অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব: আইনশৃঙ্খলা উন্নয়ন ও অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে করণীয়

মো. মাঈন উদ্দীন: অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম দায়িত্ব হবে দেশের আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন করা। আইনশৃঙ্খলা উন্নয়নের পাশাপাশি দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য সচল করা। মানুষের মধ্যে স্বস্তি ফিরিয়ে আনা। আমদানি রপ্তানিতে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা। নতুন বাংলাদেশ, বৈষম্যহীন দুর্নীতিমুক্ত গণ-আকাক্সক্ষার বাংলাদেশ গঠনের প্রত্যয় নিয়ে নতুন প্রজš§ যে গণজাগরণ সৃষ্টি করেছে তাকে সবাই দ্বিতীয় স্বাধীনতা উল্লেখ করেছে। এ দ্বিতীয় স্বাধীনতার সুফল এবং সুফল অর্জনের জন্য এ সরকারকে কাজ করতে হবে। যদিও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় কতদিন, তা এখনও পরিষ্কার নয়। তবুও অন্তর্বর্তীকালীন নাম যেখানে রয়েছে, সেখানে তারা সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা দিয়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা ও অর্থনীতি পুনর্গঠনের কাজগুলো স্বল্পসময়ের মধ্যে স্বচ্ছতার সঙ্গে করবে। আমাদের অর্থনীতিতে অনেক ক্ষত তৈরি হয়েছে। কার্পেটের নিচে অনেক ময়লা। উল্টালেই দুর্গন্ধ বের হবে। তাই এসব ময়লা দূর করতে হলে আগে আইনশৃঙ্খলার পরিবেশ ঠিক করা চাই। সৎ অফিসারদের উপযুক্ত পদে বসাতে হবে। অর্থপাচার রোধ করতে হবে। কালোবাজারি ও খেলাফি গ্রাহকদের মুখোশ উšে§াচন করতে হবে। দেশপ্রেমিক ও অভিজ্ঞ চৌকস অফিসারদের উপযুক্ত পদে আসীন করতে হবে। নতুন অন্তর্বর্তী সরকারকে যে কয়েকটি বিষয় গুরুত্ব দেয়া উচিত তা হলো আইনশৃঙ্খলার উন্নয়ন ও অর্থনীতির পুনরুদ্ধার।

ব্যাংক খাতের শৃঙ্খলা, ব্যাংকিং কমিশন গঠন, আমদানি-রপ্তানি স্বাভাবিক পরিবেশ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের দিকে নজর দেয়া। রাজস্ব আহরণের স্বচ্ছতা আনা, বাজারে সাপ্লাই চেইন ঠিক রাখা, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি রোধ করা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা। ধাপে ধাপে বিভিন্ন সেক্টরে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা। পরিশেষে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। এসব কাজ করতে প্রয়োজন একটি নির্দিষ্ট সময়। প্রয়োজন জনগণের সহযোগিতা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আন্তরিক সহযোগিতা। অর্থনীতির যে ক্ষত তৈরি হয়েছে তার এত সহজে কাটবে না এর জন্য তাৎক্ষণিক, স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এজন্যই দেশের পেশাজীবী, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, সুশীল সমাজ, অর্থনীতিবীদ, গবেষক ও অভিজ্ঞ সচিবদের সঙ্গে মতবিনিময় করা যেতে পারে। অর্থনীতি পুনরুদ্ধার ও নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা রয়েছে। মোটামুটি গুরুত্বপূর্ণ ও চ্যালেঞ্জগুলো হলোÑএকটি সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে এনে নির্বাচনের জন্য ময়দান তৈরি করে সুষ্ঠু, অবাধ, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করা।

