Print Date & Time : 25 June 2025 Wednesday 1:29 pm

অন্যের সম্পত্তি দেখিয়ে ঋণ নিয়ে প্রতারণা

সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: পটিয়ার অখ্যাত ব্যবসায়ী শাহজাহান চৌধুরী, যিনি ডিনার স্টিল রি-রোলিং মিলের স্বত্বাধিকারী। ব্যবসার প্রয়োজনে ২০১৫ সালে তিনি সিটি ব্যাংক লিমিটেড আগ্রাবাদ শাখা থেকে ঋণ সুবিধা নেন। ওই সময় অন্যের মালিকানাধীন তিনটি ফ্ল্যাটকে বন্ধক দেখিয়ে এ ঋণ নেন তিনি।

সাম্প্রতিক সময়ে পাওনা পরিশোধে একাধিকবার ব্যর্থ হন শাহজাহান চৌধুরী। এতে খেলাপি পাওনা দাঁড়িয়েছে ২৭ কোটি ৫০ লাখ। পাওনা আদায়ে ব্যাংক বন্ধকি সম্পত্তি বিক্রয়ে নিলাম বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর প্রতারণার তথ্য সামনে আসে। এ ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেন ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা।    

সিটি ব্যাংক লিমিটেড সূত্রে জানা যায়, ইস্পাত খাতের প্রতিষ্ঠান ডিনার স্টিল রি-রোলিং মিল। নিয়মিত পাওনা পরিশোধের ব্যর্থতায় সম্প্রতি ঋণ খেলাপি গ্রাহকে পরিণত হয়। প্রতিষ্ঠানটির কাছে গত ১৬ মে পাওনা দাঁড়িয়েছে ২৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা। আর এ খেলাপি পাওনা আদায়ে সিটি ব্যাংক লিমিটেডের স্পেশাল অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট ডিভিশন ঋণের বিপরীতে শাহজাহান চৌধুরীর মালিকানাধীন পটিয়া জিরি, চট্টগ্রাম মহানগরের কোতোয়ালিতে ভবন (চারটি ফ্ল্যাট ছাড়া) এবং সীতাকুণ্ড উপজেলায় ভাটিয়ারী মৌজায় ২৭৪ ডিসিমেল জমি নিলামে বিক্রয়ের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। আগামী ২৬ জুন ব্যাংকটির গুলশান-২-এ অবস্থিত প্রধান অফিস স্পেশাল অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট ডিভিশনে অনুষ্ঠিত হবে। এতে আগ্রহী ক্রেতা বা প্রতিষ্ঠান এ নিলামে অংশগ্রহণ করতে পারবেন।

অন্যদিকে এ নিলাম বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর চট্টগ্রাম মহানগরের কোতোয়ালি থানার আশরাফ আলীর রোডের ফিরোজা টাওয়ার ভবনের বাসিন্দা দিদারুল ইসলামের পক্ষে আইনজীবী তারিক আহমেদ একটি লিগ্যাল নোটিস দেয় ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে। এ লিগ্যাল নোটিসে বলা হয়, ব্যাংকের প্রকাশিত নিলাম বিজ্ঞপ্তিতে ৬নং তফসিলে চট্টগ্রাম মহানগরের কোতোয়ালি থানার আশরাফ আলীর রোডের ফিরোজা টাওয়ার ভবনের বেশ কিছু জমি তিনটি রেজিস্ট্রি দলিল মূলে আলাদা আলাদা তিন দলিলে তিনটি ফ্ল্যাট কিনে নেয়। এর মধ্যে ২০১৫ সালের ২৬ জানুয়ারি দ্বিতীয় তলায় এক হাজার ২৬৯ বর্গফুটের দুটি ফ্ল্যাট এবং ২০১৪ সালের ৭ এপ্রিল চার তলায় এক হাজার ২৬৯ বর্গফুটের (এ-৪) ফ্ল্যাটটি নিবন্ধন নেন। অথচ এ খেলাপি ব্যক্তি ২০১৫ সালের ৭ ডিসেম্বর ঋণের বিপরীতে ব্যাংকে এসব ফ্ল্যাট বন্ধকি দেন, যা স্থানান্তরযোগ্য আইনের ৫৫ ধারায় ব্যাংকের বন্ধকি দলিল অকার্যকর। একই সঙ্গে শাহজাহান চৌধুরী ব্যাংকের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন, যা দণ্ডনীয় অপরাধ।

