রহমত রহমান: দেশীয় ফুড ও গ্রোসারি ডেলিভারি প্ল্যাটফর্ম ‘ফুডপান্ডা’। বহুজাতিক হলেও কোম্পানির বিরুদ্ধে রয়েছে অভিযোগের পাহাড়। রাইডারদের কমিশন কমানো নিয়ে চলছে আন্দোলন। খাবারের অর্ডার বাতিল করলেও দেয়া হয় না রিফান্ড। সরবরাহ করা হয় নিন্মমানের ও পচা খাবার। বেশি কমিশন নেয়ার ফলে হোটেল-রেস্টুরেন্ট খাতে তৈরি করছে অসম প্রতিযোগিতা। ভ্যাট ফাঁকি দিতে প্রকৃত তথ্য গোপন করা হয়। বাড়ি ভাড়ার ভ্যাট ফাঁকি দিতে নেয়া হয় অভিনব কৌশল। নিজেরা ভ্যাট ফাঁকি তো দেয়ই, সঙ্গে হোটেল-রেস্টুরেন্টকে ভ্যাট ফাঁকি দিতে সহযোগিতা করে। রাইডারদের ডাবল অর্ডারে দেয় না কমিশন। নামে বহুজাতিক হলেও অনিয়মের ক্ষেত্রে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে এই ফুডপান্ডা।
ঠকানো হয় রাইডারদের, চলছে আন্দোলন: ফুডপান্ডার প্রাণ হলো রাইডার। এই রাইডাররা সব ধরনের প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করে ভোক্তার হাতে পণ্য বা খাবার পৌঁছে দেয়। অথচ বছরের পর বছর ধরে ফুডপান্ডা রাইডারদের ঠকিয়ে আসছে। সম্প্রতি আট দফা দাবিতে ঢাকা, সিলেট, রাজশাহীসহ বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলন শুরু করছেন রাইডাররা। এছাড়া বিভিন্ন জায়গায় ডেলিভারি বন্ধ রেখে ধর্মঘটও করেছেন তারা। দাবিগুলো হলোÑডেলিভারি চার্জ বাড়ানো, ব্যাচ অনুযায়ী ডেলিভারি চার্জ চার্ট আকারে অফিসের দেয়ালে টাঙানো, প্রত্যেক রাইডারকে এক বছর মেয়াদে একটি করে ব্যাগ ও দুটি টিশার্ট বিনা মূল্যে দেয়া, ১৮ বছরের নিচে কোনো রাইডার নিয়োগ দেয়া যাবে না, কাস্টমারের কোনো অভিযোগের সত্যতা যাচাই না করে কোনো রাইডারকে শাস্তি দেয়া যাবে না, প্রত্যেক রাইডারকে পরিচয়পত্র দিতে হবে, মোবাইলে ত্রুটির কারণে ফোন পরিবর্তন করলে সেই রাইডারকে অবগত না করে বরখাস্ত করা যাবে না এবং ওয়ালেটের টাকার লিমিট বাড়াতে হবে। রাইডাররা জানিয়েছেন, ন্যায্য দাবি আদায়ে প্রয়োজনে সারাদেশে একযোগে ধর্মঘট করা হবে। তবে আন্দোলনের পর রাইডারদের হয়রানি করা হচ্ছে বলে দাবি করেছেন তারা।
পণ্যের দাম বেশি রাখায় জরিমানা: পণ্যের দাম বেশি রাখার অভিযোগ রয়েছে ফুডপান্ডার বিরুদ্ধে। গত ১১ সেপ্টেম্বর খুলনায় টিস্যুর দাম বেশি রাখায় ফুডপান্ডাকে জরিমানা করেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের খুলনা জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক শিকদার শাহীনুর আলম জানিয়েছেন, ‘এক ভোক্তা লিখিত অভিযোগ করেছিলেন যে, ফুডপান্ডা ২৮ টাকার টিস্যু পেপার ৩০ টাকায় বিক্রি করেছে। শুনানিতে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ফুডপান্ডাকে দুই হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। জরিমানার ২৫ শতাংশ অর্থাৎ ৫০০ টাকা সেই ভোক্তাকে দেয়া হয়েছে।’
