অপরিকল্পিত অবকাঠামোই যানজটের কারণ

আ. ন. ম. মাছুম বিল্লাহ ভূঞা: প্যাপিলোমা ভাইরাস সংক্রমণের কারণে মানুষের শরীরে ক্যানসার রোগের সৃষ্টি হয়, তখন সুস্থ মানুষ রোগাক্রান্ত হয়ে যায়। আর বাংলাদেশের ক্যানসার হচ্ছে যানজট, এর জন্য বিশেষ করে দায়ী ব্যক্তিগত যান্ত্রিক যানবাহন। এই যানজট শুধু রাজধানীর নয়, বাণিজ্যিক শহর-খ্যাত চট্টগ্রাম, এমনকি কুমিল্লা শহরেও যানজট মানুষের শরীরের ক্যানসারের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। যানজটের কারণে রাজধানীসহ অন্যান্য শহরের হƒৎপিণ্ডে ব্লক ধরা পড়েছে। ফলে মুমূর্ষু মানুষের মতো অবস্থা হয়ে গেছে শহরগুলোর, যার কারণে বসবাসযোগ্য শহরের তলানিতে এসে ঠেকছে ঢাকা শহর, অন্যান্য শহরের অবস্থা যে খুব একটা ভালো, তা বলা যাবে না। শহরের তীব্র যানজট, বায়ু ও শব্দদূষণ এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে। তাই যেকোনো সময় মৃত শহর হিসেবে গণ্য করা হবে এই শহরগুলো।

কভিড লকডাউন শিথিল করার পর বর্তমান সময়ে শুধু রাজধানী ঢাকাতেই নয়, ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ে ও কুমিল্লার মতো শহরেও উন্নয়নের নামে অপরিকল্পিতভাবে অবকাঠামো নির্মাণের কারণে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে সবশ্রেণির মানুষকে। মানুষের শরীরের ক্যানসার যথাসময়ে চিকিৎসা না করার ফলে যেমন সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে, তেমনি যথাসময়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করার কারণে যানজট নামক ক্যানসার সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা অংশে প্রায়ই

২৫-৩০ কিলোমিটার যানজট তীব্র যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। এই নিত্য দুর্ভোগের পরিমাণ দিন দিন তীব্রতর হচ্ছে। ঘর থেকে হলেই পড়তে হচ্ছে ভয়াবহ যানজটের কবলে। পুরোনো রোগ যখন ক্রনিক হয়ে যায়, তখন আরোগ্যলাভও কঠিন হয়ে পড়ে। যানজট সে রকম একটি রোগ। দীর্ঘদিন ধরে রাজধানীবাসী এই রোগে ভুগলেও বর্তমানে অন্যান্য নগরবাসী এ রোগে ভুগছে। সেবাদানকারী সরকারি সংস্থার অর্বাচীন কার্যক্রম ও অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণই যানজটসহ অন্তহীন জনদুর্ভোগের কারণ বটে। অবকাঠামো নির্মাণ ও সেবাদানে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর কার্যক্রম দেখে মনে হয় নগরবাসীর প্রতি তাদের কোনো দায় নেই। 

প্রতিনিয়ত হাজারো যানবাহন যাত্রী নিয়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিমানবন্দর সড়কে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকে। বিমানবন্দর-গাজীপুর মহাসড়কের যানজটের খবর প্রায়ই গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়। ইঞ্জিনচালিত যানবাহনও বিমানবন্দর মহাসড়কে কয়েক বছর ধরে ধীরে ধীরে চলছে। জনবহুল জেলা শহর কুমিল্লার সড়কে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত যানজট লেগেই থাকে। যত্রতত্র ছোট-বড় গাড়ির পার্কিং ও প্রধান সড়কের দুই পাশে ভ্রাম্যমাণ দোকান, সুয়ারেজ লাইনের ওপরের তথাকথিত ফুটপাত নামক স্থানটি দখল করে দোকানপাট এবং সড়কের পাশে অ্যাম্বুলেন্স ও মোড়ে মোড়ে সিএনজি-অটোরিকশার অস্থায়ী স্ট্যান্ডের কারণে নগরীতে যানজট স্থায়ী রূপ নিয়েছে। প্রতিদিন অধিকাংশ সময় যানজটের কারণে থমকে যায় স্বাভাবিক জীবন। নগরীর সবকটি পথে অন্তত ৫০ হাজারের বেশি ব্যাটারিচালিত রিকশা, অটোবাইক, সিএনজি, মাইক্রো ও বাসের দাপট এই যানজটের জন্য দায়ী। যানজটের কারণে কর্মজীবী মানুষ, শিক্ষার্থী এমনকি রোগীকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় বসে থাকতে হচ্ছে। এতে কর্মঘণ্টা, সময় ও জ্বালানি নষ্ট হচ্ছে। এতে কোন ধরনের ভ্রুক্ষেপ নেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের।

ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে সড়ক ও জনপথ কর্তৃপক্ষ নির্মাণাধীন অবকাঠামোর কাজ দ্রুত শেষ করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, কিন্তু আসলে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। ভোগান্তি কমছে না সিকি ভাগও, বরং বাড়ছে। লাখ লাখ মানুষের যাতায়াত ভোগান্তি এবং লাখ লাখ মানুষের কর্মঘণ্টা নষ্ট হওয়ার ক্ষতির দায়দায়িত্ব যথাযথ কর্তৃপক্ষ নেবে কি? এই দায়দায়িত্ব তাদের এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ পাওয়া উচিত হবে কি?

অনেক নীতিনির্ধারক বাংলাদেশকে সিঙ্গাপুর বানাতে চায়, কিন্তু বাস্তবে সম্ভব হবে কি? সিঙ্গাপুরে রাস্তাঘাটে যানজট প্রায় নেই বললেই চলে; কারণ আমাদের মতো ইচ্ছা করলেই ‘কালো’ টাকায় সাদা গাড়ি কেনা যায় না এবং সিঙ্গাপুরে ব্যক্তিগত গাড়ি নিবন্ধন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আর আমরা প্রতিনিয়ত ব্যক্তিগত গাড়ি নিবন্ধন নিয়ে রাস্তায় নামিয়ে যানজট সৃষ্টি করছি। চলতি বছরের ২০২২ সালের প্রথম দুই মাসের নিবন্ধিত চিত্র দেখে জানা যায়, ঢাকা শহরে প্রতিদিনে গাড়ি নামছে ৪৯৫টি। বিপুলসংখ্যক নতুন গাড়ি রাস্তায় নামলেও ঢাকায় সড়ক বাড়েনি, বাড়ানো সম্ভবও নয়। ঢাকা মহানগরীতে আট লাখ ৫৩ হাজার ৩০৪টি যানবাহন চলাচল করছে, এর মধ্যে রয়েছে ২১ হাজার ৬১৬টি বাস, মিনিবাস ৯ হাজার ৯০৪টি, ব্যক্তিগত গাড়ি দুই লাখ ৩০ হাজার ৩৩টি এবং মোটরসাইকেল তিন লাখ ৩১ হাজার ৭৪৬টি। এসব যান্ত্রিক যানবাহনের বেপরোয়া গতি, যত্রতত্র পার্কিং, ফুটপাথে মোটরসাইকেল চলাচল প্রভৃতি পথচারীদের জন্য দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) গাড়ি নিবন্ধন নিয়ন্ত্রণ না করার কারণে রাজধানীর যাতায়াত ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। গণপরিবহন, যেমন রেলওয়ে, বাস ও নদীপথের মাধ্যমে নিরাপদ যাতায়াতই নিশ্চিত করতে পারে যানজটমুক্ত বাংলাদেশ।

যাতায়াতের ক্ষেত্রে অনেক পথ, তবে একটা পথই নিরাপদ। সেটা হচ্ছে হাঁটার উপযোগী ও সাইকেলবান্ধব যাতায়াত। কারণ হাঁটতে বা সাইকেল চালাতে জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো লাগে না। হাঁটার উপযোগী ও সাইকেলবান্ধব যাতায়াত নিশ্চিত করা গেলে বৈদেশিক মুদ্রা ও রিজার্ভ সংকট মোকাবিলায় তা ইতিবাচক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হাঁটাহাঁটিকে গুরুত্ব দিয়ে যাতায়াত নিশ্চিত করা দরকার। এতে শহরে যানজট নিরসন করা সহজ হবে।

সিঙ্গাপুর রাজনৈতিক সদিচ্ছার কারণে যানজট ও দূষণ হ্রাস এবং নগর উদ্যান তৈরি করতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। আর আমরা তথাকথিত উন্নয়নের নামে খণ্ড খণ্ড উড়ালসেতু নির্মাণ করছি, একই সঙ্গে রাস্তায় যুক্ত হচ্ছে প্রতিদিন গড়ে ৫৩ থেকে ৫৫টি ব্যক্তিগত গাড়ি। এতে যানজট কমার পরিবর্তে বরং যানজট বৃদ্ধি পেয়েছে এবং হোমরাচোমরা অনেকেই বাস-মালিক হওয়ায় গণপরিবহনের উন্নয়ন বা সেবার মান বৃদ্ধি পায়নি। ঢাকা শহরের মোট সড়কের প্রায় ৫০ শতাংশজুড়েই চলাচল করে ব্যক্তিগত গাড়ি, অথচ এগুলো বহন করে মাত্র ১২ শতাংশ যাত্রী। যানজট, শব্দদূষণ ও বায়ুদূষণের কারণে জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও রাষ্ট্রের অর্থনীতির অনেক ক্ষতি হচ্ছে, যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার গবেষণায় উঠে এসেছে। ব্যক্তিগত গাড়িনির্ভরতা বৃদ্ধি পাওয়ায় অর্থনীতিতে রক্তক্ষরণের কারণ হয়ে উঠছে অতিমাত্রায় যানজট। ফলে প্রতিনিয়ত বাড়ছে বায়ুদূষণ ও শব্দদূষণ-সম্পর্কিত অনেক অসংক্রামক রোগব্যাধি। রেলওয়ের উন্নয়ন সুদূর পরাহতই থেকে গেছে। মেট্রোরেল ও বিআরটি প্রবর্তিত হলেও আমাদের দুর্নীতিসহ নানা কারণে ঠিকমতো সেগুলো পরিচালনা করতে দুর্ভোগে পড়ার শঙ্কা রয়েছে।

