**বিদ্যুৎ খাতে গত ১৫ বছরের বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করেছে শেয়ার বিজ। এতে দুর্নীতি-অনিয়ম ছাড়াও ভর্তুকি, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির চিত্র উঠে এসেছে। এ খাতের সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ নিয়ে আজ থাকছে ধারাবাহিকের শেষ পর্ব
ইসমাইল আলী: আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সময় বিদ্যুতের গড় উৎপাদন ব্যয় ছিল চার টাকার নিচে। ২০১১-১২ অর্থবছর তা পাঁচ টাকা ছাড়ায়। এরপর টানা ৯ বছর বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয় ৫ টাকার ঘরেই ছিল। তবে পরের বছরগুলোয় তা দ্রুত বাড়তে থাকে। গত দুই অর্থবছর বিদ্যুতের গড় উৎপাদন ব্যয় ১১ টাকায় পৌঁছে। এতে ইউনিটপ্রতি লোকসানও চারগুণ হয়েছে। মূলত অপরিকল্পিতভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ও পরিকল্পিত লুটপাটের কারণে লোকসান বেড়েই চলেছে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) প্রতিবেদন বিশ্লেষণে এ তথ্য উঠে এসেছে। এতে দেখা যায়, ২০১০-১১ অর্থবছর বিদ্যুতের গড় উৎপাদন ব্যয় ছিল তিন টাকা ৯৫ পয়সা। রেন্টাল-কুইক রেন্টালের নামে লুটপাটের কারণে ২০১১-১২ অর্থবছর তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫ টাকা ১২ পয়সা। এর মধ্যে জ্বালানি ব্যয় ছিল ২ টাকা ৯৭ পয়সা। আর গড় স্থায়ী ব্যয়/ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল ১ টাকা ৯৯ পয়সা এবং গড় পরিবর্তনশীল ব্যয় তথা পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় (ওঅ্যান্ডএম) ১৬ পয়সা।
২০২২-২৩ অর্থবছর প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১১ টাকা চার পয়সা, যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ। গড় উৎপাদন ব্যয়ের মধ্যে গড় জ্বালানি ব্যয় ছিল ৭ টাকা ১১ পয়সা, গড় স্থায়ী ব্যয়/ক্যাপাসিটি চার্জ ৩ টাকা ৪৯ পয়সা এবং গড় ওঅ্যান্ডএম ৪৪ পয়সা। অর্থাৎ এক যুগের ব্যবধানে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয় বেড়েছে ৫ টাকা ৯২ পয়সা। তবে শেষ তিন অর্থবছরেই তা বেড়েছে ৫ টাকা ২৯ পয়সা।
এদিকে বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছর প্রতি ইউনিট গড় বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয় কিছুটা কমে দাঁড়িয়েছে ১০ টাকা ৮৮ পয়সা, যা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। মূলত আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লাসহ সব ধরনের জ্বালানির দাম কমার কিছুটা সুফল মিলেছে। গত অর্থবছর গড় জ্বালানি ব্যয় কমে দাঁড়িয়েছে ৫ টাকা ৯৭ পয়সা। অর্থাৎ গড় জ্বালানি ব্যয় বেড়েছে ১ টাকা ১৪ পয়সা। তবে গড় স্থায়ী ব্যয় তথা ক্যাপাসিটি চার্জ বেড়ে যাওয়ায় জ্বালানি-বহির্ভূত ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৪ টাকা ৯১ টাকা।
পিডিবির বিদ্যুৎ উৎপাদনের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০১২-১৩ অর্থবছর প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয় ছিল ৫ টাকা ৪৭ পয়সা। পরের অর্থবছর তা কিছুটা বেড়ে দাঁড়ায় ৫ টাকা ৮৮ পয়সা, ২০১৪-১৫ অর্থবছর ৫ টাকা ৮৫ পয়সা ও ২০১৫-১৬ অর্থবছর ৫ টাকা ১০ পয়সা। ২০১৬-১৭ অর্থবছর গড় ব্যয় আবার কিছুটা বেড়ে হয় ৫ টাকা ২১ পয়সা। পরের অর্থবছর তা আবারও বেড়ে দাঁড়ায় ৫ টাকা ৯৫ পয়সা ও ২০১৮-১৯ অর্থবছর আবার কমে হয় ৫ টাকা ৬৭ পয়সা।
২০১৯-২০ অর্থবছর করোনার কারণে বিশ্বব্যাপী সব ধরনের জ্বালানির দামে ধস নামে। এতে ওই অর্থবছর প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় জ্বালানি ব্যয় অনেক কমে যায়। যদিও চাহিদা কম থাকায় বসিয়ে রেখেই মোটা অঙ্কের ক্যাপাসিটি চার্জ ওই অর্থবছর দিতে হয়। এতে গড় উৎপাদন ব্যয় খুব একটা কমেনি। ওই অর্থবছর গড় ব্যয় দাঁড়ায় ৫ টাকা ৫৮ পয়সা। এটি ছিল গড় উৎপাদন ব্যয় ৫ টাকার ঘরে থাকার শেষ অর্থবছর।
