নিজস্ব প্রতিবেদক: ঋণ অনিয়ম ও আমানতকারীদের স্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়ায় ফিনিক্স ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদ থেকে ইন্তেখাব আলমকে সাময়িক অপসারণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গতকাল বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদকে একটি চিঠি দেয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক চিঠি দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
চিঠিতে বলা হয়, ঋণ অনিয়মে ইন্তেখাব আলমের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। এটা আমানতকারীদের স্বার্থে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। তাই ইন্তেখাব আলমকে প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীর পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তাকে বরখাস্ত করার পর প্রতিষ্ঠানটির মানবসম্পদ বিভাগে সংযুক্ত করার নির্দেশ দেয়া হয়। ২০০৮ সাল থেকে টানা ১৬ বছর প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) দায়িত্ব পালন করছেন ইন্তেখাব আলম।
প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালনার করতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিধান অনুযায়ী, নতুন একজন প্রধান নির্বাহী নিয়োগ করতে বলা হয়। এছাড়া গ্রাহক প্রতিষ্ঠান এস এ অয়েল রিফাইনারি লিমিটেড, আমান সিমেন্ট মিল ইউনিট-২, মনোষ্পুল পেপার ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি, মাহিন এন্টারপ্রাইজ, ম্যাক্স স্টিল ইন্ডাস্ট্রিজ ও গ্রাহক নাজমা পারভিন, ফারহান মোশাররফের ঋণ অনিয়মের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের অভ্যন্তরীণ তদন্তের মাধ্যমে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ও আইনগত ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে তদন্ত কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন থাকাকালে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পর্ষদকে নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
জানা যায়, সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি অ্যান্ড কাস্টমার সার্ভিসেস ডিপার্টমেন্ট (এফআইসিএসডি) থেকে ফিনিক্স ফাইন্যান্সের ওপর বিশেষ পরিদর্শন চালানো হয়। পরিদর্শনে ইন্তেখাব আলমসহ বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের দ্বারা সংঘটিত নানা অনিয়মের তথ্য বেরিয়ে আসে। ঋণ অনিয়ম
ও আমানতকারীদের অর্থ ফেরত না দেয়ার মতো ঘটনাও ঘটে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটির গত মার্চ শেষে ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৬৯৯ কোটি টাকায়। এর মধ্যে ৯৬৭ কোটি টাকা খেলাপি হয়ে পড়েছে, যা মোট ঋণের ৩৫ দশমিক ৮৩ শতাংশ। একই সময়ে প্রতিষ্ঠানটির প্রভিশন বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২১ কোটি টাকার বেশি।
জানা যায়, ২০২০ সালের পর প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক পরিস্থিতি দিন দিন খারাপের দিকে যেতে শুরু করে। প্রতিষ্ঠানটি থেকে নামে-বেনামে ঋণ বের করে নেয়ায় তা আর ফেরত আসছে না। গত দুই বছর টানা লোকসানে রয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, আর্থিক খাতের যত অনিয়ম কেন্দ্রীয় ব্যাংক পেয়েছে, তার বেশিরভাগের ক্ষেত্রে আইন লঙ্ঘন করে জামানতবিহীন কিংবা ভুয়া জামানতের বিপরীতে ঋণ দেয়ার তথ্য মিলেছে। অনেক ক্ষেত্রে জামানত নিলেও তা অতি মূল্যায়ন করা হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভুয়া গ্যারান্টির বিপরীতে ঋণ দেয়া হয়েছে। এসব কারণে ঋণ আদায়ে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারছে না অনেক প্রতিষ্ঠান। এ তালিকার প্রথম দিকে আছে ফিনিক্স ফাইন্যান্স। প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক পরিস্থিতি দ্রুত অবনতি হওয়ায় সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিশদ পরিদর্শনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ওই পরিদর্শনেই এসব অনিয়মে এমডির সম্পৃক্ততা পায় বাংলাদেশ ব্যাংক।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ওয়েবসাইটে প্রকাশিত কোম্পানিটি আর্থিক প্রতিবেদনের এ তথ্য অনুযায়ী, দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আর্থিক খাতের কোম্পানি ফিনিক্স ফাইন্যান্স বড় ধরনের লোকসানে পড়েছে। চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারপ্রতি আয় বা ইপিএস কমে ১৩ টাকা ৪৭ পয়সা ঋণাত্মক হয়ে গেছে। অর্থাৎ কোম্পানিটি এই ৬ মাসে প্রতি শেয়ারের বিপরীতে ১৩ টাকা ৪৭ পয়সা লোকসান করেছে।
তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের প্রথম ছয় মাসে কোম্পানিটি প্রতি শেয়ারের বিপরীতে ১ পয়সা করে লাভ বা মুনাফা করেছিল। সেখানে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে বড় ধরনের লোকসান গুনতে হয়েছে তাদের। লোকসানের কারণ সম্পর্কে কোম্পানিটি জানিয়েছে, ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশনিং বেড়ে যাওয়ায় মুনাফা কমে গেছে। অর্থাৎ কোম্পানিটির ঋণের বড় অংশই খেলাপির ঝুঁকিতে পড়েছে বা খেলাপি হয়ে গেছে। সাধারণত যেসব ঋণে খেলাপির ঝুঁকি বেড়ে যায়, সেসব ঋণের বিপরীতে প্রভিশনিং করতে হয়।