মো. জিল্লুর রহমান: পুরুষশাসিত এ সমাজে নারীরা নির্যাতিত ও নিগৃহীত হয় এটাই সবার বদ্ধমূল ধারণা ও বিশ্বাস কিন্তু এর বিপরীতটাও যে ঘটে তা অনেকে বিশ্বাস করতে চায় না। বিভিন্ন গণমাধ্যম স্বভাবতই নারী নির্যাতন, যৌননিপীড়ন, যৌতুক, অ্যাসিড নিক্ষেপ, তালাক, হত্যা ও ধর্ষণের মতো নানা ধরনের সংবাদ খুব গুরুত্ব দিয়ে পরিবেশন ও প্রচার করে। কিন্তু পুরুষরাও যে কমবেশি নির্যাতন, নিগ্রহ ও হয়রানির শিকার হতে পারে, তার কিয়দংশই গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়।
পুরুষ নির্যাতন ব্যতিক্রমধর্মী হলেও এটি বিশ্বব্যাপী কমবেশি ঘটে। আসলে আইনের দৃষ্টিতে অপরাধী নারী বা পুরুষ যেই হোক সবাই সমান এবং আইনের আশ্রয় নেওয়ার অধিকারও উভয়ের আছে। আমাদের দেশে নারীরা নির্যাতনের শিকার হলে যৌতুক ও নারী নির্যাতন আইনের আশ্রয় লাভ করে, কিন্তু পুরুষরা এ আইনের মাধ্যমে ব্যাপক হেনস্তা বা হয়রানির শিকার হন বলে অভিযোগ আছে। কারণ সমাজে পুরুষ কর্তৃক নারীরা যেমন নিপীড়িত, নিগৃহীত বা নির্যাতিত হয় ঠিক তেমনি এর উল্টোটাও ঘটে। পুরুষ কর্তৃক নারীরা নির্যাতিত হলে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন এটি নিয়ে বেশ সোচ্চার হয়ে ওঠে এবং গণমাধ্যমগুলো বিষয়টি বেশ গুরুত্ব দিয়ে প্রচার ও পরিবেশন করে।
সমাজ দ্রুত বদলে যাচ্ছে। বদলে যাওয়া সমাজেরই নতুন রূপ হচ্ছে পুরুষ নির্যাতন। নির্যাতিত পুরুষের কেউ শারীরিক, কেউ মানসিক, কেউ দৈহিক-আর্থিক, কেউ সামাজিকভাবে নির্যাতিত হচ্ছেন। ঘরে-বাইরে এ ধররের নির্যাতন প্রায়ই ঘটছে। তুলনামূলক কম হলেও নির্যাতিত পুরুষের সংখ্যা এদেশে নেহাত কম নয়। মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থার কাছে নারী নির্যাতনের পরিসংখ্যান থাকলেও নেই পুরুষ নির্যাতনের সঠিক তথ্য। ফলে নারী নির্যাতনের খবর ফলাও করে প্রকাশ করা হলেও অন্ধকারেই থেকে যাচ্ছে পুরুষ নির্যাতনের ঘটনাগুলো। তবে সাম্প্রতিককালে পুরুষ নির্যাতনকে কেন্দ্র করে বেশকিছু সংগঠন গড়ে উঠছে।
সমাজে নারী কর্তৃক পুরুষ নির্যাতিত বা নিগৃহীত হলে সেটা অনেকে লোক-লজ্জায় প্রকাশ করে না বা সমাজ সেটাকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করে না। সবচেয়ে বড় বাধা আইন এটাকে মোটেও সমর্থন করে না। অনেক পুরুষ মনে করে এটি প্রকাশ পেলে তার ব্যক্তিসত্তা লোপ পাবে বা সমাজে তার ব্যক্তিত্ব প্রশ্নের সম্মুখীন হবে। সমাজে অনেক পুরুষকে অন্য নারী বা স্ত্রীদের দ্বারা নিগৃহীত বা মিথ্যা মামলায় হয়রানির শিকার হয়ে তার অসহায়ত্ব প্রকাশ করতে দেখা যায়। অনেকে চক্ষুলজ্জা আর পরিবারের সন্তানদের কথা চিন্তা করে দিনের পর দিন স্ত্রীর এসব নির্যাতন-নিপীড়ন আর হুমকি-ধমকি নীরবে সহ্য করে যাচ্ছে। পুরুষ অধিকার নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠন বলছে, সমাজে অনেক পুরুষই স্ত্রীর যন্ত্রণায় নীরবে কাঁদেন। লোকচক্ষুর আড়ালে গিয়ে চোখ মোছেন; কিন্তু দেখার কেউ নেই। বলারও কোনো উপায় নেই।
সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, বর্তমানে দাম্পত্য জীবনে ভালোবাসার বন্ধন আগের চেয়ে অনেকটা হালকা। এছাড়া সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, নৈতিক স্খলন, লোভ-লালসা, উচ্চবিলাসিতা, পরকীয়া, মাদকাসক্তি, অর্থনৈতিক বৈষম্য, বিশ্বায়নের ক্ষতিকর প্রভাব, অবাধ আকাশ সাংস্কৃতিক প্রবাহসহ নানা কারণেই এমনটা ঘটছে। যার চরম পরিণতি হচ্ছে সংসারের ভাঙন ও নির্যাতন। পারিবারিক অশান্তি ও সংসার ভাঙনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন নারী-পুরুষ উভয়ই। উচ্চবিত্ত থেকে নি¤œবিত্ত সমাজের সব অংশই প্রতিনিয়ত ভুগছেন নানা পারিবারিক যন্ত্রণায়। এক্ষেত্রে নির্যাতিত নারীর পাশে সমাজের অনেকেই সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু পুরুষশাসিত এ সমাজে পুরুষও যে নির্যাতিত হতে পারে সেটি যেন কারও ভাবনাতেই নেই। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আড়ালেই থেকে যায় পুরুষ নির্যাতনের করুণ কাহিনী। পুরুষ নির্যাতনের ঘটনা আসলে নেহাত কম নয়।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, স্ত্রী কর্তৃক নির্যাতনের শিকার হলেও আইনের আশ্রয় নিতে পারছেন না পুরুষ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সন্তানের ভবিষ্যৎ, সামাজিক মর্যাদা, চক্ষুলজ্জা, জেল-পুলিশ আর উল্টো মামলার ভয়ে বাধ্য হয়ে স্ত্রীর নির্যাতন নীরবে সহ্য করে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। পুরুষ চাইলেও নির্যাতনের কথা বলতে পারছে না। অন্যদিকে একজন নারী আইনের অপব্যবহার করে ইচ্ছে করলেই ঘটনা সাজিয়ে পুরুষের বিরুদ্ধে থানা বা আদালতে সহজেই নারী নির্যাতনের মামলা বা যৌতুক মামলা দিতে পারছেন। আসলে অনেক নারী ইচ্ছাকৃতভাবে যৌতুক ও নারী নির্যাতন আইনকে পুরুষকে হয়রানি ও নির্যাতনের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। অপরাধ নারী বা পুরুষ যেই করুক, আইনানুসারে তার শাস্তি নিশ্চিত করা দরকার, অন্যথায় নারী-পুরুষ উভয়ের সমতা নষ্ট হবে। পারিবারিক মূল্যবোধ হবে ভূলণ্ঠিত।
সংবিধানের ২৭, ২৮ ও ২৯ নং অনুচ্ছেদে নারীর অধিকারের কথা বলা হয়েছে। অন্যদিকে নারীর সুরক্ষার জন্য দেশে একাধিক আইন রয়েছে। এর মধ্যে নারী ও শিশু নির্যাতন আইন-২০০০, অ্যাসিড নিরোধ আইন-২০০২, পারিবারিক সহিংসতা ও দমন আইন-২০১০, যৌতুক নিরোধ আইন-১৯৮০ উল্লেখযোগ্য। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, নারীর সুরক্ষার জন্য আইনগুলো তৈরি হলেও বর্তমানে এ আইনগুলোকে কিছু নারী-পুরুষ দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। সামান্য কিছুতেই স্বার্থান্বেষী নারী স্বামীদের নাজেহাল করতে এসব আইনের অপপ্রয়োগ করছেন। অন্যদিকে দেশে ‘পুরুষ নির্যাতন প্রতিরোধ’ আইন এখনও সৃষ্টি হয়নি। এসব কারণে আইনি সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন ভুক্তভোগী পুরুষ।
সত্যিকারভাবে, পুরুষ নির্যাতনের ক্ষেত্রে যৌতুক আইনের অপপ্রয়োগ সবচেয়ে বেশি। অনেকে বলেন, যৌতুক আইনের অধিকাংশই মিথ্যা ও হয়রানিমূলক। পারিবারিক যে কোনো বিষয়ে চূড়ান্ত ঝগড়া হলে সেটি থানা পুলিশে গড়ালে পরিণত হয় যৌতুক মামলায়। কোনো কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য হলে অথবা স্ত্রীকে তালাক দিলে অথবা উচ্ছৃঙ্খল স্ত্রীকে শাসন করলে অথবা স্ত্রীর পরকীয়ায় বাধা দিলে সেই স্ত্রী ও তার পরিবারের লোকজন থানায় বা আদালতে নারী ও শিশু নির্যাতন আইন-২০০০-এর ১১(খ) অথবা যৌতুক নিরোধ আইন-১৯৮০-এর ৪ ধারায় একটি মামলা করেন। একজন পুরুষের জীবন অতিষ্ঠ করার জন্য এ একটি মামলাই যথেষ্ট।
