অনুমোদন পাচ্ছে সবচেয়ে ব্যয়বহুল সড়ক ও রেলপথ

  • ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পটির কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় হচ্ছে ১১৩ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। আর ঢাকা-মাওয়া-যশোর রেলপথ নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় ধরা হয়েছে ২০৭ কোটি তিন লাখ টাকা। কিলোমিটারপ্রতি ব্যয়ের হিসেবে দুটো প্রকল্পই বিশ্বে সবচেয়ে ব্যয়বহুল

ইসমাইল আলী
ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পটি চূড়ান্ত করা হয়েছে। এতে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় হচ্ছে ১১৩ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। আর ঢাকা-মাওয়া-যশোর রেলপথ নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় ধরা হয়েছে ২০৭ কোটি তিন লাখ টাকা। কিলোমিটারপ্রতি ব্যয়ের হিসেবে দুটো প্রকল্পই বিশ্বে সবচেয়ে ব্যয়বহুল। প্রকল্প দুইটি অনুমোদনের জন্য জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে উঠছে আজ।
সূত্রমতে, অনুমোদনের আগেই ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা চার লেন প্রকল্পের ব্যয় দুই দফা বাড়ানো হয়েছে। গত বছর অক্টোবরে প্রাথমিকভাবে প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছিল ৫ হাজার ২৯ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। গত মার্চে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫ হাজার ৯৬২ কোটি ৬০ লাখ টাকা। সর্বশেষ হিসাবে তা আরেক দফা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ২৫২ কোটি ২৮ লাখ টাকা। এতে দুই দফা ব্যয় বেড়েছে ১ হাজার ২২২ কোটি ৮৪ লাখ টাকা।
গত অক্টোবরে প্রকল্পটির বিভিন্ন খাতের ব্যয় অযৌক্তিক বলে মন্তব্য করে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। ১২টি খাতের বিভিন্ন ব্যয় নিয়ে আপত্তির পর তা না কমে উল্টো ৯৩২ কোটি ৭৬ লাখ টাকা বেড়ে যায়। আর গত মাসে প্রকল্পটির মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) বৈঠক হয়। এতেও প্রকল্পটির অত্যাধিক ব্যয়ের ব্যাখ্যা চাওয়া হয়। তবে ব্যয় না কমে উল্টো ২৮৯ কোটি ৬৩ লাখ টাকা বাড়ানো হয়েছে।
সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের (সওজ) তথ্যমতে, প্রকল্পটির আওতায় দুই প্যাকেজে ঢাকার বাবুবাজার লিংক রোড থেকে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া ও মাদারীপুরের পাচ্চর থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত ৫৫ কিলোমিটার চার লেন করা হবে। এতে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় পড়বে ১১৩ কোটি ৬৮ লাখ টাকা, যা দেশে চলমান ও প্রস্তাবিত অন্যান্য প্রকল্পের চেয়ে বেশি। এমনকি বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় এ ব্যয় অনেক বেশি।
সম্প্রতি সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে জমা দেয়া এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, সওজের প্রস্তাবিত এলেঙ্গা-রংপুর চার লেন প্রকল্পে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় ধরা হয়েছে ৬০ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। এতে ১৯০ কিলোমিটার দীর্ঘ মহাসড়কটি চার লেন নির্মাণে ব্যয় হবে ১১ হাজার ৫৫৮ কোটি ১১ লাখ টাকা। আর সম্প্রতি শুরু হওয়া জয়দেবপুর থেকে টাঙ্গাইল হয়ে এলেঙ্গা পর্যন্ত ৭০ কিলোমিটার চার লেনে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৩৬৪ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। এতে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় ৪৮ কোটি ৬ লাখ টাকা। এছাড়া শেষ হতে চলা ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেনে কিলোমিটারপ্রতি গড় ব্যয় ১৯ কোটি ৮৫ লাখ ও ঢাকা-ময়মনসিংহ চার লেন প্রকল্পে ২০ কোটি ৮২ লাখ টাকা।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ইউরোপে চার লেনের নতুন মহাসড়ক নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় পড়ছে ২৮ কোটি টাকা। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এ ব্যয় ১০ কোটি টাকা। আর চীনে তা গড়ে ১৩ কোটি টাকা। গত বছর জেনেভায় অনুষ্ঠিত ইউএন-ইসিই (ইকোনমিক কমিশন ফর ইউরোপ) এক সেমিনারেও এ ধরনের তথ্য তুলে ধরেন গ্রিসের ন্যাশনাল টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি অব এথেন্সের অধ্যাপক দিমিত্রিয়স স্যামবুলাস। ‘এস্টিমেটিং অ্যান্ড বেঞ্চমার্কিং ট্রান্সপোর্ট ইনফ্রাস্ট্রাকচার কস্ট’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মহাসড়ক নির্মাণের তুলনামূলক ব্যয়ের চিত্র তুলে ধরেন তিনি।
