Print Date & Time : 19 June 2025 Thursday 7:28 pm

অনাদায়ী শুল্ককর ৬৪ কোটি টাকা বাতিল হচ্ছে বিশেষ বন্ড সুবিধা

রহমত রহমান: পুঁজিবাজারে প্রকৌশল খাতের তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান গোল্ডেন সন লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে বন্ড সুবিধার অপব্যবহারের শেষ নেই। অনিয়মের মামলা জমেছে পাহাড়সম। সর্বশেষ ৩৪টি মামলার রেকর্ড হয়েছে, যাতে জড়িত রাজস্ব প্রায় সাড়ে ৬৫ কোটি টাকা। অপব্যবহারের অভিযোগে একবার প্রতিষ্ঠানটির বন্ড লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছিল। কিন্তু অনিয়ম বন্ধ হয়নি।

এদিকে সুপারভাইজড বন্ড প্রথা ২০০২ সালে বাতিল হলেও প্রতিষ্ঠানটি এ সুবিধা পেয়ে আসছে। অবশেষে প্রতিষ্ঠানটির সুপারভাইজড বন্ড সুবিধা বাতিল এবং বকেয়া রাজস্ব আদায়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে সম্প্রতি এনবিআর থেকে চট্টগ্রাম কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটকে চিঠি দেয়া হয়েছে। তবে প্রতিষ্ঠান থেকে দাবি করা হয়েছে, এই প্রতিষ্ঠান একজন কাস্টমস কর্মকর্তার আক্রোশের শিকার এবং অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি করা হয়েছে।

চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি বন্ড কমিশনারেটকে দেয়া এনবিআরের চিঠিতে বলা হয়, ২০২১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর এনবিআর চেয়ারম্যানের সভাপতিত্বে এবং ২০ সেপ্টেম্বর সদস্যের (কাস্টমস: রপ্তানি ও বন্ড) সভাপতিত্বে এ-সংক্রান্ত দুটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সিদ্ধান্ত সুপারভাইজড বন্ড সুবিধা বাতিল ও বকেয়া শুল্ককর আদায়ের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। এতে বলা হয়, যেহেতু ২০০২ সালের সংশোধিত অর্থ আইনে সুপারভাইজড বন্ড-সংক্রান্ত আইনের ধারা তথা কাস্টমস আইন, ১৯৬৯-এর ধারা ১১৭ ও ১১৭-এ বিলুপ্ত করা হয়েছে। সেহেতু নতুন কোনো প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে সুপারভাইজড বন্ড ইস্যু করা হবে না। কোনো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শুল্ক ফাঁকির মামলা বা নিরঙ্কুশ বকেয়া পাওয়া না থাকলে, সেই প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে অনুমোদিত সুপারভাইজড বন্ড সুবিধা বাতিল করা হবে।

এনবিআর সূত্রমতে, গোল্ডেন সন লিমিটেডের বিরুদ্ধে মামলা ও বকেয়া রাজস্ব বিষয়ে ২০২১ সালের ৬ অক্টোবর চট্টগ্রাম বন্ড কমিশনারেট এনবিআরকে অবহিত করে চিঠি দেয়। সেই চিঠিতে বলা হয়, চট্টগ্রাম বন্ড কমিশনারেটের আওতাধীন আজিমপাড়া কর্ণফুলী এলাকার বন্ডেড প্রতিষ্ঠান মেসার্স গোল্ডেন সন লিমিটেড সুপারভাইজড বন্ড পদ্ধতিতে পরিচালিত হচ্ছে। এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মোট ৩৪টি রাজস্ব ফাঁকির মামলা দায়ের করা হয়েছে। এসব মামলায় জড়িত রাজস্ব ৬৫ কোটি ৫১ লাখ ৭ হাজার ৯৪৬ টাকা। এর মধ্যে এক কোটি ৬৫ লাখ ১ হাজার ৭৮৫ টাকা প্রতিষ্ঠান  পরিশোধ করেছে। বাকি ৬৩ কোটি ৮৬ লাখ ৬ হাজার ১৯০ টাকা অনাদায়ী রয়েছে।

