শেখ শাফায়াত হোসেন: দেশের ব্যাংক খাতে অবলোপন করা ঋণ বাড়ছেই। গত সেপ্টেম্বর শেষে অবলোপন করা খেলাপি ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ৩৯ হাজার ৮৬১ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের স্থিতির সঙ্গে অবলোপন করা ঋণ যোগ করা হলে দেশের ব্যাংক খাতের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় এক লাখ ৫৬ হাজার ১৪৯ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর শেষে দেশের ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের স্থিতি ছিল এক লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা, যা ওই সময় পর্যন্ত বিতরণ করা ঋণের ১১ দশমিক ৯৯ শতাংশ। ওই সময় দেশের বিতরণ করা ঋণের স্থিতি ছিল ৯ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। সে হিসেবে অবলোপন করা খেলাপি ঋণসহ মোট খেলাপি ঋণ বিতরণ করা ঋণের ১৬ দশমিক ১০ শতাংশ।
ব্যাংক ব্যবস্থায় মন্দ মানে শ্রেণিকৃত খেলাপি ঋণ স্থিতিপত্র (ব্যালান্স শিট) থেকে বাদ দেওয়াকে ঋণ অবলোপন বলে। যদিও অবলোপন করা ঋণের গ্রাহক খেলাপি গ্রাহক হিসেবেই বিবেচিত হয়। গ্রাহক পুরো টাকা পরিশোধ না করা পর্যন্ত তা প্রকৃত অর্থে খেলাপি ঋণই থাকে। ২০০৩ সাল থেকে ব্যাংকগুলো ঋণ অবলোপন করে আসছে। চলতি বছরের শুরুতে খেলাপি ঋণ অবলোপনের নীতিমালায় শিথিলতা আনে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর পর থেকে অবলোপন করা ঋণও বাড়ছে।
গত ফেব্রুয়ারিতে সামগ্রিক ব্যাংক খাতে অবলোপন করা ঋণের স্থিতি ছিল ৩৮ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকা। সে হিসেবে সেপ্টেম্বর শেষে নিট অবলোপনকৃত ঋণ বেড়েছে এক হাজার ১১৬ কোটি টাকা।
গত ৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের এক সার্কুলারে বলা হয়, এখন থেকে ব্যাংকগুলো তিন বছর পর মন্দ মানের খেলাপি ঋণ অবলোপন করে ব্যালান্স শিট বা স্থিতিপত্র থেকে বাদ দিতে পারবে। আবার অবলোপন করার জন্য আগের মতো শতভাগ প্রভিশন লাগবে না। দুই লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ অবলোপনে মামলা করতে হবে না।
এর আগ পর্যন্ত কোনো ঋণ মন্দমানে শ্রেণিকৃত হওয়ার পাঁচ বছর পূর্ণ না হলে তা অবলোপন করা যেত না। মামলা না করে অবলোপন করা যেত ৫০ হাজার টাকার খেলাপি ঋণ। আর শতভাগ প্রভিশন বা ওই ঋণের সমপরিমাণ অর্থ নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখা লাগত।
গত জানুয়ারিতে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই আ হ ম মুস্তফা কামাল খেলাপি ঋণ কমানোর ঘোষণা দেন। এর পরই ঋণ অবলোপন নীতিমালায় শিথিলতা আনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর পাশাপাশি বিশেষ সুবিধার আওতায় খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল ও এককালীন এক্সিট সুবিধা দিয়ে সার্কুলার জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এই সুবিধার আওতায় ঋণ পুনঃতফসিলের আবেদনের মেয়াদ সম্প্রতি বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ফলে আরও বেশ কিছু খেলাপি ঋণ নিয়মিত হবে এবং ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ কমে আসবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তবে অবলোপনের নীতিমালা শিথিল করা হলেও মন্দমানের খেলাপি ঋণ আদায় খুব বেশি হচ্ছে না। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ এ তিন মাসে অবলোপন খেলাপি ঋণের বিপরীতে আদায়ের হার মাত্র শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ। এর পরও অবলোপন নীতিমালায় আরও শিথিলতা চেয়ে গত আগস্টে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে চিঠি দেন ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) নেতারা। অবশ্য ওই আবেদনে সাড়া দেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিশেষায়িত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অবলোপন করা ঋণের টাকা আদায় করতে পারছে না।
চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (বিকেবি) অবলোপন করা ঋণ থেকে ২১১ কোটি ৫৯ লাখ টাকা আদায়ের লক্ষ্য নিয়েছে। কিন্তু জুলাই থেকে গত ১২ নভেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটি মাত্র ৭১ লাখ টাকা আদায় করতে পেরেছে। একইভাবে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) চলতি অর্থবছরে ১৫৩ কোটি টাকা আদায় করবে বলে ঠিক করেছে। কিন্তু আদায় করতে পেরেছে মাত্র ৮১ লাখ টাকা। আর বিশেষায়িত আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইসিবি ২৬৩ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যের বিপরীতে সাড়ে চার মাসে এক টাকাও আদায় করতে পারেনি। কর্মসংস্থান ব্যাংক ১৪ কোটি টাকা লক্ষ্যের বিপরীতে আদায় করেছে ১৯ লাখ টাকা। আনসার ভিডিপি ব্যাংক তিন কোটি ৩০ লাখ টাকা আদায়ের লক্ষ্যের বিপরীতে এক লাখ টাকা আদায় করেছে।
ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘এক বছর ধরে খেলাপি রয়েছে, এমন ঋণও অবলোপনের সুযোগ চেয়ে আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আবেদন করেছিলাম। শতভাগ প্রভিশন রেখে এবং মামলা করে যদি এক বছরের মধ্যে খেলাপি ঋণ অবলোপন করা যায়, তাহলে ব্যাংকগুলোর জন্য অনেক বেশি সহায়ক হবে।’
তবে এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক এখন পর্যন্ত কোনো কিছু জানায়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘অবলোপন করা ঋণের মধ্যে থেকেও আদায় হয়। তবে এর হার খুব কম। ব্যাংকগুলোকে এই হার বাড়াতে হবে।’