প্রকৃত বিক্রয় তথ্য গোপন করে ভ্যাট ফাঁকি: দেশের বৃহৎ অনলাইন খাবার অর্ডার নেয়া প্রতিষ্ঠান ফুডপান্ডা। দেশের প্রায় পাঁচ হাজার ফুড স্টোর থেকে ফুড সংগ্রহ করে ভোক্তার কাছে বাইকারদের মাধ্যমে সরবরাহ করে থাকে। এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ফুডপান্ডার চুক্তি রয়েছে, যার আওতায় ফুডপান্ডা কমিশন পায়। বহুজাতিক এ খাবার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘদিন ধরে প্রকৃত বিক্রয় তথ্য গোপন করে আসছে। এছাড়া তথ্য ও প্রযুক্তি সেবা দেখিয়ে ভ্যাট নিবন্ধন নিয়ে বাড়িভাড়ার বিপরীতে ভ্যাট ফাঁকি দিয়ে আসছে। প্রায় তিন কোটি ৪০ লাখ টাকার ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটন ও মামলা করে ভ্যাট গোয়েন্দা। এনবিআর সূত্রমতে, ফুডপান্ডার বিরুদ্ধে বিক্রয় তথ্য গোপন ও বাড়িভাড়ার বিপরীতে ভ্যাট ফাঁকির সুর্নিদিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযান চালায় ভ্যাট গোয়েন্দা।
অভিযানে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি তথ্যপ্রযুক্তি সেবার আওতায় নিবন্ধন নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে। প্রতিষ্ঠানটি মূলত ইলেকট্রনিক নেটওয়ার্ক (অনলাইন প্লাটফর্ম) ব্যবহার করে পণ্য বিক্রি করে থাকে, যার প্রকৃত সেবার কোড এস-০৯৯.৬০। এ কোডের আওতায় ভ্যাট পাঁচ শতাংশ এবং বাড়িভাড়ার ওপর উৎসে ভ্যাট ১৫ শতাংশ। প্রতিষ্ঠানটি তথ্যপ্রযুক্তি সেবা কোডে নিবন্ধন নিয়ে বাড়িভাড়ার ওপর ভ্যাট পরিশোধ করে না। এই কোডটি কোনোক্রমেই তাদের ব্যবসার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ না হওয়া সত্ত্বেও বাড়িভাড়ার ওপর অবৈধভাবে শূন্য হারে ভ্যাট সুবিধা নেয়ার উদ্দেশ্যে তা ব্যবহার করে আসছে। জব্দ করা কাগজপত্র যাচাই করে ফুডপান্ডার খাবার বিক্রির বিপরীতে ৫৩ লাখ ১০ হাজার ৭৪ টাকা, বাড়িভাড়ার বিপরীতে ৫৬ লাখ ৬৬ হাজার ২৬ টাকা এবং উৎসে কর্তন বাবদ এক ২৪ লাখ ৩৫ হাজার ৫৫৩ টাকাসহ মোট দুই কোটি ৩৪ লাখ ১১ হাজার ৬৫৩ টাকার ভ্যাট পরিশোধ করা হয়নি বলে ফাঁকি উদ্ঘাটন করা হয়েছে। এই ভ্যাটের ওপর সুদ এক কোটি পাঁচ লাখ ৪০ হাজার ২৬০ টাকা। সুদসহ সর্বমোট ফাঁকি তিন কোটি ৪০ লাখ টাকা। পরে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। অপরদিকে অনিয়মের অভিযোগে ফুডপান্ডার বিরুদ্ধে মামলা করেছে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন। ২৬ সেপ্টেম্বর মামলার শুনানি হয়।
