Print Date & Time : 25 June 2025 Wednesday 4:09 pm

অপপ্রচারের মোক্ষম জবাব

শামসুন নাহার: রিলায়ান্সের বিরাট কলেবরের বিজ্ঞাপন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে তাদের অভিযোগ থেকে একবিন্দুও সরাতে পারেনি। এক্সপ্রেসের ভাষ্য, সরাসরি এফ সিরিজ ডিবেঞ্চার কেনেনি রিলায়ান্সের মালিকপক্ষ, কিনেছে অন্যান্য কোম্পানির মাধ্যমে। ওই ডিবেঞ্চার কেনার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে শাঙ্গরিলা, ভারনাল ও ম্যাক ইনভেস্টমেন্টের মতো কোম্পানি। আম্বানি ও মেসওয়ানি পরিবারের অনেকেই এসব ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার। নিজেরাই ডিবেঞ্চার কিনে নেওয়ার ব্যাপারটি যদি তারা অস্বীকার করতেই চায় তাহলে ঋণ নেওয়া অর্থ কী কাজে ব্যয় করেছে, তার জবাব দিক।

এর জবাব মিলেছিল লোন মেলার ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রঙ্গরজন কমিটির রিপোর্টে। এতে বলা হয়েছে, রিলায়ান্সের সঙ্গে জড়িত এমন ৪৩টি কোম্পানি ১৯৮৫ সালে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে মোট ৫৯ কোটি ৯৮ লাখ রুপি ঋণ নিয়েছে। এফ সিরিজের ডিবেঞ্চার কেনার পেছনে এ ঋণ ব্যয় করা হয়নি। রঙ্গরজন কমিটির রিপোর্ট স্বাভাবিকভাবেই রিলায়ান্সের অবস্থানকে অনেক শক্তিশালী করে তোলে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সাধারণত পক্ষপাতহীন হিসেবেই বিবেচিত। তাই এ রিপোর্টের গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি। রিলায়ান্সও তাৎক্ষণিকভাবে গণমাধ্যমে আরও জোর দিয়ে প্রচার করল যে, অবশেষে লোন মেলার অপবাদ থেকে মুক্তি পেয়েছে কোম্পানি।

কিন্তু এতেও কি ক্ষান্ত হয় ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস? তাদের দাবি, রঙ্গরজন কমিটি কেবল ভারতের অভ্যন্তরে তদন্ত করেছে। এ ঋণ যে আসলে ব্যাংক অব ইন্ডিয়া, ব্যাংক অব ওমান ও কানারা ব্যাংকের মাধ্যমে দেশের বাইরে রিলায়ান্স মনোনীত বিনিয়োগকারীদের হাতে গিয়ে পৌঁছেছেÑতার তদন্ত করেনি এ কমিটি। স্থানান্তরিত এ ঋণেরই পরিমাণ ছিল ৪৪ কোটি রুপি। এছাড়া এসব ঋণ দেওয়াও হয়েছে ঋণনীতির বরখেলাপ করে। কারণ সিকিউরিটি হিসেবে ধরা হয়েছে এমন ডিবেঞ্চার, যা আগে থেকেই ব্যাংকে সঞ্চিত ছিল না। এটিও আরেক অপরাধ।

মোট কথা, যতভাবেই জবাব দেওয়া হোক কোনো কিছুই থামাতে পারছিল না ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে।

