অনিশ্চয়তার মাঝে বিএনপি, হতাশায় নেতাকর্মীরা

মিজানুর রহমান হেলাল / ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক: নেতাকর্মীদের ধরপাকড়, মামলা, রিমান্ডের মুখে হরতাল বা অবরোধের মতো কর্মসূচির ঘোষণা দিলেও মাঠের রাজনীতিতে প্রভাব দেখাতে পারছে না বিএনপি। তারপরেও এ কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে দলটি। সরকারও কঠোর ভূমিকায় অবতীর্ণ রয়েছে। এদিকে আগামী ৭ জানুয়ারি ২০২৪ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে অনড় নির্বাচন কমিশন। গ্রেপ্তার এড়াতে এখন বিএনপির বাকি সব নেতাই আত্মগোপনে। এভাবে চলতে থাকলে সামনের আন্দোলন কর্মসূচি কোন পথে এগোবে, তা নিয়েও দলটিতে উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে।

২০১৪ সালের পর এবারও সংসদ নির্বাচন থেকে বিরত থেকেছে বিএনপি। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের আয়োজন না হওয়ায় ও সরকারের কঠোর আচরণে নেতাকর্মীদের মনোবল অনেকটা ভেঙে পড়েছে। বিএনপির আগামী রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়েও শংকিত তৃণমূলের অনেক সাধারণ নেতাকর্মী। বিরোধী রাজনীতিতে থেকে দীর্ঘদিন মামলার বোঝা টানতে অনেকে হাঁপিয়ে উঠেছে। অতিমাত্রায় কূটনীতিকদের ওপরে ভরসা করা দলটির অস্তিত্ব সংকট দেখা দিয়েছে বলেও মনে করেন অনেকে।

নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে দুই দলের অনড় ভুমিকা থেকে রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়ছিল। এই উত্তেজনার পর গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে ঘটেছে সহিংসতা, প্রাণহানি। এমন পরিস্থিতির জন্য একে অপরকে দায়ী করেছে বিএনপি ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দুই পক্ষ এখন সমঝোতা বা কোনো ছাড় দেয়ার মানসিকতায় নেই। জাতীয় নির্বাচনও ঘনিয়ে আসছে। সরকারও বিএনপি প্রসঙ্গে কঠোর থেকে আরও কঠোর হচ্ছে।

অন্যদিকে অংশগ্রহণমূলক, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর তৎপরতা রয়েছে। যদিও এ তৎপরতাকে আমলে নিচ্ছে না আওয়ামী লীগ। তবে এ তৎপরতাকে অতিমাত্রায় গুরুত্ব দিয়ে আন্দোলন বেগবানের পথে না হেঁটে কূটনীতিকদের ওপরে ভরসার মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে বিএনপি।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সহ বেশিরভাগ শীর্ষ নেতাই কারাগারে। বিশেষ করে, স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীকে গ্রেপ্তারের ঘটনা বিএনপির মাঠের নেতা-কর্মীদের চিন্তায় ফেলে দেয়। আমীর খসরু বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক কমিটির প্রধান। তিনি বহির্বিশ্বের সঙ্গে বিএনপির পক্ষে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। তার গ্রেপ্তার এই যোগাযোগে বিঘ্ন ঘটে। এমতাবস্থায় অতিমাত্রায় বিদেশীদের চাপের উপর নির্ভরশীলতা বিএনপির চেইন অফ কমান্ড নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে, নেতাকর্মীদের মধ্যে এক প্রকার হতাশা বিরাজ করছে। হরতাল বা অবরোধ দিয়ে মাঠে না থাকার কারণ হিসেবে প্রশাসনের অতিমাত্রায় বল প্রয়োগকে দায়ী করে আসছে তারা। এই পরিস্থিতিতে দলের সাধারণ নেতাকর্মী দিশেহারা হয়ে পড়েছে। আত্মগোপনে থেকে অজ্ঞাত জায়গা থেকে ভার্চ্যুয়াল সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে দলের কর্মসূচি ঘোষণা করে আসছেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।

বিএনপির তৃণমূলের একাধিক নেতাকর্মীদের সাথে কথা হয় প্রতিবেদকের তাদের সবার প্রায় একই রকম বক্তব্য, ‌”এভাবে হরতাল এবং অবরোধের ডাক দিয়ে মাঠে টিকে থাকা বর্তমানে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে, পুলিশ প্রশাসন নেতাকর্মীদের একসাথে দেখা মাত্র আক্রমণাত্মক ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে। যার কারণে মিটিং মিছিল নিমেষের মধ্যে ছত্রভঙ্গ হয়ে যাচ্ছে। কয়েক জায়গায় ঝটিকা মিছিল করলেও দীর্ঘ সময় রাজপথে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। তাছাড়া আমেরিকা ও পশ্চিমা দেশের চাপ গুলোকে তো সরকার পাত্তাই দিচ্ছে না, তাহলে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে কিভাবে? আর নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে এভাবে থাকলে নেতা কর্মীরা টিকে থাকতে পারবেনা, তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার!”

