Print Date & Time : 17 June 2025 Tuesday 9:15 pm

অবলোপনকৃত খেলাপি ঋণ আদায়ে নাজুক অবস্থা

রোহান রাজিব : নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে বিতরণ হওয়া ঋণ যথাসময়ে ফেরত আসছে না। এতে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের জট বাড়ছে। এই জট কমাতে বিদ্যমান পুরোনো কৌশলেই হাঁটছে ব্যাংকগুলো। আর দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এই কৌশলটির নাম ঋণ অবলোপন (রাইট অফ)। সম্প্রতি বছরগুলোয় খেলাপি ঋণ অবলোপন বাড়িয়েছে অনেক ব্যাংক। এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোও। গত বছর শেষে ব্যাংকগুলোর অবলোপন করা খেলাপি ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৮ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। তবে হিসাবের খাতা থেকে আলাদা করা এসব ঋণ আদায়ে নাজুক পরিস্থিতি বিরাজ করছে ব্যাংকগুলোর।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, ২০২৩ সালে অবলোপন ঋণ থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংক নগদ আদায় করতে পেরেছে মাত্র ১৪ শতাংশ। এর মধ্যে সর্বনিম্ন আদায়ের হার বেসিক ব্যাংকের, মাত্র আড়াই শতাংশ। আর বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের আদায়ের হার ১১ শতাংশ। এছাড়া সোনালী ব্যাংকের আদায়ের হার ১১ দশমিক ৮০ শতাংশ। তবে অগ্রণী, রূপালী ও জনতা ব্যাংকের আদায়ের হার ১৪ থেকে সাড়ে ২৬ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পর্যালোচনা প্রতিবেদনে ব্যাংকগুলোর অবলোপন ঋণ থেকে নগদ আদায়ের এই দুর্দশার চিত্র উঠে এসেছে।

জানা যায়, মন্দমানের খেলাপি ঋণ দীর্ঘদিন আদায় না হলে তা ব্যাংকের মূল ব্যালান্সশিট থেকে আলাদা করে অন্য একটি লেজারে সংরক্ষণ করা হয়, যা ব্যাংকিং পরিভাষায় ঋণ অবলোপন বা রাইট অফ নামে পরিচিত। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালার আওতায় ২০০৩ সাল থেকে ব্যাংকগুলো ঋণ অবলোপন করে আসছে। সাধারণত খেলাপি হওয়ার পর মামলা করেও কোনো ঋণ আদায়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে এলে সে ঋণ অবলোপন করে ব্যাংকগুলো। তবে অবলোপন করা ঋণ পুনঃতফসিল বা পুনর্গঠন করা যায় না। যদিও ঋণ অবলোপনের সুযোগ রাখাকে বরাবরই অস্বচ্ছ বলে মন্তব্য করে আসছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, ঋণ অবলোপনের মাধ্যমে ব্যাংকগুলো নিজেদের আর্থিক অনিয়মও আড়াল করছে। তাছাড়া একবার কোনো ঋণ অবলোপন করা হলে তা আদায়ের জন্য খুব বেশি চেষ্টা করা হয় না।

সূত্রগুলো বলছে, গত কয়েক বছরে ব্যাংক খাতে হলমার্ক, বিসমিল্লাহ, বেসিক ব্যাংকসহ বেশ কিছু আলোচিত ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় হাজার হাজার কোটি টাকা বের করে নেয়া হয়েছে। এসব ঋণের বড় অংশই খেলাপি হওয়ার পর অবলোপন করে হিসাবের খাতা থেকে আলাদা করা হয়েছে। কিন্তু সেই অবলোপন করা ঋণ থেকেও আদায়ে গতি নেই।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ঋণ দেয়ার সময় সতর্কতা অবলম্বন না করার কারণে আজ এই অবস্থা। ওপর মহলের চাপে ঋণ দিয়ে এখন সেই টাকা আর আদায় করতে পারছে না ব্যাংক। এখন ব্যাংক খাত বাঁচাতে হলে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই। অন্যথায় ঋণখেলাপি, পুনঃতফসিল ও অবলোপনের মতো উচ্চ ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ বাড়তেই থাকবে।

জানা যায়, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার উন্নয়নে ২০০৭ সাল থেকে সমঝোতা চুক্তি (এমওইউ) করে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ধারাবাহিকতায় ২০২৩ সালেও ব্যাংকগুলোর সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমওইউ সই হয়। এমওইউতে ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষণ, ঋণ প্রবৃদ্ধি যথাযথ রাখা, খেলাপিঋণ ন্যূনতম সীমায় নামিয়ে আনা, শীর্ষ ২০ খেলাপিসহ অন্যান্য খেলাপি এবং অবলোপন করা খেলাপি থেকে নগদ আদায় জোরদার,  লোকসানি শাখা ও পরিচালন ব্যয় কমানো, বৃহদাঙ্ক ঋণের এক্সপোজার কমিয়ে আনা এবং ঋণ প্রদানে শীর্ষ শাখা ব্যতীত অন্যান্য শাখার মাধ্যমে ঋণ বিতরণের শর্তারোপ করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই সমঝোতা স্মারকের আওতায় ব্যাংকগুলোকে বেঁধে দেয়া বিভিন্ন লক্ষ্যমাত্রা ও শর্ত পূরণের অগ্রগতি সন্তোষজনক নয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, ২০২২ সাল শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকের অবলোপন করা ঋণের স্থিতি ছিল ১৮ হাজার ১৩৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০২৩ সালে নগদ আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা

দেওয়া হয়েছিল এক হাজার ৭৯০ কোটি টাকা। এর বিপরীতে ব্যাংকগুলো আদায় করতে পেরেছে মাত্র ২৫৪ কোটি টাকা, যা পুরো বছরের লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ১৪ দশমিক ১৯ শতাংশ। এ সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক ৫০০ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আদায় করেছে ৫৯ কোটি টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার ১১ দশমিক ৮ শতাংশ। জনতা ব্যাংক ৩৩০ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আদায় করেছে ৮৭ কোটি ৬৮ লাখ টাকা বা ২৬ দশমিক ৫৬ শতাংশ। অগ্রণী ব্যাংক ৪০০ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আদায় করেছে ৫৬ কোটি টাকা বা ১৪ শতাংশ। রূপালী ব্যাংক ৬০ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আদায় করেছে ১৩ কোটি ৪৭ লাখ টাকা বা ২২ দশমিক ৪৫ শতাংশ। বিডিবিএল এক হাজার ৫২০ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আদায় করেছে ৩৩ কোটি টাকা বা ১১ শতাংশ। আর বেসিক ব্যাংক ২০০ কোটি টাকার বিপরীতে আদায় করতে পেরেছে মাত্র পাঁচ কোটি টাকা বা ২ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০২২ সালেও অবলোপন করা ঋণ থেকে ব্যাংকগুলোর আদায় পরিস্থিতি সন্তোষজনক ছিল না। ওই বছরে সোনালী ব্যাংক লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ১৬ শতাংশ, জনতা ব্যাংক ৩৩ শতাংশ, অগ্রণী ব্যাংক ২২ শতাংশ ও রূপালী ব্যাংক ১৯ শতাংশ ঋণ আদায় করতে সক্ষম হয়েছিল। বিডিবিএল ও বেসিক ব্যাংকের আদায়ের হার ছিল আরও কম।