রাসেল শিশু প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের আলোকে গড়ে তোলা হবে এ রোহিঙ্গা এতিম শিশুপল্লি বাস্তবায়নের প্রকল্পটিও। এই প্রকল্পের কাজে নিয়োজিত এক কর্মকর্তার মাধ্যমে জানা যায়, টেকনাফ এবং উখিয়ার বিভিন্ন পয়েন্টে এতিম রোহিঙ্গা শিশুদের তথ্য সংগ্রহ চলছে। তথ্য সংগ্রহের পর এতিম শিশুদের ডেটা এন্ট্রি করা হচ্ছে। কক্সবাজারে শেখ রাসেল শিশু প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের উপপরিচালক জেসমিন আক্তার জানান, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে সমাজসেবা অধিদপ্তর এবং শেখ রাসেল শিশু প্রশিক্ষণ ও শিশু পুর্নবাসন কেন্দ্রের ৯০ কর্মকর্তা-কর্মচারী এ রোহিঙ্গা শিশুপল্লি বাস্তবায়নের কাজ করছেন। এতিম শিশুদের শনাক্ত করার পর তাদের তথ্য নিবন্ধন করা হচ্ছে। তথ্য সংগ্রহ ও নিবন্ধন শেষে নিবন্ধিত শিশুরা স্মার্ট কার্ড পাবে। ওই স্মার্ট কার্ডের মাধ্যমে তাদের ত্রাণ কার্যক্রম, আবার স্বদেশে ফিরে যাওয়াসহ সার্বিক কার্যক্রম পরিচালিত হবে।
শরণার্থীদের জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে উখিয়া মৌজার যে দুই হাজার একর জায়গার কথা বলা হচ্ছে, সেখান থেকে ২০০ একর জায়গায় এতিম রোহিঙ্গা শিশুদের পুনর্বাসনে আলাদা শিশুপল্লি গড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এরই মধ্যে জায়গা চিহ্নিতকরণে প্রশাসন কাজ করছে। প্রাথমিক পর্যায় শেখ রাসেল শিশু প্রশিক্ষণ পুনর্বাসন কেন্দ্রের সঙ্গে ছয় হাজার শিশুকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। ওই শিশুপল্লিতে ছয় হাজার শিশুর আবাসনসহ নানা ধরনের সুবিধা থাকবে। সরকারের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম হবে এতিম রোহিঙ্গা শিশুদের তথ্য সংগ্রহ এবং মানবিক বিবেচনায় তাদের পুনর্বাসন নিশ্চিত করা। কোনো দাতা সংস্থা নয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে মানবিক বিবেচনায় এ কাজ হচ্ছে। এটি নির্মিত হলে এতিম শিশুরা সুরক্ষার আওতায় আসবে।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় যেসব কাজ করছে, তার মধ্যে পরিত্যক্ত শিশু, পথশিশু, নির্যাতিত শিশু, গৃহকর্মে নিয়োজিত শিশু, বাল্যবিয়ের শিকার, পাচার থেকে উদ্ধারকৃত, এতিম শিশু, বাবা-মায়ের তত্ত্বাবধানহীন মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধী শিশুদের পুনর্বাসনে বহুমুখী কার্যক্রম চালাচ্ছে, যা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বহির্বিশ্বে সুনাম কুড়িয়েছে। মিয়ানমারে নির্যাতিত হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা বাবা-মাহীন ছয় হাজার শিশুর পুনর্বাসনের জন্য গৃহীত এ কার্যক্রম নিঃসন্দেহে একটি উদার মানবিকতার দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
এছাড়া সমাজের অবহেলিত আর নির্যাতিত মা ও শিশুদের নিরাপদ জায়গা গাজীপুরের মাওনার ‘শিশুপল্লি প্লাস’, যেখানে মায়ের সান্নিধ্যে থেকেই শিশুরা খেলছে, পড়ছে, পাশাপাশি মায়েরাও শিখছেন নানা কাজ। অসহায় মা আর শিশুদের দুঃখ দেখে ২৮ বছর আগে এ শিশুপল্লি প্রতিষ্ঠা করেন ইংল্যান্ডের নাগরিক প্যাট্রিসিয়া কর। বর্তমানে ১৫০ মা আর ৩৫০ শিশুর বসবাস এই শিশুপল্লি যেন পল্লিশিশুদের স্বর্গরাজ্য। হাসিমুখের এসব শিশুকে দেখে বোঝার উপায় নেই কিছুদিন আগেও তাদের জীবন ছিল বিভীষিকাময়।
এসব শিশুর কেউ পিতৃহারা, কারও মা সংসার থেকে বিতাড়িত, কিংবা তালাকপ্রাপ্ত, অথবা কোনো কোনো শিশু ছিল অনাকাক্সিক্ষত। সমাজ যখন তাদের ঠাঁই দেয়নি, কিংবা বেঁচে থাকতে একবেলা খাবার দিতে পারেনি, তখন তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে শিশুপল্লি প্লাস, বাড়িয়ে দিয়েছে ভালোবাসার দুহাত। এই পল্লিই দেশের একমাত্র জায়গা, যেখানে দুস্থ শিশুরা বিনা খরচে মায়ের সান্নিধ্যে বেড়ে ওঠে। টানা তিন বছর এখানে থাকতে পারেন মা ও শিশুরা। মায়েদের দেয়া হয় হাতের কাজ, মুড়ি ভাজা, বিউটি পার্লারসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণ। ফিরে গিয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য দেয়া হয় আর্থিক সহযোগিতাও। শিশুপল্লি প্লাসের প্রতিষ্ঠাতা ইংল্যান্ডের নাগরিক প্যাট্রিসিয়া কর ছিলেন এয়ারহোস্টেস। পরে চাকরি ছেড়ে দিয়ে জীবনের পুরোটা সময় পার করছেন সুবিধাবঞ্চিত এসব শিশুকে নিয়ে। ১৯৮৯ সালে গাজীপুরের মাওনায় প্রতিষ্ঠা করেন শিশুপল্লিটি। ব্যক্তিজীবনে নিঃসন্তান মমতাময়ী প্যট্রিসিয়া এখন পল্লির সবার প্যাট মম। যুক্তরাজ্যের একটি দাতা সংস্থার সহযোগিতায় পরিচালিত প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান জায়গা ১৭ একর। শিশুপল্লিকে নিয়ে কী স্বপ্ন তার এমন প্রশ্নে প্যট্রিসিয়া আধো আধো বাংলায় বলেন, শিশুদের প্রতি ভালোবাসা ছাড়া আর কোনো স্বপ্ন নেই তার।
পৃথিবীর সব শিশু বেড়ে উঠুক মমতায়। পৃথিবীর সব শিশু বেঁচে থাকুক নিরাপদে। তাদের চাঁদমুখে হাসি থাকুক অমলিন। ভালোবাসায় ভরা পৃথিবী হোক তাদের, আর এ অঙ্গীকারেই সবার সহযোগিতার হাত বাড়ানো থাকুক।
পিআইডি নিবন্ধ