মো. ইমরান হোসেন: ক্রাশ বলতে এতদিন দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়াকেই বুঝতাম। ইদানীং আমাদের এখানে অবশ্য শব্দটির এক অদ্ভূত ব্যবহার শুরু হয়েছে। ক্রাশ খাওয়া হচ্ছে এখানে কাউকে প্রথম দেখার পর, তার প্রতি এক ধরনের আকর্ষণবোধকে বাঙালিরা ক্রাশ বলে। হয়ত হৃদয় নিংড়ে যাওয়া অর্থে এর ব্যবহার হচ্ছে। তবে এর মধ্যে এক ধরনের বিশেষ ভালো লাগা কাজ করে। সব কিছুই এর পর থেকে ভালো লাগতে শুরু করে, যার ওপর এ ক্রাশ তাকে নিয়েই দিন-রাতে ভাবতে ভালো লাগে।
শুভও ক্রাশের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। এমনিতে দীর্ঘদিন ধরেই শোবিজের নায়িকাদের ওপর ক্রাশ খাচ্ছে। ওই ক্রাশগুলো হয়তো অবাস্তব, শুধুই কাল্পনিক। তবে এবার ক্রাশ খেয়েছে সে তার উপরের তলায় বাসিন্দা অবন্তির প্রতি।
অবন্তি এক অপরূপা সুন্দরী। খুব নম্র ও ভদ্র। বই পড়তে পড়তে এখন চোখে কম দেখে। অবন্তি যখন চোখে চশমা লাগায় তখন পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী মনে হয় শুভর কাছে। অবন্তির উপর চোখ পড়লে কথা বলার কোনো শব্দ খুঁজে পায় না শুভ। বায়ুমণ্ডল যেন শব্দহীন হয়ে পড়ে। অবন্তি তার মস্তিষ্কে গেঁথে গেছে। গত দুই বছর হাজার বার দেখা হলেও কথা হয়েছে হাতে গোনা কয়েকবার। তাও আবার ‘কেমন আছো অবন্তি, ভালো?’ এই চারটি শব্দে সীমাবদ্ধ।
শুভর বন্ধু নীলয়ের ছোট বোন অবন্তি। বিপত্তিটা এখানেই। চাইলেও ক্রাশের কথা বন্ধুকে বলতে পারে না। প্রেমের চেয়ে বন্ধুত্ব রক্ষা করা শ্রেয় বলে তার কাছে মনে হয়। দুজনেরই বাড়ি পটুয়াখালীতে। নিলয় চাকরি করে। একই জেলা হলেও আগে কখনো তাদের দেখা হয়নি। এ বাড়িতে এসেই পরিচয়। গত বছর ঈদে নিলয় চাকরিতে ব্যস্ত থাকায়, তার পরিবারকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছে শুভ।
একে তো ঈদ উপলক্ষে বাড়িতে যাওয়ার খুশি, সবার সঙ্গে ঈদ উদযাপন করবে সেই চিন্তায় বিভোর। এর উপর অবন্তিদের সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ববোধ। হঠাৎ নিজেকে বেশ বড় ও দায়িত্ববান মনে হয় শুভর।
ঈদ ঘনিয়ে আসছে। মনের ভেতর উথালপাথাল অনুভূতি। একসঙ্গে সবাই মিলে কিভাবে ঈদ করবে, কোথায় কখন উদযাপন করবে, কার কার বাড়িতে বেড়াতে যাবে, বন্ধুদের সাথে কোথায় কোথায় বেড়াতে যাবে এসব চিন্তা মাথাই নেই বললে চলে। একটাই চিন্তা কখন অবন্তিদের নিয়ে বাসা থেকে বের হবে। নিজের ব্যাগ এবার একটাই। অবন্তির ব্যাগ তো তাকেই বয়ে নিয়ে যেতে হবে, ও না চাইলেও। পথিমধ্যে ওর মায়ের ওষুধ লাগবে কি না, তাও জেনে নিতে হবে। ওদের ভ্রমণ যেন আরামদায়ক হয় সেদিকে সর্বোচ্চ লক্ষ্য থাকবে তার।
বৃষ্টির মৌসুম। ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি পড়ছিল বাইরে। সিএনজিচালিত অটোরিকশা ডেকে আনে শুভ। বাড়ির সামনে একটু ফাঁকা জায়গা। ওখানে দাঁড় করিয়ে অবন্তিদের অপেক্ষায় সে। অবন্তি না চাইতেই ওর মাথায় ছাতা মেলে ধরে শুভ। এতেই বুকের মধ্যে হাতুড়ির পিটুনি অনুভব করে। সদরঘাটে যাওয়ার পথটুকু যেন এক লহমায় শেষ হয়ে যায়।
অবন্তি বই পড়তে ভালোবাসে। লঞ্চের এক কোণায় বসে পড়ায় মগ্ন। শুভ কথা বলার চেষ্টা কম করছে না। কিন্তু বন্ধুর কথা ভেবে অতটা সাহস হয় না। আজ হয়তো পুরোটা সময় ধরে অবন্তিকে দেখতে পারবে। দেখতে দেখতে লঞ্চ ঘাটে ভিড়ছে। একে একে সবাই নামছে। লঞ্চের উঁচু স্থান থেকে নামার ব্যর্থ চেষ্টা করছে অবন্তি। কিন্তু কিছুতেই পারছে না। শুভ তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। তার ক্রাশ প্রথমবার তার হাত ধরেছে। শুভর বুকের মধ্যে ধড়ফড় শুরু হয়ে গেছে। অবন্তি যখন হাত ধরে নেমে খুব কাছে এলোÑওর চুলের গন্ধে হƒদয়ে এক আলাদা অনুভূতির সৃষ্টি হচ্ছিল। অজানা কম্পনের সৃষ্টি। মেঘলা দিনে যেন নীলপরির আগমন। মনের মধ্যে তখন এক অজানা ভালোবাসার সৃষ্টি হতে থাকে। বুকের ভেতর ধড়ফড় আরও বাড়তে থাকে, গা ছমছম করতে থাকে, অজানা ভালোবাসার মোহ যেন বাড়তেই থাকে। নিজেকে নিজের মধ্যে হারিয়ে ফেলেছে।
‘হাতটা তো এখন ছাড়েন’- অবন্তির কথায় মোহ কাটলো।অবন্তি হেসে বললো, ‘চলেন দেরি হয়ে যাচ্ছে।’
ওর এত সুন্দর হাসি আগে হয়তো কখনই দেখেনি শুভ। একটা সময় ওদের বাড়িতে পৌঁছে দেয় সে।
এখন নিজের বাড়িতে ফিরতে হবে। কিন্তু মন চাইছে না। মনে হচ্ছে, কে যেন তাকিয়ে আছে। কি যে করবে ঠিক বুঝতে পারছে না। কেমন যেন একটু ভয় ভয়ও করছিল। এটা কোনো ভয়ের অনুভূতি না, হৃদয় কাঁপছে। এটা ভালোলাগার অনুভূতি। প্রথম ভালোবাসার অনুভূতি। শুভর প্রথম ক্রাশ। বুঝতে পারছে সে, সত্যিকার ক্রাসের ছোঁয়ার অনুভূতিগুলো হয়তো এমনিই হয়।
অনুগল্প ক্রাশ