জানতে চাইলে সওজের প্রধান প্রকৌশলী ইবনে আলম হাসান বলেন, ঢাকা-মাওয়া চার লেনের মহাসড়কের পাশে ধীরগতির যানবাহনের জন্য পৃথক লেন থাকবে। এ সড়কে বিদ্যমান সেতুগুলো ব্যবহার করা যাবে। আর ধলেশ্বরী ১ ও ২ এবং আড়িয়াল খাঁ নদীতে চার লেনের এক্সপ্রেস সেতু নির্মাণ করা হবে। চার লেনের মাঝে মিডিয়ানের (সড়ক বিভাজক) প্রস্থ হবে ৫ মিটার (প্রায় সাড়ে ১৬ ফুট)। এতে জমি অধিগ্রহণ কিছু বেশি। গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পয়েন্টে ফ্লাইওভার বা ওভারপাস নির্মাণ করা হবে। সব মিলিয়ে প্রকল্পের ব্যয় কিছুটা বেশি হচ্ছে।
তথ্যমতে, শুধু সড়কই নয়, ঢাকা-মাওয়া-যশোর রেলপথও বিশ্বে সবচেয়ে ব্যয়বহুল। পদ্মা সেতু হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর সরাসরি রেল সংযোগ স্থাপনে এ প্রকল্পটি নেয়া হয়েছে। এজন্য ১৬৯ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে ব্যয় পড়ছে ৩৪ হাজার ৯৮৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। অর্থাৎ কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় ২০৭ কোটি তিন লাখ টাকা। এ ব্যয় চীন বা ভারতের হাইস্পিড ট্রেনের চেয়েও বেশি। পিইসি বৈঠকের পর এ প্রকল্পের ব্যয়ও ২৮৬ কোটি টাকা বেড়েছে। এর আগেও প্রকল্পটির ব্যয় কয়েক দফা বাড়ানো হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রেলওয়ের চলমান বা পাইপ লাইনে থাকা প্রকল্পের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ধরা হয়েছে দোহাজারি-কক্সবাজার-ঘুমধুম রেলপথ নির্মাণে। ১২৯ কিলোমিটার এ রেলপথ নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। এতে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় পড়ছে ১৩৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা। আর শিগগিরই শুরু হতে যাওয়ায় আখাউড়া-লাকসাম ডুয়েল গেজ ডাবল লাইন প্রকল্পের আওতায় ১৪৪ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হবে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬ হাজার ৫০৪ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ কিলোমিটাপ্রতি ব্যয় হবে ৪৫ কোটি ১৭ লাখ টাকা।
এদিকে পাশ্ববর্তী দেশ ভারতে প্রচলিত রেলপথ নির্মাণব্যয় কিলোমিটারপ্রতি ১২-১৭ কোটি টাকা। গত বছর ফেব্র“য়ারিতে ভারতের রেলপথ মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত এক শ্বেতপত্রে (হোয়াইট পেপার) এ তথ্য উঠে এসেছে। এছাড়া দেশটির মুম্বাই শহর থেকে আহমেদাবাদ পর্যন্ত ৫৩৪ কিলোমিটার দীর্ঘ হাইস্পিড রেলপথ নির্মাণ করা হবে। এক্ষেত্রে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৩ হাজার ১৮০ কোটি টাকা। এতে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় হবে ১১৮ কোটি টাকা।
সাম্প্রতিকালে প্রচলিত রেলপথ নির্মাণ করছে না চীন। দেশটির প্রায় পুরোটাই হাইস্পিড রেলপথ। ঘন্টায় ২০০ কিলোমিটার গতির হাইস্পিড রেলপথ নির্মাণে চীন গড়ে ব্যয় করছে ৭৩-৭৫ কোটি টাকা। আর ঘন্টার ৩৫০ কিলোমিটার গতির ট্রেন চালানোয় রেলপথ নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় করছে গড়ে ২ কোটি ডলার বা ১৬০ কোটি টাকা। গত বছর বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আমজাদ হোসেন বলেন, অন্যান্য দেশের ব্যয়ের হিসাব জানা নেই। তবে ঢাকা-মাওয়া-যশোর রেলপথ নির্মাণেই ৬২৬ কোটি ৪৭ লাখ ডলার বা ৫০ হাজার ১১৭ কোটি টাকা ব্যয় প্রস্তাব করেছিল চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। আলোচনার ভিত্তিতে তা অর্ধেকে (৩১৩ কোটি ৮৮ লাখ ডলার) নামিয়ে আনা হয়। এছাড়া রেলওয়ের অন্যান্য প্রকল্পের ব্যয় এ প্রকল্পের কাছাকাছি রয়েছে।
উল্লেখ্য, ঢাকা-মাওয়া-যশোর রেলপথ নির্মাণে জিটুজি ভিত্তিতে ২৪ হাজার ৭৪৯ কোটি ৫ লাখ টাকা দেবে চীন। বাকি ৯ হাজার ৯৫৩ কোটি ৬৮ লাখ টাকা সরবরাহ করবে বাংলাদেশ সরকার। রেলপথটি নির্মাণ করবে চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন (সিআরইসি)। আর সরকারের সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণ করা হবে ঢাকা-মাওয়া-যশোর রেলপথ।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০