বন্ড কমিশনারেটের সেই চিঠিতে আরও বলা হয়, ২০১৫ সালে কাঁচামাল খোলাবাজারে বিক্রিতে শুল্ক গোয়েন্দার একটি মামলায় অর্থদণ্ডসহ শুল্ককর প্রায় ৯ লাখ ১৯ হাজার টাকা, ২০১৬ সালে কাঁচামাল খোলাবাজারে বিক্রিতে শুল্ক গোয়েন্দার অপর একটি মামলায় অর্থদণ্ডসহ প্রায় ৩২ লাখ ৫৬ হাজার টাকার রাজস্ব জড়িত। দুটি মামলা প্রতিষ্ঠান রাজস্ব পরিশোধ করেছে। ২০১৪ সালে বন্ড কমিশনারেটের ৫০ হাজার টাকার অর্থদণ্ডের একটি মামলা কমিশনারেটে বিচারাধীন। ২০১৫ সালে বন্ড গুদাম হতে কাঁচামাল অবৈধ অপসারণে প্রযোজ্য প্রায় এক কোটি ৭৪ লাখ টাকা একটি মামলা করে কমিশনারেট, যা বিচারাদেশ শেষে প্রতিষ্ঠানটি পরিশোধ করেছে। ২০১৫ সালে অনিয়মের অভিযোগে ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড দেয়া হলে বিচারাদেশ শেষে প্রতিষ্ঠান তা পরিশোধ করেছে।

২০১৬ সালে বন্ডিং মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়া পণ্যে প্রায় এক লাখ টাকার মামলা করে কমিশনারেট, যা প্রতিষ্ঠান পরিশোধ করেছে। ২০১৭ সালে দুবার ইউপি ব্যতীত কাঁচামাল ব্যবহার করায় পৃথকভাবে ২০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড দেয়া হয়, যা প্রতিষ্ঠান পরিশোধ করেছে। ২০১৮ সালে কাঁচামাল খোলাবাজারে বিক্রিতে শুল্ক গোয়েন্দা প্রায় ৫৬ হাজার টাকা মামলা করেছে, যা প্রতিষ্ঠান পরিশোধ করেছে। ২০১৯ সালে বন্ড রেজিস্টার ও গুদামে কাঁচামালের গরমিলের অভিযোগে প্রায় ৩৯ লাখ টাকার মামলা ও এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড দেয়া হয়, যা প্রতিষ্ঠান পরিশোধ করেছে।

বন্ড কমিশনারেটের চিঠিতে বলা হয়, ২০১৪ সালে বন্ড কমিশনারেট প্রায় ৪৪ কোটি অনিয়মের অভিযোগে মামলা করে। যাতে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানটি ছয়টি ইনজেকশন মোল্ডিং মেশিনের প্রকৃত উৎপাদন ক্ষমতা গোপন করে অতিরিক্ত প্রাপ্যতা নিয়ে এই রাজস্ব অনিয়ম করেছে। মামলা কমিশনারেটে বিচারাধীন। ২০১৯ সালে বন্ডিং মেয়াদের মধ্যে রপ্তানি না করায় প্রায় ২৭ লাখ ৮১ হাজার টাকা অনিয়মের মামলা করে কমিশনারেট। একই অভিযোগে ২০১৯ সালে অর্থদণ্ডসহ প্রায় ৭ কোটি ৯ লাখ টাকা অনিয়মের অভিযোগে মামলা করা হয়। মামলাটি উচ্চ আদালতে বিচারাধীন। একই অভিযোগে প্রায় ৪৭ লাখ ৪৯ হাজার টাকা অনিয়মে মামলা করা হয়, যাতে ১০ লাখ টাকা প্রতিষ্ঠান পরিশোধ করেছে। ২০১৬ সালে পণ্য খোলাবাজারে বিক্রির সময় কাঁচামাল আটক করে প্রায় ১৫ লাখ ৬৮ হাজার টাকা, দেড় লাখ টাকা অর্থদণ্ড দিয়ে মামলা করে শুল্ক গোয়েন্দা। মামলা আপিলাত ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন।