এ বিষয়ে দিদারুল ইসলামের আইনজীবী তারিক আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, ‘অন্যের সম্পত্তি ব্যাংক কীভাবে নিলামে তোলে? এখানে ব্যাংকের উদাসীনতা আছে। তাদের সম্পত্তি বন্ধকি নেয়ার সময় ভালো করে খোঁজ-খবর নেয়া উচিত ছিল। এ নিলাম বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের কারণে আমার মক্কেলের সামাজিকভাবে সুনাম হানি হয়েছে। ব্যাংক যদি নিলামে আমার মক্কেলের অংশ বাদ না দেয়, তাহলে আমরা ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করব। একই সঙ্গে আমরা শাহজাহান চৌধুরীর বিরুদ্ধে ৪২০ ধারায় মামলা করেছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘এমনিতে আমার মক্কেল করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত। তিনি এ ফ্ল্যাটগুলো বন্ধক রেখে অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে।’     

এ বিষয়ে ডিনার স্টিল রি-রোলিং মিলের স্বত্বাধিকারী শাহজাহান চৌধুরী শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমাকে সিটি ব্যাংক লিমিটেড এ মিলটা কিনে দিয়ে বিপদে ফেলে দিয়েছে। আমি ১০ কোটি টাকার মতো পরিশোধ করেছি। আর এ মিলটা নেয়ার পর আমি পরিচালনা করতে পারিনি। যদিও আমি ঋণ রি-শিডিউল করার জন্য প্রস্তাব দিয়েছি। এর মধ্যে নিলামে তুলেছে বন্ধকি সম্পত্তি। আর সম্পত্তির মধ্যে দিদার সাহেবের কিছু অংশ সিটি ব্যাংক যুক্ত করেছে। আমি ব্যাংককে বলেছি তার অংশটা ফ্রি করে দেয়ার জন্য।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমি মিলটা বিক্রয় করার জন্য আমি একজন বড় ব্যবসায়ীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তিনি কিনবেন বলে কথা দিয়েছেন। আগামী তিন-চার মাসের মধ্যে বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়ে যাবে। আর দিদার সাহেবের সঙ্গে আমার সুসম্পর্ক আছে। তাকে আমি বুঝিয়ে বলেছি। তবুও তিনি মামলা করেছেন।’

সিটি ব্যাংক লিমিটেড বন্ধকি সম্পত্তি নিয়ে প্রতারণার শিকার হয়েছেন ব্যাংকটির দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তা স্বীকার করে বলেন, ‘ডিনার স্টিল রি-রোলিং মিলের মালিক শাহাজাহন চৌধুরী আমাদের সঙ্গে বন্ধকি সম্পত্তি নিয়ে প্রতারণা করছেন। ঋণের বিপরীতে আরেকজনের সম্পত্তি তিনি ব্যাংকে বন্ধক দিয়েছেন, যা আইনগতভাবে অবৈধ। মূল বন্ধকি সম্পত্তির কিছু অংশ তিনি আগেই বিক্রি করেছিলেন। তিনি একদিকে খেলাপি, অন্যদিকে অন্যের সম্পত্তি ভুয়া বন্ধক দিয়ে প্রতারণা করেছেন। তিনি ডাবল অপরাধ করেছেন।’

তারা আরও বলেন, সীতাকুণ্ড এলাকায় ভাটিয়ারীতে কনটেইনার ডিপো পোর্ট লিংকের পাশে অবস্থিত ডিনার স্টিল রি-রোরিং মিল। এ মিলটি আগেই সিটি ব্যাংকের আরেকজন খেলাপি গ্রাহকের প্রতিষ্ঠান ছিল। মিলটি ২০১৫ সালে খেলাপি ঋণের দায়ে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ গ্রাহকের সম্মতিতে শাহজাহান চৌধুরীর কাছে বিক্রয় করে দেন ব্যাংক কর্তৃপক্ষ, যা পরে ডিনার স্টিল থেকে ডিনার স্টিল রি-রোলিং মিল নামে পরিচালনায় আসেন শাহজাহান চৌধুরী। শাহজাহান চৌধুরী মূলত ছিল জমি বিক্রিয়ের ব্রোকার টাইপের ব্যক্তি। এ ব্যবসায় বেশ কিছু টাকা আয় করেছেন। তা দিয়ে মূলত এ মিলটি কিনে নেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি সফল হতে পারেননি। এবার তিনিও খেলাপি হলেন।