রেস্টুরেন্টকে ভ্যাট ফাঁকিতে সহযোগিতা করে ফুডপান্ডা: ফুডপান্ডা, পাঠাও ফুড, সহজ ফুডসহ অন্যান্য খাবার ডেলিভারি অ্যাপসের মাধ্যমে অনলাইনে খাবার অর্ডার জনপ্রিয় হচ্ছে। হোটেল, রেস্তোরাঁ এসব অ্যাপসে আসা অর্ডারের খাবার সরবরাহের সময় ভ্যাট নেয়। কিন্তু অ্যাপসে খাবার বিক্রির তথ্য ইএফডি বা এসডিসিতে দেখানো হচ্ছে না। এমনকি অ্যাপসে খাবার বিক্রির তথ্য ভ্যাট রিটার্নেও দেখাচ্ছে না দেশের নামিদামি হোটেল ও রেস্তোরাঁ। ফুডপান্ডাসহ এসব অনলাইন প্ল্যাটফর্ম রেস্টুরেন্টগুলোকে ভ্যাট ফাঁকিতে সহযোগিতা করছে বলে তথ্য পেয়েছে এনবিআর। এনবিআরের ঢাকা দক্ষিণ ভ্যাট কমিশনারেট তথ্য যাচাই করে ভ্যাট ফাঁকির প্রমাণ পেয়েছে। ৩১৮টি হোটেল, রেস্তোরাঁয় স্থাপিত ইএফডি, এসডিসির তথ্য ও এসব হোটেল-রেস্তোরাঁর ভ্যাট রিটার্ন যাচাই করছে। বার্গার এক্সপ্রেস, কাদেরীয়া ক্যাফে, স্ট্রিট ওভেন, চিজ রেস্টুরেন্ট, ভূতের বাড়ি, পিজ্জা কিংয়ের মধ্যে নামিদামি হোটেল, রেস্তোরাঁরার ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটন করেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এছাড়া ফুডপান্ডা, পাঠাও ফুড, সহজ ফুডসহ অন্যান্য অনলাইন ফুড সার্ভিস প্রোভাইডার প্রতিষ্ঠানের যোগসাজশে এসব হোটেল-রেস্তোরাঁরা ভ্যাট ফাঁকি দেয়া হচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখছে ভ্যাট ঢাকা উত্তর কমিশনারেট।
খাবারের মূল্য ছাড়াও বাড়তি টাকা নিচ্ছে ‘ফুডপান্ডা’: ফুডপান্ডার বিরুদ্ধে খাবার মিসিং, কম দেয়া, একটার বদলে আরেকটা খাবার দেয়া, ভাউচার ও হেল্পলাইন বিড়ম্বনার মতো অভিযোগ তো রয়েছেই। এবার নতুন করে যুক্ত হয়েছে বাড়তি অর্থ নেয়ার অভিযোগ। ভোক্তাদের অভিযোগ, অ্যাপে খাবার অর্ডার দেয়ার সময় খাবারের দাম, ভ্যাট ও ডেলিভারি ফি ছাড়া ‘প্ল্যাটফর্ম ফি’ হিসেবে বাড়তি টাকা নিচ্ছে অনলাইনে খাবার অর্ডারকারী প্রতিষ্ঠানটি। এর জন্য গ্রাহকদের কোনো নোটিশ প্রদান করেনি ফুডপান্ডা। প্রতিবার অর্ডারেই বাধ্যতামূলক এই অর্থ নিচ্ছে তারা। ফুডপান্ডার এমন আচরণে গ্রাহকদের মধ্যে নানা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। অ্যাপে দেখা যায়, খাবার অর্ডার দেয়ার সময় খাবারের দাম ও ডেলিভারি ফি’র পাশাপাশি প্ল্যাটফর্ম ফি-সহ মোট পেমেন্ট নেয়া হচ্ছে। আর প্ল্যাটফর্ম ফি হিসেবে তিন টাকা নিচ্ছে। প্রতিবার অর্ডারেই এ টাকা নেয়া হয়। প্ল্যাটফর্ম নেয়ার কারণ হিসেবে অ্যাপে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘এ ফি নেয়া হচ্ছে আমাদের অ্যাপ ও টেকের উন্নয়নের জন্য। এর মাধ্যমে আপনারা অর্ডার করতে গিয়ে সেরা সেবা উপভোগ করবেন।’ এভাবে বাড়তি অর্থ নেয়াকে প্রতারণা বলে দাবি করেছেন গ্রাহকরা। তাদের প্রশ্ন হচ্ছে, ফুডপান্ডার অ্যাপের উন্নয়নের জন্য কেন গ্রাহকদের কাছে টাকা নেয়া হবে! গ্রাহকদের অভিযোগ, মানুষ ঝামেলা এড়ানো ও স্বস্তির জন্য অনলাইনে খাবার অর্ডার করে। ফুডপান্ডায় বেশি অর্ডার করা হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি সব সময়ই গ্রাহকদের ভোগান্তিতে ফেলে। এবার যুক্ত হয়েছে বাড়তি টাকা নেয়া।
গ্রাহক ও কর্মী হয়রানি: সালমা আক্তার নামে এক গ্রাহক ফুডপান্ডার ফেসবুক পেজে অভিযোগ করে বলেন, ‘গত দু-চার মাসে একবারও ৩০ মিনিটে আসেনি, ৬০++ এ এসেছে, এমনকি আইস্ক্রিম বারবার বলার পরও আরও তিনটা ডেলিভারি দিয়ে এক ঘন্টা ১০ মিনিটে জুস বানিয়ে এনেছে।’ মো. ইমরান হোসেন নামের এক গ্রাহক অভিযোগ করেন, ‘খাবার অর্ডার করি, বিকাশ থেকে পেমেন্টও করেছি। কিন্তু খাবার দেয়নি।’ একজন রাইডার অভিযোগ করে বলেন, সিলেটে একটা ফুডপান্ডা অফিস আছে। জেল রোডের এ অফিসের ম্যানেজারের ব্যবহার ভালো নয়, রাইডারকে কিছু ভালোভাবে বোঝাতে পারে না। এ রকম যদি ম্যানেজার থাকে, ভাই, আপনার ফুডপান্ডা রাইডার কমবে। আমার একটা সমস্যা নিয়ে গিয়েছিলাম। আমাকে কিছু বোঝাতে পারে না। আমার মতে, এরকম ম্যানেজারকে চাকরি থেকে বের করে দেয়া উচিত। তৃণা নামের একজন গ্রাহক বলেন, আমি যদি গিয়ে নিয়ে আসতে পারতাম, তাহলে ওদেরকে অর্ডার কেন দিলাম! ফুডপান্ডার বিরুদ্ধে রয়েছে অফার বা ডিসকাউন্ট নিয়ে ভাঁওতাবাজির মতো অভিযোগও। এসব নিয়ে সুমাইয়া স্মৃতি নামে একজন বলেছেন, ডিসকাউন্টে অনেক সময়ই খাবার ভালো থাকেনি, ভুল আসছে, ক্যানসেল হয়েছে। কিছুক্ষণ পরপর সম্ভাব্য সময় পরিবর্তন করে এরা। ফেসবুক পেজে গ্রাহক ও কর্মীরা এমন অসংখ্য অভিযোগ করে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত।
অপরদিকে এ অনিয়মের বিষয়ে বক্তব্য জানতে ফুডপান্ডা বাংলাদেশের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আম্বারীন রেজার ব্যক্তিগত নম্বরে ফোন করা হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়। হোয়াসঅ্যাপ নম্বরে বক্তব্যের বিষয় লিখে দেয়া হলেও তিনি কোনো জবাব দেননি। অপরদিকে এসব অনিয়মের বিষয়ে বক্তব্য জানতে ফুডপান্ডার সাবেক সহপ্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক জোবায়ের সিদ্দিকীর ব্যক্তিগত নম্বরে কয়েক দিন ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। হোয়াসঅ্যাপে বক্তব্যের বিষয় লিখে দেয়া হলেও তিনি জবাব দেননি।