আরও বলা হয়, ২০১৬ সালে কমিশনারেট পৃথকভাবে অবৈধভাবে কাঁচামাল অপসারণের অভিযোগে প্রায় ১০ কোটি ৪৪ লাখ টাকা ও প্রায় দুই কোটি ৮৫ লাখ টাকা, ৩০ কোটি টাকা অর্থদণ্ডের মামলা করে। মামলাটি আপিলাত ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন। ২০১৭ সালে অবৈধভাবে অপসারণে ৭ কোটি টাকা ও ২০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড মামলা হয়েছে, যা ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন। একই বছর একই অভিযোগে প্রায় ৩ কোটি ১৬ লাখ ও ৫ কোটি টাকা অর্থদণ্ড দেয় কমিশনারেট, মামলাটি ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন। ২০২০ সালে কাঁচামাল খোলাবাজারে বিক্রির সময় শুল্ক গোয়েন্দা পণ্য আটক করে প্রায় ৪৯ লাখ ৩৬ হাজার টাকার মামলা দেয়, মামলাটি ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন। একই বছর কমিশনারেট রপ্তানির বিপরীতে বৈদেশিক মুদ্রার পরিবর্তে বাংলাদেশি মুদ্রায় রপ্তানিমূল্য প্রত্যাবাসিত হওয়ায় প্রায় ২১ লাখ ৮১ হাজার টাকা ও ৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড দেয়া হয়। মামলাটি ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন। এছাড়া অনিয়মের ১৪টি মামলা উচ্চ আদালতে বিচারাধীন। যাতে জড়িত রাজস্ব প্রায় তিন কোটি ৮৯ লাখ টাকা।

বন্ড কমিশনারেটের সেই চিঠির বিষয়টি তুলে ধরে এনবিআরের চিঠিতে বলা হয়, চট্টগ্রাম বন্ড কমিশনারেটের আওতাধীন আজিমপাড়া কর্ণফুলী এলাকার বন্ডেড প্রতিষ্ঠান মেসার্স গোল্ডেন সন লিমিটেড সুপারভাইজড বন্ড পদ্ধতিতে পরিচালিত হচ্ছে। এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মোট ৩৪টি রাজস্ব ফাঁকির মামলা চলমান রয়েছে, যাতে জড়িত রাজস্ব ৬৫ কোটি ৫১ লাখ ৭ হাজার ৯৪৬ টাকা। এই বকেয়ার মধ্যে এক কোটি ৬৫ লাখ ১ হাজার ৭৮৫ টাকা আদায় হয়েছে। বাকি ৬৩ কোটি ৮৬ লাখ ৬ হাজার ১৯০ টাকা অনাদায়ী রয়েছে। এই বকেয়া পাওনা আদায় ও প্রতিষ্ঠানের সুপারভাইজড বন্ড সুবিধা বাতিলসহ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হয়।

এ বিষয়ে গোল্ডেন সন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বেলাল আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, ‘একটি রং (ভুল) জিনিসের ওপর নির্ভর করে আমাদের বিরুদ্ধে মামলার পর মামলা হয়েছে। দেশের প্রথম বাচ্চাদের খেলনা ফ্যাক্টরি করেছি আমি। আচরণ দেখে মনে হচ্ছে, ফ্যাক্টরি করে ভুলই করেছি।’ তিনি একজন কর্মকর্তার দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘আক্রোশে এত মামলা দিয়েছে। আমিও তার বিরুদ্ধে দুটি মামলা করেছি। আমার ফ্যাক্টরিতে দুবার আগুন লেগেছে। আগুনে সব মালামাল পুড়ে গেছে। পুড়ে যাওয়া মালামাল কি ফ্যাক্টরিতে থাকবে? এরপরও আক্রোশের বশবর্তী হয়েছে, বলা হয়েছে আমি অবৈধভাবে পণ্য অপসারণ করেছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাকে এনবিআর থেকে স্পেশালাইজড বন্ড প্রতিষ্ঠান হিসেবে অনুমোদন দিয়েছে। কিন্তু আমার তো স্পেশালাইজড বন্ডেড প্রতিষ্ঠান না। এরপর তারা বলেছে, আপনি সুপারভাইজড বন্ড সুবিধা পাবেন।’ এনবিআর আপনার প্রতিষ্ঠানের সুপারভাইজড বন্ড সুবিধা বাতিল করছে এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি এখনও কোনো চিঠি পাইনি।’ মামলার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘একটি মামলারও কোনো গ্রাউন্ড নেই। আমার কাছে সব কাগজপত্র রয়েছে। আমি আপনাকে সব কাগজ দেব।’ কোম্পানি সচিব প্রতিবেদকের কাছে সেই কাগজ দেবে বলে জানান তিনি। তবে তিনদিন পার হলেও কোনো কাগজপত্র দেয়া হয়নি।