১৯৮০ সালের ‘যৌতুক নিরোধ আইনে’ করা অনেক মামলাই মিথ্যা। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে আইন আদালত সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন লোকজনের অনেকে যৌতুকের মামলাকে ঠাট্টা করে ‘কৌতুকের মামলা’ বলে অভিহিত করে থাকেন। এটা ঠিক অনেক নারী হয়তো ভরণপোষণ ঠিকমতো পান না এবং বিভিন্ন বিষয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ছোটখাটো ঝগড়াঝাটি হয়, টানাটানি থাকে সংসারে। ঘর-গেরস্থালি, সন্তান পালন ইত্যাদি ব্যাপারে পান থেকে চুন খসার মতো মনোমালিন্য হলেই ‘পতি’-র বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থার উদ্যোগ নেন অনেক স্ত্রী।
বাজারে অনেক ভোগসামগ্রী এবং অনেক নারীরই এটা বেশ পছন্দের কিন্তু স্বামীরা সেগুলো সময়মতো দিতে না পারায় সামান্য মনোমালিন্য ও ঝগড়াঝাটি হয়। তবে স্ত্রীরা পারিবারিক আদালতে ভরণপোষণের মামলা না করে, সেসব ঘটনার ওপর রং-চং মাখিয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে যৌতুক ও মারধরের মামলা করেন। এতে করে স্বামীরা বর্ণনাতীত ভোগান্তিতে পড়েন। আবার ভরণপোষণ না দেওয়ার মামলার পাশাপাশি কোনো কোনো নারী একটি ‘নারী নির্যাতন দমন আইন’-এ মারধরের মামলাও করে বসে। বিষয়টা একটা গত বাধা রেওয়াজের মতো দাঁড়িয়েছে।
২০১৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টে জাতীয় বিচার বিভাগীয় সম্মেলনের ঘরোয়া কর্ম অধিবেশনে আপিল বিভাগের একজন বিচারপতির সভাপতিত্বে জেলা ও দায়রা জজ পদমর্যাদার ৪০টির বেশি ট্রাইব্যুনালের বিচারকরা এক উš§ুক্ত আলোচনায় অংশ নেন। এ বিষয়ে প্রস্তুত করা হয় ১০ দফা-সংবলিত একটি প্রাথমিক প্রতিবেদন। মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ার কারণ হিসেবে ‘মিথ্যা মামলা’কেই ১ নম্বর সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
অধিবেশনে অংশগ্রহণকারী বিচারকরা একমত হন যে, বাস্তবে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ব্যাপক অপপ্রয়োগ ঘটছে। আবার কঠোরতর শাস্তির বিধান ও তা কার্যকর করা সত্ত্বেও নারীর প্রতি সহিংসতা ও যৌতুকের মতো অপরাধের মাত্রা কমেনি। এজন্য তারা বিদ্যমান আইনের কিছু ধারা অংশীজনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে জরুরি ভিত্তিতে সংশোধনের সুপারিশ করেন। তারা আক্ষেপ করে বলেছেন, আইনের ১১ ক ধারায় যৌতুকের জন্য শুধু মৃত্যুদণ্ডের শাস্তির বিধান আছে। এর ফলে অপরাধের মাত্রা বিবেচনা করে সাজা দেওয়া যায় না, যা মানবাধিকার পরিপন্থি।
পুরুষ নির্যাতন প্রতিরোধে আমাদের দেশে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো আইন নেই। নারী ও শিশু নির্যাতনে ট্রাইব্যুনাল তৈরি হলেও পুরুষদের জন্য নেই। পুরুষ শাসিত সমাজে তারা নারী সুরক্ষার আইন তৈরি করলেও, তাদের নিজেদের হয়রানির আইন নেই। ফলে ভুক্তভোগীদের আইনি সহায়তা দেওয়াটা দুরূহ হয়ে পড়ছে। শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে সমাজের উচ্চ পদধারী থেকে শুরু করে নি¤œশ্রেণির রিকশাচালক পর্যন্ত অনেক পুরুষই আইনি সহায়তা পাওয়ার জন্য বিভিন্ন জায়গার দ্বারস্থ হচ্ছে।
বাংলাদেশ সরকার নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের অপপ্রয়োগ প্রতিরোধে পুরুষ নির্যাতন আইন করতে যাচ্ছে শীর্ষক একটি খবর বেশ কিছুদিন ধরেই শোনা যাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারের এই পদক্ষেপকে অনেকেই ইতিবাচক হিসেবে দেখছে। এজন্য ভুক্তভোগীদের পক্ষ থেকে পুরুষ নির্যাতন বন্ধে আইন প্রণয়নেরও জোর দাবি জানানো হচ্ছে এবং সংশ্লিষ্টরা দাবিটিকে যৌক্তিক হিসেবে মনে করছেন।
ব্যাংকার ও ফ্রিল্যান্স লেখক
গেণ্ডারিয়া, ঢাকা