মীর মাঈনুল ইসলাম: সমাজব্যবস্থার চলমান পরিবর্তনের সঙ্গে অপরাধ সংঘটনের কৌশলেরও ঘটছে নিয়মিত পরিবর্তন। বিশেষত গত এক দশকে দক্ষিণ এশিয়ার অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোয় অপরাধ সংঘটনের মাত্রা বেড়েছে দ্রুতগতিতে। এসব দেশে আঞ্চলিক সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিগোষ্ঠী মাথাচাড়া দিয়ে উঠলেও আমাদের দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর অপরাধ প্রতিরোধের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ। সে প্রেক্ষাপটেই অপরাধ বিষয়ক প্রাতিষ্ঠানিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার প্রয়োজন অনুভূত হয়। ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ প্রতিষ্ঠার শুরুর কথা জানাচ্ছিলেন বিভাগের চেয়ারম্যান জহিরুল ইসলাম।
এরপর শুনি বিভাগ প্রতিষ্ঠার গল্প। ২০০৩ সালে মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স (সিপিএস) বিষয়ে চার বছর মেয়াদি স্নাতক (সম্মান) কোর্স চালু করে। মোট ১৫ জন অভিজ্ঞ শিক্ষকের সমন্বয়ে গঠিত এ বিভাগে পাঠ্য বিষয়গুলোর মধ্যে ল’ অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস, পুলিশ স্টাডিস, সিকিউরিটি প্র্যাকটিস, ক্রিমিনাল ল’, ফরেনসিক সায়েন্স, ভিক্টিমোলজি, ক্রিমিনাল সাইকোলজি, অপরাধ দমন, অপরাধের কারণ, ধরন-প্রকৃতি বিশ্লেষণ, বিভিন্ন তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে অপরাধ সংঘটনের ব্যাখ্যা এ বিভাগে পাঠদানের বিষয়বস্তু। দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশেই চালু হয়েছে ব্যতিক্রম এ বিভাগ।
যাত্রার পর থেকে চলে গেছে প্রায় ১৩ বছর। দেশ-বিদেশের অভিজ্ঞ শিক্ষক, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বিচারকদের নিয়মিত ক্লাস নেওয়ার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের এ বিষয়ে হাতেখড়ি। বিভাগের নিয়মিত সেমিনার ও ফিল্ডট্রিপ শিক্ষার্থীদের এ বিষয়ে ধারাবাহিকভাবে উদ্বুদ্ধ করে চলছে।
কথা হয় এ বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষ দ্বিতীয় সেমিস্টারের ছাত্রী অপরাজিতা সেনের সঙ্গে। ‘বিভাগের শিক্ষকদের আন্তরিকতা ও সব প্রয়োজনে এগিয়ে আসার মানসিকতা আমাদের পড়াশোনা সহজ করে দেয়’, দাবি তার। ২০০৩-০৪ শিক্ষাবর্ষ থেকে এখন পর্যন্ত মোট ১৩টি ব্যাচের আগমন ঘটেছে এ বিভাগে। বর্তমানে বিভাগটিতে ৬টি ব্যাচ পড়াশোনা করছে, যেখানে সব মিলিয়ে প্রায় ৩০০ শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত। শুরুতে ছেলে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বেশি হলেও বর্তমানে মেয়েরাও এ বিষয়ে পড়তে সমানভাবে আগ্রহী।
কারণটাও উঠে আসে বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষ প্রথম সেমিস্টারের ছাত্রী মাইমুনা রহমান মৌর কথায়, ‘ক্রিমিনোলজি বিষয়টি অনেক বেশি রোমাঞ্চকর আর পড়াশোনার পর রয়েছে সাহসী ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ।’
একই বিভাগের শিক্ষার্থী ইজাজ আহমেদ মুন্নার মতে, একাডেমিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার আদলে গঠিত অপরাধতত্ত্ব ও পুলিশ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী হিসেবে সমাজের প্রতিটি মানুষকে অপরাধ কার্যক্রম থেকে দূরে রাখা এবং দেশের জন্য ভালো কিছু করাই এ বিষয়ে পড়ার মূল লক্ষ্য।
দেশে অপরাধবিষয়ক পড়াশোনা-পরবর্তী কর্মসংস্থান বিষয়ে বিভাগের শিক্ষক সুব্রত ব্যানার্জি বলেন, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা, মানবাধিকার কমিশন ও নিরাপত্তা সংস্থা বিষয়ে শিক্ষার্থীদের বোঝাপড়া থাকায় নর্থ আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, সুইডেনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ক্রিমিনোলজির চাহিদা ব্যাপক। তিনি আরও জানান, এখান থেকে পড়াশোনার এ বিভাগের অনেক শিক্ষার্থীই দেশের বাইরে সাফল্যের সঙ্গে অধ্যয়ন করছে।
এদেশে সংঘটিত বিভিন্ন অপরাধ নিয়ে এ বিভাগের শিক্ষার্থীরা প্রতিবছর প্রায় ১০০টির বেশি গবেষণায় অংশ নেন। এ বিষয়ে ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান জহিরুল ইসলাম বলেন, নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ায় আমাদের বিভাগে পর্যাপ্ত ল্যাব ও ফরেনসিক সুবিধা না থাকলেও আমরা বিভিন্ন নিরাপত্তা সংস্থার ল্যাব ও মেডিক্যাল ল্যাব ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের যথাযথ চাহিদা পূরণ করছি। শিক্ষার্থীরা নিজেদের কাজের ক্ষেত্রে তা সাফল্যের সঙ্গে প্রয়োগ করছে।
লেখাপড়ার বাইরেও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ক্লাব ও সাংগঠনিক কার্যক্রমে এ বিভাগের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো। বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে রয়েছে এ বিভাগের বিশেষ সুনাম। ২০০৭-০৮ শিক্ষাবর্ষ থেকে বিভাগটিতে দেড় বছর মেয়াদি স্নাতকোত্তর কার্যক্রম চালু হয়। এ বিষয়টি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও চালু হয়েছে। একজন শিক্ষার্থীকে এ বিষয়ে পড়তে হলে অবশ্যই তাকে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী এবং এসএসসি ও এইচএসসিতে ভালো ফল থাকতে হবে। শুধু ক্যারিয়ারের চিন্তা করেই নয়, একটি চ্যালেঞ্জিং বিষয় পড়তে চাইলে ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স হতে পারে যে কারও জন্য আগ্রহের বিষয়।