অপুষ্টিজনিত সমস্যা এবং করণীয়

মো. আরাফাত রহমান : শরীরের স্বাভাবিক বৃদ্ধি, বিকাশ ও সুস্থতার জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টির ঘাটতিজনিত অবস্থা বোঝাতেই অপুষ্টি শব্দটি সচরাচর ব্যবহƒত হয়। খাদ্যে এক বা একাধিক বিশেষ করে আমিষ উপাদানের স্বল্পতা অর্থাৎ সুষম খাদ্যের দীর্ঘ অভাবই অপুষ্টির অন্যতম কারণ। গত কয়েক দশকে খাদ্যশস্য, ডাল, শাকসবজি, ফল, মাছ, মাংস, দুধ ও তেল আহার যথেষ্ট হ্রাস পেয়েছে। ফল, মাছ, মাংস, দুধ, ডিম ও তেল খাওয়া কমে যাওয়াসহ মোট খাদ্যগ্রহণও  হ্রাস পেয়েছে, যা গোটা সমাজ ও জাতির জন্য এক বড় সমস্যা। অপুষ্টিতে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশু, গর্ভবতী ও দুগ্ধদাত্রী মায়েরা।

শুধু সীমিত ক্রয়ক্ষমতাই অপুষ্টির কারণ নয়। খাদ্যগ্রহণের (বয়োবৃদ্ধাবস্থায় ও দীর্ঘ অসুখে অরুচি); গলাধঃকরণের (গলবিল, গলনালির ক্যানসার), পরিপাকের (পাকস্থলী, অগ্ন্যাশয়ের রোগ); শোষণের (উদরাময় জাতীয় রোগ) এবং বিপাকের (যকৃৎ এর রোগ, ডায়াবেটিস) সমস্যাদিও অপুষ্টির কারণ হতে পারে। এছাড়া পুষ্টিবিষয়ক জ্ঞানের অভাব, খাদ্য সম্পর্কে কুসংস্কার, চিরাচরিত খাদ্যাভ্যাস, অবৈজ্ঞানিকভাবে খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও রান্না, পরিবারের সদস্যদের মধ্যে পক্ষপাতমূলক খাদ্য বণ্টন, খাদ্যে ব্যাপক ভেজাল, মাতৃদুগ্ধদান বিরতির রেওয়াজ, পেটে কৃমি এবং অন্যান্য কিছু কারণে পুষ্টিগত জাতীয় মানের অবনতি ঘটে থাকে।

বাংলাদেশে প্রায় ৫ লাখ লোকের রয়েছে আয়োডিনের অভাবজনিত মানসিক জড়তা। এছাড়া রয়েছে আয়রন ও ফলিক অ্যাসিডের অভাবে রক্তশূন্যতা, ভিটামিন ‘বি-২’ এর অভাবে মুখ ও জিহ্বায় ঘা। খাদ্যদ্রব্যের উচ্চমূল্যহেতু বিশেষ করে গরিবের প্রোটিন ডাল জাতীয় খাদ্যগ্রহণ যথেষ্ট  হ্রাস পেয়েছে আর এ কারণে অপুষ্টির ব্যাপকতা বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। অন্যদিকে প্রায় মাত্রাতিরিক্ত ভোজন, বিশেষ করে শহরাঞ্চলে শারীরিক শ্রমের স্বল্পতা, ফাস্টফুড ধরনের জাঙ্ক ফুডের প্রচলন ও অন্যান্য কারণে অনেকেই ওজনাধিক্য এবং স্থূলতা সমস্যায় ভোগেন। বাংলাদেশে এ সমস্যার ক্রমবিকাশ পরিলক্ষিত হচ্ছে।

বাংলাদেশ সম্প্রতি খাদ্যে, প্রধানত ধান ও গম উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠলেও মা-বাবার ক্রয়ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার দরুন উপযুক্ত খাদ্য শিশুদের নাগালে পৌঁছায় না। অধিকন্তু, সুষম বৃদ্ধির জন্য কেবল ভাত প্রয়োজনীয় পুষ্টি জোগাতে পারে না। এজন্য দরকার মাছ, মাংস, দুধ ও ডিমের মতো প্রোটিন এবং ভিটামিন ও খনিজ লবণসমৃদ্ধ ফলমূল ও শাকসবজি। শিশুদের খাদ্যাভাবের বহুদৃষ্ট প্রকাশ হলো প্রোটিনসমৃদ্ধ খাদ্য ও শক্তিসমৃদ্ধ দানাশস্যের অভাবজনিত পুষ্টিহীনতা কোয়াশিওরকর ও অস্থিচর্মসার ম্যারাসমাস।