যেহেতু সরকার অন্তর্বর্তীকালীন তাই সব সমস্যা এ সরকারের সমাধান করা সম্ভব নাও হতে পারে। তারা অন্তত একটি। একটি কাঠামো দাঁড় করিয়ে দিতে পারলে পরবর্তী রাজনৈতিক সরকার তা সমাধান করতে সহজ হবে। আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার: আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের প্রথম দাবি হলো বৈষম্যের অবসান। এ বৈষম্য দূর করতে হবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। নতুন অন্তর্বর্তী সরকার প্রথমে আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার করতে হবে। প্রত্যেক থানায় ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে থানার ওসিসহ কমিটি গঠন করতে পারেন। এলাকার চাঁদাবাজ, চোর, মাস্তানরা যাতে পালিয়ে যেতে না পারে সেদিকে নজর রাখতে হবে। তাদের ধরে এনে আইনের আওতায় আনতে হবে। সড়কের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। ট্রাফিক ব্যবস্থার পুনর্গঠন করতে হবে। ভালো কাজের পুরস্কারের ব্যবস্থা থাকা চাই। দেশপ্রেম, জবাবদিহি ও রিওয়ার্ড অপরাধ দমনের উৎসাহ হিসেবে কাজ করতে পারে। সরকারের একটি বড় কাজ হচ্ছে ১৫ বছরের যারাই মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে, হত্যা, খুন-গুম ও এসবের নির্দেশ দিয়েছে তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।

অর্থনীতি পুনরুদ্ধার: অর্থনীতির অবস্থা টালমাটাল। অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অনেক খাতে দুর্নীতি ছেয়ে গেছে। দেশের অর্থনীতির প্রকৃত অবস্থা এতদিন আড়ালে ছিল। এগুলো এখন পর্যায়ক্রমে বের হচ্ছে, সরকারের উচিত অর্থনীতির ক্ষতগুলো চিহ্নিত করে কোন কোন সেক্টরে বেশি ক্ষতি হয়েছে, তা জরুরিভাবে সেগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের ব্যবস্থা করা। ব্যাংক খাতে সংস্কার: ব্যাংক খাত হলো অর্থনীতির মেরুদণ্ড। বিগত সরকার এই মেরুদণ্ডকে ভেঙে দিয়েছে। বর্তমানে ব্যাংকগুলোয় তারল্য সংকট বিরাজ করছে। ভুগছে মানুষের আস্থার সংকটে। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব হবে ব্যাংকিং কাজে অনতিবিলম্বে সুশাসন ফিরিয়ে আনা। খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য দক্ষ ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা। দুর্বৃত্তদের ব্যাংকের বিভিন্ন পদ থেকে বিদায় করা। আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য স্বাভাবিক করা। বড় ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষার পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষার ব্যবস্থা করা। গ্রামীণ অর্থনীতির প্রতি নজর দেয়া উচিত। তৈরি পোশাক ও এ খাতে সাপ্লাই চেইন ঠিক করা। পত্রিকা থেকে জানা গেছে, সাড়ে ১৫ বছরের সরকারের ঋণ সাড়ে ১৫ লাখ কোটি টাকারও বেশি। পাচার হয়েছে ১৫০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। ২০০৯ থেকে ২০২৩-এ এই পর্যন্ত পাচার হয়েছে ১৭ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। অর্থনীতিতে সমস্যাগুলো যত দ্রুত সম্ভব সমাধান করতে হবে। অর্থনীতির খাতগুলো চিহ্নিত করে যতটুকু সম্ভব সমাধান করার চেষ্টা করা উচিত।

