মোহাম্মদ ওয়ালীউল্লাহ: প্রতি রমজানেই বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য খোলা বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু পণ্য বিক্রি করে রাষ্ট্রায়ত্ত বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। এবারও রোজা উপলক্ষে গতকাল থেকে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ট্রাকে করে স্বল্প মূল্যে এসব পণ্য বিক্রির কথা ছিল সংস্থাটির ডিলারদের। এই কর্মসূচির আওতায় রাজধানীসহ দেশজুড়ে ভোজ্যতেল, চিনি, ছোলা, ডাল ও খেজুর বিক্রি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এ কার্যক্রম শুরু হয়নি। আজও তা শুরু হবে কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তার কথা জানালেন ডিলাররা।
তাদের অভিযোগ, যে দামে টিসিবি তাদের পণ্য দিচ্ছে তা বাজারমূল্যের প্রায় সমান। এই দামে বিক্রি করলে তাদের লোকসানে পড়তে হবে। তাই তারা টিসিবির পণ্য তোলেননি। বিষয়টি নিয়ে তারা টিসিবির চেয়ারম্যানের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন। তবে দামের ব্যাপারে ডিলারদের অভিযোগকে অযৌক্তিক বলছে টিসিবি।
এর আগে বেশ জোরেশোরে হাঁকডাক দিয়ে খোলা বাজারে পণ্য বিক্রির ঘোষণা দিয়ে আসছিল টিসিবি। কিন্তু গতকাল রাজধানীর কোথাও টিসিবির পণ্যবাহী ভ্রাম্যমাণ ট্রাক দেখা যায়নি। আগে থেকেই রাজধানীর ৩২টি পয়েন্টে পণ্য বিক্রির ঘোষণা থাকায় নি¤œবিত্তদের অনেকেই নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে পণ্য না পেয়ে ফিরে গিয়েছেন।
রাজধানীর সচিবালয়ের সামনে কথা হয় এমন একজনের সঙ্গে। পেশায় দোকানদার রাফাত উল্লাহ বলেন, প্রতি রমজানেই ট্রাক থেকে চিনি, ছোলা, ডাল ও তেল কিনি। রোজায় তো কাজে লাগেই। এখানে বাজারের চেয়ে একটু কম দামে পাই। আজ তো বিক্রির কথা ছিল, কিন্তু পেলাম না। বিষয়টা বুঝতে পারছি না।
বিক্রির আরেকটি পয়েন্ট জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে গিয়েও কোনো ট্রাকের দেখা মেলেনি।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে গতকাল দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে অবস্থিত টিসিবির প্রধান কার্যালয়ে যাওয়ার পথে টিসিবি ভবনের নিচেই দেখা হলো রাজধানীর কয়েকজন ডিলারের সঙ্গে। তাদের কাছ থেকে জানা গেল গতকাল তারা ইচ্ছা করেই পণ্য বিক্রি বন্ধ রেখেছেন। এমনকি তারা টিসিবির কাছ থেকে পণ্য কেনেননি।
বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত জনতে চাইলে সবুজবাগ-খিলগাঁও এলাকার ডিলার রফিক উদ্দীন বলেন, টিসিবি যে দামে আমাদের পণ্য দিচ্ছে তাতে আমাদের লাভের চেয়ে লোকসানের সম্ভাবনাই বেশি। এই ডিলার জানান, যে দামে তারা ভোক্তাদের খোলা বাজারে পণ্য দেবে সেই দামে বাজার থেকেই কেনা যাবে। তাহলে মানুষ কেন রোদের মধ্যে লাইনে দাঁড়িয়ে আমাদের ট্রাক থেকে এসব পণ্য কিনবে। ফলে আমাদের পণ্য অবিক্রীত থাকবে। সেগুলো তো টিসিবি ফেরত নেবে না।
টিসিবি সূত্রে জানা গেছে, একজন ডিলার খোলা বাজারে বিক্রির জন্য পাঁচশ থেকে সাতশ কেজি দেশি চিনি, মাঝারি সাইজের মসুর ডাল তিনশ থেকে ছয়শ কেজি, সয়াবিন তেল তিনশ থেকে পাঁচশ লিটার, ছোলা পাঁচশ থেকে সাতশ কেজি এবং খেজুর পাবেন ১৫০ থেকে ২০০ কেজি।
