অন্ধকারাচ্ছন্ন পথে দেশের বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাত!

ইসমাইল আলী: জ্বালানি সংকট নিয়ে কিছুদিন ধরেই আলোচনা চলছে। আন্তর্জাতিক বাজারে ঊর্ধ্বমুখী থাকার জন্য বড় অঙ্কের লোকসান ছাড়াও ডলার সংকটে জ্বালানি তেল আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। এজন্য কৃচ্ছ সাধন নীতির কথা বলা হচ্ছিল। পাশাপাশি বিদ্যুৎ খাতে গ্যাস-তেল সরবরাহ কমিয়ে লোডশেডিং শুরু করা হয়। তাতেও জ্বালানি সংকট নিরসনে খুব একটা সুবিধা হয়নি।

এদিকে উচ্চ মূল্যের তেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে কম দামে বিক্রি করায় এ খাতেও লোকসানের বোঝা ভারী হচ্ছে। পাশাপাশি বেড়ে গেছে ক্যাপাসিটি চার্জের বোঝা। সরকার ভর্তুকি বন্ধ করে দিয়েছে বিদ্যুৎ খাতে। এতে বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে পারছে না বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। সব মিলিয়ে বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে অনেকটা অন্ধকারাচ্ছন্ন পথের সম্মুখীন বাংলাদেশ।

পরিস্থিতি পর্যালোচনা ও আশু করণীয় নির্ধারণে গতকাল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাত সংশ্লিষ্টদের। এতে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং ছাড়াও সপ্তাহে এক দিন পেট্রোল পাম্প বন্ধ রাখাসহ একগুচ্ছ সিদ্ধান্ত হয়। পাশাপাশি তেলের ব্যবহার কমাতে ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়।

পিডিবির তথ্যমতে, গতকাল পর্যন্ত ডিজেলচালিত সাতটি বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু ছিল। এর মধ্যে বেসরকারি খাতে ছয়টি ও একটি সরকারি। বেসরকারি ছয়টি ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা এক হাজার মেগাওয়াট। আর সরকারি কেন্দ্রটির সক্ষমতা ২২৫ মেগাওয়াট। গতকালের বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আজ থেকে বন্ধ হচ্ছে এক হাজার ২২৫ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র। ফলে বিদ্যুৎ সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেবে, বাড়বে লোডশেডিং।

ঘাটতি সমন্বয় করতে আপাতত দিনে এক ঘণ্টা করে লোডশেডিংয়ের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তিনি বলেন, ‘আমরা মঙ্গলবার থেকে শুরু করব। এক সপ্তাহ দেখব। যদি দেখি এক ঘণ্টায় হচ্ছে, ফাইন। চেষ্টা করব পিক ও অফ পিকের জায়গাটা দেখার জন্য। আমরা যদি দেখি পিকের জায়গায় এক ঘণ্টা দিলে কভার করতে পারব, ফাইন। আর যদি দেখি, অফ পিকের জায়গায় এক ঘণ্টা দিলে কভার হচ্ছে, তাহলে সেটাই করব।’

প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘এলাকাভিত্তিক আমরা সারা বাংলাদেশে যদি এক ঘণ্টা লোডশেডিং দিই, আমার মনে হয় না তেমন সমস্যা হবে।’ তবে শিল্প ও বাণিজ্যে বিদ্যুৎ সরবরাহে অগ্রাধিকার দেয়া হবে তিনি জানিয়েছেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে কয়লায় ৭ দশমিক ৮৯ শতাংশ, গ্যাসে ৫০ দশমিক ৮৪ শতাংশ, ফার্নেস অয়েলে ২৮ শতাংশ ও ডিজেলে ছয় শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে। তবে ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রে গড় উৎপাদন ব্যয় অনেক বেশি। এসব কেন্দ্রে শুধু জ্বালানি ব্যয়ই পড়ে ১৮-২০ টাকা।

যদিও ডিজেলচালিত কেন্দ্রগুলো বন্ধ রাখলে শুধু জ্বালানি তেল সাশ্রয় হবে, তবে ক্যাপাসিটি চার্জ থেকে মুক্তি পাচ্ছে না সরকার। পিডিবি জানায়, বেসরকারি খাতের ছয়টি ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য বছরে প্রায় এক হাজার ৭৫০ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হয়। এসব কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ রাখলেও ক্যাপাসিটি চার্জ ঠিকই পরিশোধ করতে হবে। এতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় পড়বে অনেক বেশি।

