অনেকদূর এগিয়েছি, যেতে হবে বহুদূর: প্রধানমন্ত্রী

শেয়ার বিজ ডেস্ক: আওয়ামী লীগের সময়ে গত ১২ বছরে বাংলাদেশ উন্নয়নের যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, তাকে আরও ‘বহুদূর’ এগিয়ে নেয়ার প্রত্যয় জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিডি নিউজ।

তিনি বলেছেন, ‘আমরা আজ অনেকদূর এগিয়েছি সত্য। আমাদের আরও বহুদূর যেতে হবে।’

সরকারের বর্তমান মেয়াদের দুই বছর পূর্তিতে গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শকে ধারণ করে জাতির জনকের স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্য-নিরক্ষরতামুক্ত একটি অসাম্প্রদায়িক ও কল্যাণকামী বাংলাদেশ গড়ে তোলার শপথ নিতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, ‘হতে পারে সে গন্তব্য পথ মসৃণ, হতে পারে বন্ধুর। বাঙালি বীরের জাতি। পথ যত কঠিনই হোক, আমাদের কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছতে হবে। আমরা যদি পরিশ্রম করি, সততা-দেশপ্রেম নিয়ে দায়িত্ব পালন করি, তাহলে আমরা সফলকাম হবই, ইনশাআল্লাহ।’

২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় পাওয়ার পর টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ।

২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি নতুন সরকার গঠন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশে টানা এতদিন ক্ষমতায় থাকার রেকর্ড কারও নেই। ভাষণের শুরুতেই তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিযাত্রার এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে এবং বৈশ্বিক মহামারির অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি।’

‘দুই বছর পূর্বে আজকের এই দিনে তৃতীয় মেয়াদে সরকার পরিচালনার যে গুরু দায়িত্ব আপনারা আমার ওপর অর্পণ করেছিলেন, সেটিকে পবিত্র আমানত হিসেবে গ্রহণ করে আমরা সরকার পরিচালনার তৃতীয় বছর শুরু করতে যাচ্ছি।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমার পরম সৌভাগ্য যে, আপনাদের সবার সঙ্গে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী পালন করতে পারছি এবং মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছি। এই শুভ মুহূর্তে আমি দেশ ও দেশের বাইরে অবস্থানরত বাংলাদেশের সব নাগরিককে অভিনন্দন জানাচ্ছি এবং একই সঙ্গে খ্রিষ্টীয় ২০২১-এর শুভেচ্ছা।’

মহামারি সংকট

করোনাভাইরাসের মহামারির কারণে পুরো বিশ্বকেই যে এক গভীর সংকটের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে, সে কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মহামারির পাশাপাশি ঘূর্ণিঝড় আম্পান এবং উপর্যুপরি বন্যাও ২০২০ সালে দেশের অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে।

‘আমরা সেসব ধকল দৃঢ়তার সঙ্গে কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছি। কিন্তু করোনাভাইরাস-জনিত সংকট থেকে বিশ্ব এখনও মুক্ত হয়নি।’

সরকার ভাইরাসের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে রাখার ‘সর্বোচ্চ চেষ্টা’ করে যাচ্ছে জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, ‘মহান আল্লাহর অশেষ রহমতে বাংলাদেশে এখনও সংক্রমণ এবং মৃত্যু হার অনেক কম।’

তবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কভিড-১৯ এর টিকাদান শুরু হওয়ায় যে আশার সঞ্চার হয়েছে, সে কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাংলাদেশেও আমরা দ্রুত টিকা নিয়ে আসার সব ধরনের চেষ্টা করছি। টিকা আসার পর পরই চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যসহ সম্মুখসারির যোদ্ধাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা প্রদান করা হবে।’

তিনি বলেন, ভাইরাসের কারণে শিক্ষার্থীদের সুরক্ষার কথা বিবেচনা করেই যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে হচ্ছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হবে।

মহামারির অভিঘাতে বিশ্ব অর্থনীতিতে যে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করেছে এবং বাংলাদেশের অর্থনীতিও যে ক্ষতির মুখে পড়েছে, সে কথা প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে তুলে ধরেন।

তবে সরকার বিভিন্ন নীতি-সহায়তা এবং প্রণোদনার মাধ্যমে অর্থনীতির চাকাকে যে সচল রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে, সে কথাও তিনি বলেন ।

শেখ হাসিনা বলেন, এখন পর্যন্ত এক লাখ ২১ হাজার কোটি টাকার বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে, যা মোট জিডিপির চার দশমিক তিন শতাংশ।

‘পরিস্থিতি বিবেচনা করে আমরা সে প্রক্রিয়া এখনও অব্যাহত রেখেছি। বিভিন্ন শ্রেণিপেশার প্রায় আড়াই কোটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে আমরা নগদ অর্থসহ বিভিন্ন সহায়তার আওতায় এনেছি। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা বৃদ্ধি করা হয়েছে।’

তিনি বলেন, গত অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি পাঁচ দশমিক ২৪ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকারের প্রাক্কলন অনুয়ায়ী এ বছর জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়াবে  সাত দশমিক চার শতাংশে।

‘করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের শুরুতে আমি আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলাম যে দেশবাসীর সহায়তায় আমরা এই দুর্যোগ সফলভাবে মোকাবিলা করব, ইনশাআল্লাহ। আমি অত্যন্ত আনন্দিত যে দেশবাসী এ দুঃসময়ে আমার এবং আমার সরকারের পাশে ছিলেন।

‘আপনারা আমাদের এ দুর্যোগ মোকাবিলায় সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়েছেন। এ ধরনের যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় ভবিষ্যতেও আপনাদের পাশে পাবÑএ আশাবাদ ব্যক্ত করছি।’