পরের অর্থবছরই গড় জ্বালানি ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৩ টাকা ১৬ পয়সা। ২০২১-২২ অর্থবছর গড় জ্বালানি ব্যয় এক লাফে বেড়ে হয় ৫ টাকা ৩৭ পয়সা। তবে গড় স্থায়ী ব্যয় হ্রাস পায়। ওই দুই অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয় পড়ে যথাক্রমে ৬ টাকা ২৯ পয়সা ও ৮ টাকা ৫৪ পয়সা। ২০২২-২৩ অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি ব্যয় সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে।
ওই অর্থবছর প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় জ্বালানি ব্যয় পড়েছে ৭ টাকা ১১ পয়সা। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও কয়লার দাম বৃদ্ধি এবং দেশে গ্যাসের দাম বাড়ানোকে এজন্য দায়ী করা হয়। যদিও বিদায়ী অর্থবছর আন্তর্জাতিক বাজারে তেল ও কয়লার দাম কমে এসেছে। তবে গড় ক্যাপাসিটি চার্জ বেড়ে যাওয়ায় এর সুফল খুব একটা পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে পিডিবির চেয়ারম্যান কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পিডিবির একাধিক কর্মকর্তা জানান, ২০১৬ সালের পর পায়রা, রামপাল, আদানিসহ বেশকিছু বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। এগুলো গত দুই বছরে উৎপাদনে এসেছে। ফলে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ অনেক বেড়ে গেছে। এতে জ্বালানি ব্যয় কমলেও তার সুফল পাওয়া যাচ্ছে না।
জানতে চাইলে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম. শামসুল আলম শেয়ার বিজকে বলেন, চাহিদা না থাকার পরও সরকার একটি গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতে একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স দিয়ে গেছে। এর কুফল এখন টের পাওয়া যাচ্ছে। একদিকে বেড়েছে ক্যাপসিটি চার্জের পরিমাণ, অন্যদিকে ডলারের বিনিময় হার বেড়েছে গত দুই বছরে অনেকটাই। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের গড় ব্যয় নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে না।
তিনি বলেন, ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় পিডিবির ঘাটতি অনেক বেড়েছে। লোকসানের ঘাটতি পূরণে সরকার একদিকে ভর্তুকি বাবদ অর্থ ঢেলেছে, অন্যদিকে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করেছে। এতে সরকারের অর্থ অপচয়ের পাশাপাশি জনগণের ওপর বোঝা বেড়েছে। এ ব্যয় নিয়ন্ত্রণে প্রতিটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি পুনর্মূল্যায়ন করে ক্যাপাসিটি পেমেন্ট কমাতে হবে। অলস বসে থাকা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ বন্ধ করতে হবে। এতে গড় ব্যয় কমে আসবে।
বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির চক্র: বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির ধাক্কা ভর্তুকি দিয়ে পুরোটা মেটানো যায়নি। এজন্য বাল্ক (পাইকারি) পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদে ১১ বার ও গ্রাহক পর্যায়ে ১৩ বার বাড়ানো হয়েছে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির চাপ শেষ পর্যন্ত জনগণের ঘাড়ে এসেছে পড়েছে।
বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির চিত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১০-১১ অর্থবছরের শুরুতে বাল্ক বিদ্যুতের দাম ছিল দুই টাকা ৩৭ পয়সা। বর্তমানে তা দাঁড়িয়েছে ৭ টাকা চার পয়সা। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের আমলে পাইকারি বিদ্যুতের দাম বেড়ে হয়েছে ১৯৭ শতাংশ। আর ২০১০-১১ অর্থবছরের শুরুতে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ছিল তিন টাকা ৯২ পয়সা। বর্তমানে তা দাঁড়িয়েছে ৮ টাকা ৯৫ পয়সা। অর্থাৎ বিগত সরকারের আমলে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে ১২৮ শতাংশ।