এদিকে জ্বালানি তেলে দাম বাড়তে থাকায় বিদ্যুৎ খাতে ক্রমাগত ভর্তুকি বেড়েই চলেছে। ২০২০-২১ অর্থবছর এ খাতে ভর্তুকি দেয়া হয়েছিল ১১ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকা। তবে ২০২১-২২ অর্থবছর জানুয়ারি পর্যন্ত সাত মাসেই ভর্তুকি দেয়া হয় ১২ হাজার কোটি টাকা। এরপর বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি দেয়া বন্ধ রাখে সরকার। এতে সংকটে পড়ে পিডিবি। নগদ তহবিল সংকটে গত মার্চ থেকে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল পরিশোধ করতে পারছে না সংস্থাটি। এতে দেড় বিলিয়ন ডলার (১৪ হাজার কোটি টাকা) বিল বকেয়া পড়ে গেছে বেসরকারি কেন্দ্রগুলোয়।

বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বিল দ্রুত পরিশোধের দাবি জানিয়ে সম্প্রতি পিডিবিকে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিপ্পা)। সংগঠনটি জানায়, ৬০ শতাংশ বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র ফেব্রুয়ারির বিল পেয়েছে। আর মার্চ থেকে কোনো কেন্দ্রই বিল পায়নি। তবে সে সময় ডলারের দর ছিল ৮৫ টাকা। এখন তা বেড়ে প্রায় ৯৪ টাকা হয়ে গেছে। এ নিয়ে জটিলতা বাড়ছে।

যদিও বিদ্যুৎ খাতের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে এসব বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র। পিডিবির তথ্যমতে, বর্তমানে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য মাসে প্রায় এক হাজার ৮০০ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হচ্ছে, এক বছর আগেও যা ছিল এক হাজার ৫০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ বেড়েছে ২০ শতাংশ। ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়ে আজ জাতীয় সংসদ ভবনে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটি জরুরি বৈঠক ডেকেছে।

পিডিবির হিসাবমতে, বিদায়ী অর্থবছর পিডিবিকে ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হয়েছে ২১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। আর এ বোঝা বইতে গিয়ে ২০২১-২২ অর্থবছর পিডিবির লোকসান ছাড়িয়ে যাবে ২০ হাজার কোটি টাকা। তবে ২০২০-২১ অর্থবছরে পিডিবির লোকসান ছিল ১১ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ বিদায়ী অর্থবছর পিডিবির লোকসান বেড়েছে প্রায় ৭০ শতাংশ।

এদিকে বিদ্যুতের পাশাপাশি জ্বালানি খাতেও সংকট ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) জ্বালানি তেলের মজুত ক্রমেই কমে যাচ্ছে। বর্তমানে জ্বালানি তেলের মজুত কমে ৪০ দিনের নিচে নেমে গেছে। সাধারণত বিপিসি ৪০-৪৫ দিনের মজুত রাখে। তবে সংকট কাটাতে সহজ কোনো পথ পাচ্ছে না বিপিসি। জ্বালানি আমদানি করতে গিয়েও বিপাকে পড়েছে সংস্থাটি। ডলার সংকটে এলসি খুলতে পারছে না বিপিসি। এতে জ্বালানি তেল আমদানি ব্যাহত হচ্ছে।

বিপিসির তথ্যমতে, সারাদেশে যে ডিজেল ব্যবহার করা হয়, তার মধ্যে ১০ শতাংশ যায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে। বাকি ৯০ শতাংশ পরিবহনসহ অন্যান্য খাতে। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘বিদ্যুতের ১০ শতাংশ ও অন্যন্য খাত থেকে আরও ১০ শতাংশÑমোট এই ২০ শতাংশ ডিজেল সাশ্রয় করতে পারলে যে পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা আমরা সেভ করতে পারব, এটা অনেক বড় বিষয় হবে।’

তিনি বলেন, ‘এ সিদ্ধান্ত আমরা না নিলে সারা বছর এই ১০ শতাংশ ডিজেলের যে দাম দিই, সেই মূল্য তো আমরা বিদ্যুৎ থেকে পাব না। ডিজেল থেকে যে বিদ্যুৎ হয়, তা ৩৫ থেকে ৪০ টাকার মতো পড়ে প্রতি ইউনিট। আর বিদ্যুৎ বিক্রি করছি গড়ে প্রায় সাত টাকায়।’ ডিজেল আমদানি কমালে ভর্তুকির খরচও কমবে হবে বলে মন্তব্য করেন নসরুল হামিদ।

যদিও জ্বালানি তেলে বড় ধরনের লোকসান গুনছে বিপিসি। সংস্থাটির তথ্যমতে, বর্তমানে প্রতি লিটার ফার্নেস অয়েলে লোকসান হয় ১৫ টাকা, অকটেনে ৩৭ ও ডিজেলে ৫৭ টাকা। বর্তমানে এ তিন ধরনের জ্বালানি তেলের বিক্রয়মূল্য যথাক্রমে ৭৪ টাকা, ৮৯ টাকা ও ৮০ টাকা। আর তাই কম দামে তেল বেঁচে বিপিসি দৈনিক লোকসান গুনছে ১০০ কোটি টাকার বেশি।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০