পথ পরিক্রমা

টানা এক যুগ দেশ শাসন করে নতুন একটি বছর শুরুর আগে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী স্মরণ করিয়ে দেন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস।

তিনি বলেন, জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ২৪ বছরের রাজনৈতিক সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এ দেশ স্বাধীন হয়েছে। সেই বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্ণ করতে যাচ্ছে আগামী ২৬ মার্চ।

‘জাতির জনকের স্বপ্ন ছিল একটি শোষণ-বঞ্চনামুক্ত গণতান্ত্রিক এবং অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনের। যেখানে সব ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি-পেশার মানুষ সুখে-শান্তিতে বসবাস করবে। প্রতিটি মানুষ অন্ন-বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসার সুযোগ পাবে।’

বঙ্গবন্ধু যখন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে পুনর্গঠন করে সেই স্বপ্ন পূরণের পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন, ঠিক তখন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ‘মুক্তিযুদ্ধবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি’ যে তাকে সপরিবারে হত্যার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল, সে কথাও শেখ হাসিনা বলেন।

‘তারপর অনেক চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র। সামরিক শাসনের জাঁতাকলে নিষ্পেষণ, গণতন্ত্রহীনতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-বিচ্যুতি, ইতিহাস বিকৃতিসহ শাসকদের নানা অপকীর্তি প্রত্যক্ষ করেছে এ দেশের মানুষ। জনগণের সম্পদ লুটপাট করে, তাদের বঞ্চিত রেখে, ৩০ লাখ শহীদের রক্তের সঙ্গে বেঈমানি করে বাংলাদেশকে পরনির্ভরশীল করে রেখেছিল।’

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ছয় বছর নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে ১৯৮১ সালে দেশে ফেরেন শেখ হাসিনা। তার নেতৃত্বে দীর্ঘ ২১ বছর ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় ফেরে আওয়ামী লীগ।

‘আমরা দায়িত্ব নিয়েই বাংলাদেশকে একটি আত্মমর্যাদাশীল দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করি। মাঝখানে ২০০১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সে প্রচেষ্টায় ছেদ পড়েছিল।

‘কিন্তু ২০০৯ সালে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের পর আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১২ বছরের শাসনামলে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে একটি আত্মমর্যাদাশীল দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। আর্থ-সামাজিক এবং অবকাঠামো খাতে বাংলাদেশের বিস্ময়কর উন্নয়ন সাধিত হয়েছে।’

আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, ২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচনে ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’ শীর্ষক ইশতেহার নিয়ে তার দল ক্ষমতায় এসেছিল। সেই ইশতেহারের মূল প্রতিপাদ্য ছিল দক্ষ, সেবামুখী ও জবাবদিহিতামূলক প্রশাসন গড়ে তুলে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ নির্মূল করে একটি ক্ষুধা-দারিদ্র্য-নিরক্ষরতা মুক্ত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণ করা।

‘২০৩১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে উচ্চ মধ্যম-আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উচ্চ আয়ের সমৃদ্ধশালী-মর্যাদাশীল দেশ। আমরা ২০২১ সালের পূর্বেই উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছি। প্রত্যাশিত লক্ষ্যে পৌঁছতে আমরা পথ-নকশা তৈরি করেছি। রূপকল্প ২০৪১-এর কৌশলগত দলিল হিসেবে দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০২১-৪১ প্রণয়ন করা হয়েছে।’

তিনি বলেন, গত সপ্তাহে ২০২১-২৫ মেয়াদি যে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুমোদন পেয়েছে, তাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৪ লাখ ৯৫ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে এক কোটি ১৬ লাখ ৭০ হাজার কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে, দারিদ্র্যের হার ১৫ দশমিক ছয় শতাংশে এবং চরম দারিদ্র্যের হার সাত দশমিক চার শতাংশে নেমে আসবে। ২০২৫ সালে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়াবে আট দশমিক ৫১ শতাংশে।

জলবায়ুর পরিবর্তনের ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবিলা করে কাক্সিক্ষত উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য সরকার যে ব-দ্বীপ পরিকল্পনা নিয়েছে এবং মহামারির মধ্যেও পদ্মা সেতুর মূল কাঠামোর কাজ শেষ করতে পেরেছে, সে কথাও প্রধানমন্ত্রী বলেন। 

তিনি বলেন, ‘আশা করা হচ্ছে, আগামী বছর এই স্বপ্নের সেতু যানবাহন এবং রেল চলাচলের জন্য উম্মুক্ত করে দেয়া সম্ভব হবে।’

এছাড়া মেট্রো রেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, কর্ণফুলী টানেলসহ বড় উন্নয়ন প্রকল্পের অগ্রগতির তথ্যও ভাষণে তুলে ধরেন শেখ হাসিনা।

তিনি বলেন, ‘জনগণের সরকার হিসেবে মানুষের জীবনমান উন্নয়ন করা আমাদের দায়িত্ব এবং কর্তব্য বলেই আমি মনে করি। গত একযুগে আমরা জনগণের জন্য কী করেছি, তা মূল্যায়নের ভার আপনাদের।’

মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করে সে রকম কয়েকটি খাতের কথা তিনি সংক্ষেপে তুলে ধরেন ভাষণে।

এ সময় বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নয়ন, খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ং-সম্পূর্ণতা অর্জন, গ্রামাঞ্চলে নাগরিক সুবিধা পৌঁছে দেয়া, যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়ন, স্বাস্থ্য খাতে ‘ইতিবাচক পরিবর্তন’ আসার মতো বিষয়গুলো তিনি পরিসংখ্যানসহ বর্ণনা করেন।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০