অপচর্চার করালগ্রাসে বাংলা যেখানে প্রশ্নবিদ্ধ

মাতৃভাষী মোট জনসংখ্যার ভিত্তিতে বাংলা পৃথিবীর ষষ্ঠ বৃহত্তম ভাষা। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের এই আদি ভাষা বহু বিবর্তনের মধ্য দিয়ে আজকের এই বাংলা ভাষায় পরিণত হয়েছে। বর্তমানে এটি বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা। বাংলাদেশের জীবনযাত্রার প্রায় সর্বক্ষেত্রেই বাংলা ভাষা ব্যবহারের বিষয়টি সরকারিভাবে বাধ্যতামূলক। এছাড়া ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা প্রদেশের অন্যতম দাপ্তরিক ভাষা এই বাংলা। বঙ্গোপসাগরের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের প্রধান মুখের ভাষাও এ বাংলা। এ ছাড়া ভারতের ঝাড়খণ্ড, বিহার, মেঘালয়, মিজোরাম, উড়িষ্যা রাজ্যগুলোতেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাংলাভাষী মানুষ রয়েছে। সবমিলিয়ে বর্তমানে পৃথিবীতে প্রায় ৩০ কোটিরও অধিক মানুষের মুখের ভাষা বাংলা। বাংলা ভাষা বিকাশের ইতিহাস ১৩০০ বছর পুরোনো। চর্যাপদ এই ভাষার আদি নিদর্শন। অষ্টম শতক থেকে বাংলায় রচিত সাহিত্যের বিশাল ভাণ্ডারের মধ্য দিয়ে অষ্টাদশ শতকের শেষে এসে বাংলা ভাষা তার বর্তমান রূপ পরিগ্রহণ করে।

বাংলা ভাষায় স্বাধীনভাবে কথা বলার পেছনে আছে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাস। ভাষা আন্দোলন ছিল ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব বাংলায় সংঘটিত একটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুারিতে এ আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করলেও, বস্তুত এর বীজ রোপিত হয়েছিল বহু আগে; অন্যদিকে, এর প্রতিক্রিয়া এবং ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী।

১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান ও ভারত নামে দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। প্রায় দুই হাজার কিলোমিটারের অধিক দূরত্বের ব্যবধানে অবস্থিত পাকিস্তানের দু’টি (পূর্ব ও পশ্চিম) অংশের মধ্যে সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক ও ভাষাগত দিক থেকে অনেকগুলো মৌলিক পার্থক্য ছিল।

অনেক ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এ ভাষা আজ বিপর্যয়ের মুখে। বেড়েই চলছে বিদেশি ভাষার দৌরাত্ম্য। বিশ্বের অন্য কোনো জাতিকে রক্ত ও জীবন দিয়ে মায়ের ভাষাকে কিনতে হয়নি। সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউরসহ আরও অনেকের আত্মত্যাগে সমৃদ্ধ আমাদের এই বাংলা ভাষা। ৫২-এর ঐতিহাসিক আত্মত্যাগকে ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। অথচ মাতৃভাষার প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদা রক্ষায় আমরা নির্লিপ্ত। ভুল উচ্চারণ, বাংলার সঙ্গে ইংরেজি শব্দ মিশিয়ে কথা বলা, লেখার ক্ষেত্রেও প্রচলিত শব্দের ভুল বানানের ব্যবহার এবং সংশোধনের প্রতি চরম উদাসীনতা প্রভৃতি বাংলা ভাষার অপচর্চার উদাহরণ। ইংরেজির প্রয়োজন আছে, কিন্তু এতটা নগ্নভাবে নিশ্চয়ই নয়। ইদানীং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও বাংলা ভাষা ব্যবহার হচ্ছে যাচ্ছেতাইভাবে। বাংলা ভাষাকে বিকৃত করে লেখা হচ্ছে ইংরেজি ভাষায়। ইংরেজি বর্ণে বাংলা বাক্য লিখে খুদে বার্তা বা মেসেজ পাঠানোর মাধ্যমে নিত্য মাতৃভাষার অবমাননা চলছে।

আজকাল সবাই ডুবে আছে হিন্দি চলচ্চিত্র আর সিরিয়ালে। নিজেরাই যদি বাংলা ভাষাকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন না করে বিদেশি ভাষার দিকে ঝুঁকে পড়ি তাহলে বাংলা ভাষার দিকে আঙুল তো উঠবেই। সাম্প্রতিক সময়ে এমনও অনেক মানুষ দেখা যায় যারা গুছিয়ে বাংলাটাই বলতে পারে না অথচ অনর্গল হিন্দি কিংবা ইংরেজি বলে যাচ্ছে। বাংলা ভাষার ইতিহাস বাঙালি জাতির গর্বের ইতিহাস, প্রতিবাদের ইতিহাস, পরাধীনতার শেকল ভাঙার ইতিহাস। মাতৃভাষার জন্য শহিদদের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া মায়ের ভাষা রক্ষায় কতটুকু সচেষ্ট আমরা। আজকাল দেখা যায়, কিছু টিভি চ্যানেল ও এফএম রেডিওতে বাংলা ভাষাকে বাংলা ও ইংরেজির মিশ্রণে বিকৃত করে উচ্চারণ করা হয়। এছাড়া নাটক, সিনেমা, সাহিত্য রচনায় ভাষার বিকৃতি চোখে পড়ে। অন্যদিকে পথে বের হলেই চোখে পড়ে ভুল বাংলা বানানে ভরা সাইনবোর্ডের আধিক্য। 

 ফেব্রুয়ারি এলেই মহাসমারোহে একুশ উদযাপনের তোড়জোড় শুরু হয়। নগ্ন পায়ে ফুল হাতে কণ্ঠে একুশের করুণ সুর তুলে প্রভাতফেরি করে ভাষাশহিদদের প্রতি সম্মান জানাই। কিন্তু শহিদরা অমূল্য প্রাণ বিসর্জনের বিনিময়ে আমাদের বিশ্বের দরবারে দিয়েছেন, তার মূল্যায়ন আমরা করি না। গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে আমরাই আবার বাঙালি বলে গর্ববোধ করি।

ভাষা আন্দোলন বাঙালির গর্ব ও আত্মপরিচয়। তাই ভাষার শুদ্ধ প্রয়োগ গুরুত্বপূর্ণ। ভাষার লালন-পালন করতে হবে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে। শুধু ফেব্রুয়ারি এলেই যেন আমরা শুদ্ধ বাংলার চর্চা না করি। শুদ্ধ বাংলার চর্চা হবে বছরের প্রতিদিন দিন, প্রতিটি মুহূর্ত। 

মো. আল-মামুন

শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০