এর মধ্যে আত্মগোপনে থাকা বিএনপির শীর্ষ এক নেতার সঙ্গে প্রতিবেদকের কথা হয়। তিনি প্রতিবেদককে বলেন, ”জনগণের ভোটের অধিকার জনগণকেই ফিরিয়ে আনতে হবে, বিএনপি রাজনৈতিকভাবে এর বিরুদ্ধে অবস্থান অব্যাহত রাখবে। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে বিএনপি সর্বাত্মকভাবে লড়ে যাবে।” তিনি বলেন, ”একদলীয় শাসন ব্যবস্থা চিরকাল টিকে থাকতে পারে না এটা অতীতেও দেখা গেছে, কাজেই হতাশার কিছু নাই গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার সময়ের ব্যবধানমাত্র।”

অন্যদিকে নির্বাচন মুখর পরিবেশ তৈরি করতে সরকার নানা রকম পদক্ষেপ নিয়েছে, নির্বাচন কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের দলীয় নেতা কর্মীরা সারাদেশে উৎসবমুখর পরিবেশে মেতে উঠেছে। বিদ্রোহী প্রার্থীদের ক্ষেত্রেও থাকছে ছাড়, স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে উদ্বুদ্ধ করছে দলটির হাই কমান্ড।

এরই মধ্যে নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়ে জাতীয় পার্টি (জাপা) ২৮৯টি আসনে দলীয় মনোনয়ন চূড়ান্ত করে প্রার্থীদের নামের তালিকাও প্রকাশ করেছে।
জাপার দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, এবারের নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে জি এম কাদেরের অমত ছিল, কিন্তু সরকারের দিক থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের চাপ আসে। শেষ পর্যন্ত মোটাদাগে দুটি শর্তে জি এম কাদের নির্বাচনে যেতে সম্মত হন। একটি হলো নির্বাচনে তার সিদ্ধান্তেই দলীয় মনোনয়ন চূড়ান্ত হবে, কারও হস্তক্ষেপ মেনে নেয়া হবে না। অপরটি নির্বাচনে জয়ী হলে দলীয় প্রধান হিসেবে তিনি সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা হবেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায় এর পরিপ্রেক্ষিতেই নির্বাচন প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয় (জাপা)।

নিবন্ধিত ৪৪টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে এখন পর্যন্ত ২৬টি দল আগামী ৭ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নির্বাচনে অংশ নেয়া ২৬ দলের বেশিরভাগ ক্ষুদ্র।

এদিকে বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতা থেকে শুরু করে মাঠের নেতাদের বেশিরভাগই এখন কারাগারে। এমনকি জ্যেষ্ঠ নেতাদের রিমান্ডেও নেয়া হয়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতির মুখে অবরোধের মতো কর্মসূচি অব্যাহত রেখে বিএনপি বলছে, এ ধরনের কর্মসূচি দেয়া ছাড়া তাদের সামনে বিকল্প নেই।

এসব অবরোধ ও হরতাল কর্মসূচির পালনের আহ্বান জানিয়ে রিজভী বলেন, ‘‘এই সরকারের অধীনে এ রকম দুঃশাসন, দুঃসময়, দুর্দিন অতিক্রম করতে হবে। তাই এই স্বৈরশাসককে পরাজিত করতে হবে। সরকারকে পদত্যাগ করাতে জনগণের শক্তিকে রাজপথে নামিয়ে আনতে হবে।’’

রিজভী বলেন, বিজয় না হওয়া পর্যন্ত ‘একদফা’র আন্দোলন চলতেই থাকবে।’ তিনি বলেন, সরকারের কোনো উসকানিতে পা না দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি পালন করে যাবেন তারা। কর্মসূচি সফল করতে দেশের মানুষ ও দলের নেতা-কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

এর আগে ২০০৮ সালে ‘দেশের সর্বশেষ গ্রহণযোগ্য নির্বাচন’র পর গঠিত নবম জাতীয় সংসদে তাদের মধ্যে কেবল পাঁচটি দলের আসন ছিল। ২০১৪ সালের নির্বাচনে ১২টি দল অংশ নিয়েছিল। বিএনপি ও অন্যান্য বিরোধী দল ওই নির্বাচন বর্জন করেছিল। ২০১৮ সালের নির্বাচনে ৩৯টি দল অংশ নিলেও ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ তুলে ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি দল। আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে অনিচ্ছুক হওয়ায় এবার ১৪টি রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০