প্রত্যেক সফল কাজের নেপথ্যেই থাকে পরিশ্রমের গল্প। কোনো সফলতা হয়তো রাতারাতি ধরা দেয় না। সফল হওয়ার জন্য প্রয়োজন প্রচেষ্টা, ঝুঁকি নেওয়ার মানসিকতা, ইতিবাচক চিন্তা পুরুষ অথবা নারীর ক্ষেত্রে তা সমানভাবে প্রযোজ্য। একেকজনের সফল হওয়ার গল্পেও রয়েছে ভিন্নতা। আজ এমনই একজন সফল নারী উদ্যোক্তা নাসিমা খানম-এর কথা জানাচ্ছেন নাজমুল মৃধা
জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার পুনট ইউনিয়নের মাদাই গ্রামের মো. বেলাল হোসেনের স্ত্রী নাসিমা খানম। তিনি নিজ উদ্যোগে ‘মাদাই নূর মহিলা উন্নয়ন সংস্থা’ করেছেন। এর মাধ্যমে স্থানীয় নারীদের নিয়ে শুরু করেন নতুন স্বপ্নের পদচারণ। বেকার যুব-মহিলাদের আত্মকর্মসংস্থানের জন্য পোশাক সেলাই, ক্রিস্টাল পুঁথির শোপিস তৈরি, নকশিকাঁথা তৈরি প্রভৃতি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেন তিনি। নারী-পুরুষদের জন্য যুব উন্নয়ন অধিদফতরের সহযোগিতায় মৎস্য চাষ, হাঁস-মুরগি ও গবাদি পশুপালন এবং শাকসবজি চাষ-বিষয়ক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে দেন। এছাড়া মহিলাবিষয়ক অধিদফতরের সহযোগিতায় মহিলাদের বিউটি পার্লার ও মাশরুম চাষ বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন।
সম্প্রতি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা টিএমএসএসের এইচআরডি অ্যান্ড ট্রেনিং ডোমেইনের উদ্যোগে দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত পরিবারের কর্মহীন সদস্য এবং আগ্রহী অন্যান্য শ্রমিককে পোশাক সেলাইয়ের প্রশিক্ষণ দেন। বর্তমান তার সংস্থাটির অধীনে গর্ভবতী মায়ের প্রশিক্ষণ ও ল্যাকটেটিং মাদারের প্রশিক্ষণ পরিচালিত হচ্ছে।
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং অ্যাসোসিয়েশন ফর রাইটস অ্যান্ড পিসের (এআরপি) যৌথ উদ্যোগে ২০১৮ সালে নাসিমা ‘নারী উদ্যোক্তা ও ব্যবসা ব্যবস্থাপনা প্রশিক্ষণ’ ও ‘জীবন জীবিকা ও সহজলভ্য প্রযুক্তিবিষয়ক ব্যবসা নির্বাচন’ এ দুটি বিষয়ে প্রশিক্ষণদানে প্রতিনিধিত্ব করেন।
যুব উন্নয়ন অধিদফতর থেকে চার মাস মেয়াদি প্রশিক্ষণ নিয়ে ২০০৯ সাল থেকে তিনি এ পর্যন্ত প্রায় এক হাজার বেকার নারী-পুরুষকে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বাবলম্বী করেছেন। বর্তমানে তারা নিজেদের পরিচয় দেওয়ার মতো অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে।
সাধারণ মানুষদের সচেতন করতে তিনি ‘মাদক মানে মৃত্যু’র পাশাপাশি যৌতুক গ্রহণে নিরুৎসাহ ও বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে পাড়ায় পাড়ায় উঠানবৈঠকের আয়োজন করেন। এসব আয়োজনে কমিটি গঠন করে তত্ত্বাবধান করেন তিনি।
দারিদ্র্যমুক্ত ও আত্মনির্ভরশীল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন থেকে জনসচেতনতার জন্য যে দীর্ঘ সংগ্রামী ভূমিকা, সেই কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন নানা সম্মাননা। ‘জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ’-এর আওতায় সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখায় ২০১৭ সালে কালাই উপজেলা ও জয়পুরহাট জেলা উভয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ জয়িতা নির্বাচিত হন। কর্মসংস্থানসৃজন ও আত্মকর্মসংস্থানে গৌরবোজ্জ্বল অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৮ সালে রাজশাহী বিভাগীয় পর্যায়ে প্রথম স্থান অধিকার করে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে ‘জাতীয় যুব পুরস্কার ২০১৮’ গ্রহণ করেন।
১৯৭৮ সালে জয়পুরহাটের আমতলিতে তার জন্ম। বাবা মো. মোখলেছার রহমান ও মা মোছা. দেলোয়ারা বেগম দিলজানের ৯ সন্তানের মধ্যে নাসিমা দ্বিতীয়। মাধ্যমিক শিক্ষার পর ১৯৯২ সালে একই জেলার মো. বেলাল হোসেনের সঙ্গে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের দুই সন্তান রয়েছে। বড় ছেলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে এমএসসি অধ্যয়নরত, ছোট ছেলে এসএসসি পরীক্ষার্থী।
‘নূর-নাহিদ লেডিস টেইলার্স ও ট্রেনিং সেন্টার’ রয়েছে নাসিমার। এখানে নিয়মিত আট থেকে ১০ মহিলা কারিগর পোশাক তৈরির কাজে নিয়োজিত আছেন।
নাসিমা তার স্বপ্নের কথা জানিয়ে বলেন, নারীরা স্বাবলম্বী হোক, তারা যেন আর অবহেলিত না থাকে। দেশের বেকারত্বের যে হার তা সবার প্রচেষ্টায় একদিন নির্মূল হবে বলে বিশ্বাস করেন তিনি। নারীরা আত্মপরিচয়ে পরিচিত হোক, এ তার চাওয়া। দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী, তাই নারীকে বাদ দিয়ে দেশকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয় বলে মনে করেন তিনি। গৃহকর্মের পাশাপাশি নারীরাও যেন কর্মে নিয়োজিত থাকে, সেজন্যই তার এ ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা। তিনি বললেন, সমাজের সুবিধাবঞ্চিত ও অবহেলিত নারীদের বিভিন্নভাবে স্বাবলম্বী করে তুলছি। সবার সম্মিলিত চেষ্টায় সোনার বাংলা গড়ে তোলা সম্ভব।
নাজমুল মৃধা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়