দেহের উচ্চতা ও ওজনভিত্তিক শ্রেণিকরণ পদ্ধতি অনুযায়ী স্বাভাবিক উচ্চতা ও ওজনসম্পন্ন শিশুদের অনুপাত কিছুটা বাড়লেও দুর্বল ও দেহের ব্যাহত বৃদ্ধি হার অপরিবর্তিত রয়েছে। লিঙ্গবৈষম্যগত বিশ্লেষণ থেকে দেখা গেছে যে, একই বয়সের ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা এবং শহরের শিশু অপেক্ষা গ্রামের শিশুরা অধিক অপুষ্ট। এক বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর হার এখন নি¤œমুখী হলেও পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর ৫০-৬০ শতাংশ মারা যায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অপুষ্টির কারণে।

শিশুমৃত্যুর প্রায় এক-তৃতীয়াংশের কারণ মারাত্মক অপুষ্টি। ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের মধ্যে এ ধরনের মৃত্যুর ঘটনা অনেক বেশি। দেশে শালদুধ বর্জন বহুদৃষ্ট। সম্পূর্ণ মাতৃদুগ্ধনির্ভর শিশু প্রায় ৪ শতাংশ। শহরাঞ্চলে প্রায় ৯০ শতাংশ মা শিশুদের বোতলে দুধ খাওয়ায়। তবে এ অনুপাতগুলো এখন নি¤œমুখী। মায়েদের প্রায় ৮০ শতাংশ আয়রন ও ফলিক অ্যাসিডের অভাবে রক্তশূন্যতায় ভোগে। মায়েদের মৃত্যুহার সম্প্রতি নেমে এসেছে। ভিটামিনের অভাবজনিত শিশুদের রাতকানা রোগ এবং চোখের কর্ণিয়া নরম ও অস্বচ্ছ হয়ে অন্ধত্ব বাংলাদেশে খুবই বেশি।

ভিটামিনের ‘এ’-এর অভাবে প্রতি বছর প্রায় ৩০ হাজার শিশু অন্ধ হচ্ছে। বাংলাদেশে শিশুদেরও আয়োডিনের অভাবজনিত বৈকল্য আছে। এছাড়া রয়েছে ভিটামিনের ‘ডি’-এর অভাবে রিকেটস। শিশুর খাবারে ভাগ বসানো পেটের কৃমিও অপুষ্টির আরেকটি কারণ। মূলত দারিদ্র্য ও অজ্ঞতাজনিত কুখাদ্যাভ্যাসের দরুন ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার না খাওয়ায় বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের শিশুদের একটি বড় অংশেরই অপুষ্টিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। জাতিসংঘ সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলো যদি সব ধরনের অপুষ্টির অবসানে এবং ২০৩০ সাল নাগাদ ক্ষুধামুক্ত অঞ্চল প্রতিষ্ঠায়  নিজেদের পুনরায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ না করে তাহলে এই অঞ্চলের মানুষ ও অর্থনীতি ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হবে।

বিশ্বে অপুষ্টিতে আক্রান্ত মানুষের অর্ধেকের বেশিই এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের, যা সংখ্যায় ৫০ কোটির কাছাকাছি। সম্প্রতি প্রকাশিত বৈশ্বিক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বিশ্বব্যাপী ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা সার্বিকভাবে বেড়েছে এবং তা এক দশক আগের পর্যায়ে ফিরে গেছে। ফলে আঞ্চলিক এই প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বিপুলসংখ্যক মানুষ ক্ষুধা ও অপুষ্টিতে আক্রান্ত হওয়ায় এই অঞ্চলে ক্ষুধা ও অপুষ্টির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমে আসা স্থবিরতা বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

যদিও নগরায়ণ অর্থনীতির জন্য সুযোগ তৈরি করতে পারে, তবে এ বৃদ্ধির হার সবসময় সমতাভিত্তিক হয় না এবং এটা অনেক সময় উচ্চমাত্রায় এবং দীর্ঘমেয়াদে শিশুর অপুষ্টির কারণ হতে পারে এবং একই কারণে শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের স্থূলতার হারও দ্রুত বাড়তে পারে। ২০১০ সালে বিশ্বে ৯২ কোটি ৫০  লাখ মানুষ অপুষ্টির শিকার হয়েছিল, যা ১৯৯০ সালের পর থেকে ৮ কোটি বেড়ে যায়। আরও ১০০ কোটি মানুষের শরীরে ভিটামিন ও খনিজ উপাদানের ঘাটতি আছে বলে অনুমান করা হয়। ২০১০ সালে প্রোটিন-শক্তি অপুষ্টির কারণে ছয় লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়।

অবাধ বাজার ব্যবস্থায় উত্তরণকালীন পর্বে দরিদ্র জনগণের স্বাস্থ্যের ওপর এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া মোকাবিলার জন্য বিশ্ব ব্যাংকের সহায়তায় সরকার অনেকগুলো পুষ্টি প্রকল্প গ্রহণ করে। এসব প্রকল্পের প্রধান দুটি ছিল বিশ্ব ব্যাংকের অনুদানে পরিচালিত ন্যাশনাল ইন্টিগ্রেটেড নিউট্রিশন প্রজেক্ট  (এনআইএনপি) এবং ভালনারেবেল গ্রুপ ফিডিং প্রোগ্রাম (ভিজিএফপি)। নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি থেকে মুক্তবাজার অর্থনীতিতে উত্তরণকালে দারিদ্র্যসীমার নিচের লোকেরাই সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে তাদের প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রেখেই প্রকল্প দুটি চালু হয়েছিল। 