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের যে হিসাব রয়েছে তাও ঠিক করা উচিত। বৈদেশিক রিজার্ভ এখন থেকে আশা করি, বাড়বে তবে বিগত দিনগুলোয় যেসব সমস্যা সৃষ্টি হয়েছিল তা যাতে না হয় সে ধরনের ইমেজ তৈরি করা উচিত। বাংলাদেশের অর্থনীতি আর একটি সমস্যা হলো কাক্সিক্ষত মানের রাজস্ব আদায় না হওয়া। কোনো বছরেই রাজস্ব আদায় সঠিক লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী হয় না। কাক্সিক্ষত হারে রাজস্ব আদায় না হওয়ায় সরকার উন্নয়ন কার্যক্রমের ব্যাহত হয়। ফলে সরকারি ও বেসরকারি উৎস থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে। অতিমাত্রায় ঋণ গ্রহণ কোনো অবস্থাতেই কাম্য নয়। বিগত সরকারের বাজার সিন্ডিকেট, সড়কে চাঁদাবাজি, অবৈধ দালাল ও মধ্যস্বত্বভোগীর অধিক বিস্তার ছিল। বাজার ব্যবস্থাপনা সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি ছিল। এখন এ পরিস্থিতিতে সড়কের চাঁদাবাজি, পরিবহন ব্যবস্থায় গতিশীলতা এবং সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য থেকে জাতিকে রক্ষা করতে হবে। কঠোর হস্তে দমন করতে হবে চাঁদাবাজদের। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো তথ্য অনুযায়ী খাদ্যের মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশ ছাড়িয়েছে, ৩৮ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ঘাটতি নিয়ে অর্থবছর ২০২৩-২৪ শেষ করেছে সরকার। বিদেশি ঋণের কিস্তির পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ হওয়ায় আইএমএফের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি পাওয়ার পরও রিজার্ভের পতন ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না। শুধু তাই নয়, সামষ্টিক অর্থনীতির অন্যান্য সূচকগুলো ও নেতিবাচক ধারাতে রয়েছে অনেক দিন ধরে। একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ক্রমহ্রাসমান কর-জিডিপি অনুপাত। কর-জিডিপি অনুপাত কমতে কমতে ৮ শতাংশের নিচে নেমে গেছে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন। কর-জিডিপির অনুপাত কমতে থাকায় বাজেটের ব্যয়-সংকুলানের জন্য সরকারি ঋণের বোঝা দিন দিন বাড়ছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে বিদেশি কনস্ট্রাকটরদের অর্থ যা এখনও পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি।

এদিকে বিদেশি এয়ারলাইনসগুলোও আমাদের থেকে অর্থ পাবে। বিদেশ থেকে আমরা যে বিদ্যুৎ আমদানি করছি, সে ক্ষেত্রেও কিছু অংশ বকেয়া রয়েছে। এগুলো তো বাংলাদেশকে শোধ করতে হবে। শোধ করতে গেলে বাংলাদেশের রিজার্ভের ওপর যে চাপ পড়বে, তা আমাদের সামলাতে হবে। বছর শেষে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৭৩ শতাংশ। ২০২৩ অর্থবছরের মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৩০ শতাংশ। ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাংকের খাদ্য মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় বাংলাদেশকে লাল তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। বর্তমানে পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ আমদানি-রপ্তানির রেমিট্যান্স আহরণে যে ঘাটতি দেখা দিয়েছিল তা পুনরুদ্ধারের জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া উচিত। বাংলাদেশ ব্যাংক ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যে বৈদেশিক বাণিজ্যের যে হিসাব তাতে অনেক গরমিল রয়েছে। এতে অর্থনীতির অনেক হিসাবই পরিবর্তন হয়ে যাবে। যেমন ব্যালান্স অব পেমেন্ট, ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টেও প্রভাব পড়বে। প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয়ের হিসাবেও পরিবর্তন আসবে। আমাদের রিজার্ভ বৃদ্ধি করতে হলে বৈদেশিক বাণিজ্যের সমস্যা ও তা দূর করতে হবে। অর্থপাচার রোধ করতে হবে। বৈধ পথে রেমিট্যান্স আনতে হবে। এতদিন স্বৈরতান্ত্রিক ধারায় দেশ চলে আসছিল।

তবে গণতান্ত্রিক ধারা ফিরিয়ে আনার কাজটি অত্যন্ত কঠিন। নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস সঠিকভাবে কাজ করবেন এবং গণতান্ত্রিক ধারা ফিরে আনবেন বলেই প্রত্যাশা। আমরা বিশ্বাস করি, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর পুনর্গঠনের মাধ্যমেই দেশকে একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে আনার কাজে নতুন সরকার সফল হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে দীর্ঘদিন স্বৈরশাসন ও তিন দফা ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ায় জনগণ বঞ্চিত হওয়ার ক্ষোভ থেকে ছাত্র ও জনতা গণঅভুত্থান ঘটিয়ে হাসিনা সরকারকে বিদায় দিয়েছে। ফলে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনাই হবে এ সরকারের মূল লক্ষ্য। একটি নতুন বাংলাদেশ, শোষণমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠবেÑএটাই সবার প্রত্যাশা।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০