ধীরুভাই তো সরাসরি গণমাধ্যমে জনগণের মুখোমুখি হয়েছেন। এবার তার প্রধান নয়াদিল্লি লবিস্ট ও কোম্পানির ভাইস প্রেসিডেন্ট ভি বালাসুব্রমানিয়াম চিঠি পাঠালেন এক্সপ্রেসের প্রধান কার্যালয়ে। ৬০ পৃষ্ঠার এ চিঠিতে অনেক প্রশ্নে জবাব দিয়েছেন তিনি। এর বেশিরভাগই অবশ্য ইতোমধ্যে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে। এতে তিনি লিখেছেন, দীর্ঘ ছয় মাস ধরে আপনার পত্রিকা ও সংশ্লিষ্ট ম্যাগাজিনের মাধ্যম রিলায়ান্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের বিরুদ্ধে ‘চরিত্র হননকারী’ অভিযান চালিয়ে যাচ্ছেন। এ সিরিজ রিপোর্টের প্রতিটি অনুমানই ভুল, প্রতিটি গল্পই সাজানো, মিথ্যা। এ বানোয়াট গল্পের পেছনে রয়েছে বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব। আপনাদের কল্পিত জুজু শিকার অভিযানের প্রতিটি পদক্ষেপে সাংবাদিকতার নীতিকে লঙ্ঘন করা হয়েছে। আপনারা ন্যায় ও সত্যের কথা প্রচার করেন। কিন্তু নিজেরাই একে অসম্মান করেছেন। কেননা ন্যায় ও সত্যের জন্য নয়, আপনারা এ ধরনের রিপোর্ট করছেন আমাদেরই এক প্রতিদ্বন্দ্বীকে খুশি করার জন্য, যার রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক স্বার্থরক্ষার আহ্বানে আমরা সাড়া দিইনি এবং যার স্বপ্রণোদিত বন্ধু হয়েছেন আপনাদেরই অপেশাদার, স্বঘোষিত সাংবাদিক!

বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমিয়ে দিয়ে রিলায়ান্সের ব্যবসাকে অস্থিতিশীল করাই এ অভিযানের মূল লক্ষ্য। যেখানেই সাহসের সঙ্গে আমাদের কোম্পানি বিনিয়োগ করেছে, তাতেই বানোয়াট গল্প তৈরি করেছে আপনাদের রিপোর্টার। এতে প্রতিপক্ষের ঈর্ষাই প্রকাশ পায়। এরপর নিশ্চয়ই আমাদের সবচেয়ে গৌরবময় পিটিএ প্রজেক্টের ওপরও কলঙ্ক লেপার চেষ্টা করা হবে। এমন একটি প্রজেক্টকে ডুবানোর চেষ্টা করা হবে, যাতে কি না সবচেয়ে অত্যাধুনিক তৃতীয় প্রজšে§র প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে এবং যার ফলে জাতীয় কোষাগার থেকে বেঁচে যাবে বার্ষিক প্রায় ৮০ কোটি রুপি মূল্যের বৈদেশিক মুদ্রা (পিটিএ আমদানি বাবদ)।

বালাসুব্রামানিয়াম আরও লিখেছেন, ডিবেঞ্চারকে শেয়ারে রূপান্তর করার ব্যবস্থাটি বরং বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ের হার কমাতে সহায়ক হয়েছে। আর প্রবাসী ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের যাবতীয় কর্মকাণ্ড কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা অনুসরণ করেই সম্পন্ন করা হয়েছে। সরকারের বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিয়াল পলিসি যদি রিলায়ান্সের জন্য লাভজনক হয়েই থাকে তাহলে তা হয়েছে আমাদের কঠোর পরিশ্রম ও বাজার গবেষণায় দক্ষতার কারণে। অন্যান্য কোম্পানিও এ লাইসেন্স পেয়েছে। তবে তাদের বিরুদ্ধে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস কেন রিপোর্ট লেখেনি, তা তারাই ভালো জানেন। এক্সপ্রেসের মতে, বিশেষ কোনো মন্ত্রীর (প্রণব মুখার্জি) সুবাদে লাইসেন্স পেয়েছে রিলায়ান্স। তারা নিশ্চয়ই জানেন, এসব লাইসেন্স কেবল একজন মন্ত্রীর মাধ্যমেই দেওয়া হয় না। এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকে আরও কয়েকটি মন্ত্রণালয়।