সম্প্রতি পরিচালিত কিছু জরিপ থেকে দেখা গেছে, ১-৬ বছর বয়সী শিশুদের প্রায় ২ শতাংশ ‘এ’ ভিটামিনের অভাবজনিত রাতকানা রোগে আক্রান্ত। অথচ দুগ্ধদাত্রী মায়েরা শিশুর ‘এ’ ভিটামিনের প্রায় ৭০ শতাংশ সহজেই যোগাতে পারেন। বিগত দশকে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে শালদুধের উপকারিতা এবং মাতৃদুগ্ধ পান উৎসাহ প্রদান কর্মসূচি আশব্যঞ্জক সাড়া জাগিয়েছে। শাকসবজি ও ফলমূল ‘এ’ ভিটামিনসমৃদ্ধ, যেগুলো বাড়ির আঙিনায় প্রায় নিখরচায় ফলানো যায়। সরকারের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের উচ্চশক্তির ‘এ’ ভিটামিন ক্যাপসুল দিচ্ছে। আয়োডিনের অভাব নিরসনে সরকার আয়োডিনযুক্ত লবণ চালু করেছে।

অপুষ্টি বা পুষ্টির অভাব এমন একটা খাদ্যাভ্যাস অনুযায়ী খাওয়ার ফলস্বরূপ ঘটে যেখানে পুষ্টিকর উপাদানগুলো যথেষ্ট নয় অথবা এত বেশি যে তার কারণে স্বাস্থ্যের সমস্যা ঘটে। সংশ্লিষ্ট পুষ্টিকর উপাদানগুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে: ক্যালরি, প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, ভিটামিন বা খনিজ পদার্থ। এটা অনেক ক্ষেত্রেই নির্দিষ্টভাবে পুষ্টির অভাবের প্রতি নির্দেশ করার জন্য ব্যবহƒত হয়, যেখানে পর্যাপ্ত ক্যালোরি, প্রোটিন বা মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট নেই তবে অধিক-পুষ্টিও এর অন্তর্ভুক্ত। যদি গর্ভাবস্থায় অথবা দুই বছর বয়স হওয়ার আগে পুষ্টির অভাব ঘটে, তাহলে এর ফলস্বরূপ শারীরিক ও মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে স্থায়ী সমস্যা হতে পারে।

পুষ্টি উন্নত করার প্রচেষ্টা হলো উন্নয়নগত সহায়তার সবচেয়ে কার্যকর রূপ। স্তন্যপান করালে তা শিশুদের মধ্যে অপুষ্টি ও মৃত্যুর হার কমাতে পারে এবং এই অভ্যাস প্রচারের প্রচেষ্টার হার বৃদ্ধি করে। ছয় মাস ও দুই বছরের মধ্যে ছোট শিশুদের বুকের দুধের পাশাপাশি খাবার দেওয়া হলে তা ফলাফলকে উন্নত করে। উন্নয়নশীল বিশ্বে গর্ভাবস্থায় এবং ছোট শিশুদের মধ্যে অনেকগুলো মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টের সম্পূরক প্রদান করারও ভালো প্রমাণ আছে। এতে করে যে মানুষের খাদ্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তাদের কাছে খাদ্য পৌঁছে দেওয়া এবং অর্থ প্রদান করাÑএই দুটোই কার্যকর হয়, যাতে লোকেরা স্থানীয় বাজার থেকে খাদ্য কিনতে পারেন।

শিশুদের শুধু স্কুলে খাবার খাওয়ানো যথেষ্ট নয়। বেশির ভাগ সময় ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত আরোগ্যকারী খাদ্যের সাহায্যে সেই ব্যক্তির বাড়ির ভেতরে তীব্র অপুষ্টি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়। যাদের তীব্র অপুষ্টি আছে এবং স্বাস্থ্যের অন্যান্য সমস্যার কারণে তা আরও জটিল হয়ে যায়, তাদের হাসপাতালে চিকিৎসা করানোর পরামর্শ দেওয়া উচিত। এর জন্য প্রায়ই রক্তে কম শর্করা, শরীরের তাপমাত্রা, জলশূন্যতা নিয়ন্ত্রণ করতে হয় এবং ধীরে ধীরে খাওয়াতে হয়। সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকির কারণে সাধারণত গতানুগতিক অ্যান্টিবায়োটিকগুলোর পরামর্শ দেওয়া হয়। দীর্ঘকালীন পদক্ষেপগুলোর অন্তর্ভুক্ত হলো কৃষির অনুশীলনগুলোকে উন্নত করা, দারিদ্র্য হ্রাস করা এবং নারীদের ক্ষমতা প্রদান করা।

সহকারী কর্মকর্তা, ক্যারিয়ার অ্যান্ড প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস বিভাগ

সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়    

 arafatrahman373@gmail.com

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০