যানজট নিরসনের জন্য দরকার ছিল ব্যক্তিগত যান্ত্রিক যানবাহন চলাচল ও ব্যবহার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা এবং প্রশস্ত ও মসৃণ ফুটপাত তৈরি ও ব্যবহার নিশ্চিত করা, যা বাংলাদেশের অন্য কোনো শহরে দূরে থাক, রাজধানীতেও নেই। যেসব তথাকথিত ফুটপাত তৈরি করা হয়েছে, বেশিভাগই হয় সুয়ারেজ লাইনের ওপর, যা চিকন ও সরু অথবা সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো অসমতল বটে। কিছু ফুটপাতে বোলান্ড দিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে রাখা হয়েছে। কিন্তু যারা রাষ্ট্রের প্রচলিত আইন মান্য করছে না এবং ফুটপাতে মোটরসাইকেল দিয়ে যাতায়াত করে, তাদের কেন শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে না? এ যেন ‘শাঁখের করাত’ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তবে উন্নত ও ভালো ফুটপাত থাকলে মানুষ যানজটের ভোগান্তি থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি পেত। তিন থেকে পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে ওয়ার্কিং স্টেশন (অফিস) ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিশ্চিত করা গেলে যানজট নিরসন করা সম্ভব হতো এবং ফুটপাতগুলোয় যদি গাছের শেড দেয়া ছায়া থাকত, তখন মানুষ নিরাপদে ও স্বচ্ছন্দে যাতায়াত করতে পারত। এছাড়া যানজট নিরসনে ও যাতায়াত নিশ্চিত করতে পারত বাইসাইকেলের জন্য আলাদা নেটওয়ার্ক ও লেন, যা রাজধানী ও  চট্টগ্রাম শহরে নেই বললেই চলে। অর্বাচীন লোকদের অদূরদর্শী কর্মকাণ্ডের কারণে যানজট ক্রমেই আরও তীব্র হচ্ছে। আর এখান থেকে বেরিয়ে আসাটাও আরও জটিল হয়ে পড়ছে। চিকিৎসকের (নগর-পরিকল্পনাবিদদের) শরণাপন্ন হয়েও কিন্তু যানজটের কোনো উপশম নেই, বরং ভোগান্তি বাড়ছেই। এখানেই শেষ নয়, বর্তমানে উদ্যান, পার্ক, লেক ও জলাধার সাবাড় করায় শহরগুলো বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত।

প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার ক্ষতির বোঝা কাঁধে নিয়ে ফিরছে প্রতিটি মানুষ। এ সমস্যা সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। কিন্তু এক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতার ঘাটতি রয়েছে। যাতায়াত ও পরিবহন ব্যবস্থায় রেলওয়ের উন্নয়ন করলে কম খরচে নিরাপদে ও স্বচ্ছন্দে যাতায়াত করা যেত। এতে সড়ক দুর্ঘটনাও হ্রাস পেত, পাশাপাশি বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ ও যানজট কমানো যেত। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্র এদিকে এখনও সুদৃষ্টি দিচ্ছে না। যানজট সমস্যার সমাধান এমন একটি বিষয়, যার সঙ্গে দেশপ্রেমের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। আর এখানেই আমাদের যথেষ্ট ঘাটতি। এই সমস্যা সমাধানে দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা। রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে জাকার্তা শহরের মতো মৃত শহরে পরিণত হতে হবে। এককভাবে কোনো সংস্থার পক্ষে এ সংকট সমাধান করা সম্ভব নয়। তাই স্থানীয় সরকার ও সিটি করপোরেশনের কর্মকাণ্ডের সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে গেলেই টেকসই উন্নয়ন সম্ভব হবে।

আইনজীবী

masumbillahlaw06@gmail.com

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০