মার্কেটের একটি বড় অংশ রিলায়ান্সের দখলে রয়েছে এটা সত্য। কিন্তু রিলায়ান্সের বিরুদ্ধে মনোপলির যে চিত্র এক্সপ্রেস এঁকেছে তা সত্য নয়। বলা হয়েছে, দেশের মোট লাইসেন্সপ্রাপ্ত ক্যাপাসিটির ১৮ থেকে ৬২ দশমিক পাঁচ শতাংশই রিলায়ান্সের দখলে। আসলে এটা হবে সাত দশমিক পাঁচ থেকে ৩৪ দশমিক ৮৪ শতাংশ।

এবার আসি আমাদের নতুন পলিয়েস্টার ফিলামেন্ট ইয়ার্ন প্লান্ট ও  এর প্রস্তাবিত পলিয়েস্টার ফাইবার প্লান্টের বিরুদ্ধে যে ‘চোরাকারবারি’র অভিযোগ দেওয়া হয়েছে সে প্রসঙ্গে। এটা একেবারেই হাস্যকর ও কল্পনাপ্রসূত অভিযোগ। অভিযোগকারী প্রতিবেদক এমনকি ভদ্রতার পর্দাটুকুও রাখেননি। শুল্ক বিভাগ থেকে যাচাই করে দেওয়া তালিকা অনুসারেই উপকরণ আমদানি করা হয়েছে। সঙ্গে আমদানির লাইসেন্সও যুক্ত করা হয়েছে। এখন রিপোর্ট লেখক যদি অভিযোগ করতেই চান তাহলে তার উচিত কর্তৃপক্ষের দক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা, যারা যাচাই-বাছাই করে আমাদের আমদানির অনুমতি দিয়েছেন। এটা সবাই জানেন, সিনথেটিক ফাইবার প্লান্টের আউটপুট (উপকরণ) লাইসেন্সপ্রাপ্ত পরিমাণের চেয়ে অনেক বেশি হতেই পারে। এটা নির্ভর করে সুতার দক্ষতা ও ঘনত্বের ওপর। কোনো কোম্পানিই একটি প্লান্টের সমপরিমাণ উপকরণ চোরাকারবারি করতে যাবে না। কারণ এতে বাড়তি অবচয় গুনতে ও বিনিয়োগ ভাতা হারাতে হতে পারে। রিলায়ান্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ১৮ লাখ বিনিয়োগকারীর প্রতিষ্ঠান। এর ম্যানেজমেন্ট এত বোকা নয় যে, ১০০ কোটি রুপির তহবিল দিয়ে প্লান্ট আমদানি করে আর্থিক সুবিধা হারাবে।

যা হোক, ভি সুভ্রামনিয়ামের এই বিশাল চিঠি দিয়েও গুরুমূর্তির মুখ বন্ধ করা যায়নি। বরং আরও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আক্রমণ করলেন তিনি। এবার পাতালগঙ্গার প্লান্ট নিয়ে ধারাবাহিক রিপোর্ট প্রকাশ করা হলো। এর ভিত্তিতেই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে ছয়জন কর্মকর্তা ও প্রকৌশলীর একটি দল নিয়ে ২০ আগস্ট পাতালগঙ্গা প্লান্টে আসে তদন্ত করতে। রিলায়ান্স সর্বোৎকৃষ্ট মানের মেশিন ও সর্বাধুনিক প্রযুক্তির বড়াই করে। প্রকৃতপক্ষে কী মেশিন বসানো হয়েছে, তা দেখাই এ টিমের উদ্দেশ্য। তারা ঘুরে দেখলেন, নানা তথ্য চেয়ে ওইদিন বিকাল পর্যন্ত সময় বেঁধে দিলেন। এ পরিদর্শনের ওপর যে রিপোর্ট শিল্প মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছিল, তাতে পরিদর্শক দলের প্রধান এমএস গ্রোভার বলেছেন, রিলায়ান্স সময়মতো তথ্য দিতে ব্যর্থ হয়েছে এবং তাদের দেওয়া তথ্য পর্যাপ্তও ছিল না। আম্বানি বুঝতে পারলেন, এত সহজে এ ধাক্কা সামলানো সম্ভব হবে না। গুরুমূর্তি গডফাদার গোয়েঙ্কা তার জন্য আরও বিপদ ডেকে আনবেন।