এর মধ্যে ভোক্তাদের কাছে প্রতি কেজি চিনি ৫৫ টাকায়, প্রতি কেজি মসুর ডাল ৫৫ টাকায়, প্রতি লিটার সয়াবিন তেল ৮৫ টাকায়, প্রতি কেজি ছোলা ৭০ টাকায় এবং প্রতি কেজি খেজুর ১২০ টাকায় বিক্রি করতে পারবেন। তবে ডিলাররা বলছেন এই দামে বিক্রি করলে তারা লোকসানে পড়বেন, এমনকি সাধারণ মানুষ তাদের কাছ থেকে পণ্য কিনতে আগ্রহী হবে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ডিলার বলেন, টিসিবির মূল্য তালিকায় যে দাম বলা হয়েছে তা বাজারদরের প্রায় সমান। এমনিতেই টিসিবির পণ্য নিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে নানা অভিযোগ থাকে। এর মধ্যে দাম যদি বাজারমূল্যের প্রায় সমান হয় তাহলে মানুষ কেন আমাদের কাছ থেকে কিনবে।
তিনি বলেন, টিসিবির পণ্যের দাম যদি বাজারমূল্য থেকে উল্লেখযোগ্য বেশি না হয়, তাহলে কীভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণ হবে। এতে করে তো জিনিসপত্রের দাম আরও বেড়ে যবে।
টিসিবির যাত্রাবাড়ী এলাকার ডিলার মো. সাহেদ আলী বলেন, বর্তমানে বাজারে ভালো মানের প্রতি কেজি চিনির খুচরা মূল্য ৫৫ থেকে ৫৮ টাকা, আমরা বিক্রি করব ৫৫ টাকায়। আমরা যে মানের মসুরের ডাল প্রতি কেজি ৫৫ টাকায় বিক্রি করব বাজারে তার দাম এর চেয়ে বেশি নয়।
ডিলারদের সবচেয়ে বেশি আপত্তি ছোলার দাম নিয়ে, কারণ বাজারে বর্তমানে ভালো মানের এক কেজি ছোলার বিক্রয়মূল্য ৬৫ থেকে ৭০ টাকা। মানভেদে এর কমেও ছোলা পাওয়া যায়। কিন্তু টিসিবির মূল্য অনুযায়ী এক কেজি ছোলা বিক্রি করতে হবে ৭০ টাকায়। তবে সয়াবিন তেলের দাম নিয়ে আপত্তি নেই ডিলারদের।
এদিকে গতকালই উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে টিসিবি চেয়ারম্যানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন ডিলাররা। এ প্রসঙ্গে টিসিবি ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি জুয়েল আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমরা টিসিবিকে আমাদের আপত্তির বিষয়ে জানিয়েছি। চেয়ারম্যান আমাদের কাল (আজ) থেকে চালু করতে বলেছেন। কিন্তু কী করব তা এখনও নিশ্চিত নয়।’
তিনি জানান, টিসিবির চেয়ারম্যান তাদের মৌখিকভাবে আশ্বস্ত করেছেন যে কমিশন বৃদ্ধির ব্যাপারে তারা ভেবে দেখবেন। কিন্তু এমন আশ্বাসেও নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না ডিলাররা।
তবে দাম নিয়ে ডিলারদের আপত্তির বিষয়টি মানতে নারাজ টিসিবি কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে টিসিবির মুখপাত্র মো. হুমায়ুন কবির শেয়ার বিজকে বলেন, বাজারমূল্য যাচাই করে এবং ডিলারদের যেন লাভ হয় সেটি মাথায় রেখেই দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। ডিলাররা অহেতুক এসব করছে। তার দাবি, রাজধানীতে শুরু না হলেও সারা দেশে যথারীতি সুষ্ঠুভাবে খোলা বাজারে পণ্য বিক্রি শুরু হয়েছে।
তিনি বলেন, ডিলাররা বাজারের যে মানের পণ্যের সঙ্গে টিসিবির পণ্যের তুলনা করছেন, তা অযৌক্তিক। টিসিবি ভালো মানের পণ্য দিচ্ছে। বাজারমূল্য ও মানের সঙ্গে তুলনা করলে ডিলাররাই লাভবান হবেন।