আতাউর রহমান: দেশের পুঁজিবাজারে আলোচিত কারসাজিকারী সমবায় অধিদপ্তরের ডেপুটি রেজিস্ট্রার আবুল খায়ের হিরো। প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার পোর্টফোলিও ম্যানেজ করছেন হিরো ও তার সহযোগীরা। এরই মধ্যে হিরোর পরিবারের সদস্যরাও জড়িত। তাদের সঙ্গে আছে যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাজারে নিজ কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কারসাজিকারী জাভেদ এ মতিন। তবে দুই বছর ধরে কারসাজি করে এলেও কিছুই বলেনি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। কারণ এ কারসাজিতে বিএসইসির এক শীর্ষ কর্মকর্তা জড়িত বলে জানা যায়। দীর্ঘদিন চুপ করে থাকলেও বাজার-সংশ্লিষ্টদের চাপে এবং সব পর্যায়ে প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয় বিএসইসি। কারসাজির কারণে ‘নামমাত্র’ জরিমানা করে দায় সারে বিএসইসি, যা নজরে আসে সংশ্লিষ্টদের। এ কারণে বিএসইসির সক্ষমতা ও অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
এদিকে হিরোর সঙ্গে ব্যবসায় জড়িয়ে ফেঁসে যাচ্ছে ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান এবং তার প্রতিষ্ঠান মোনার্ক। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসায় অংশীদার হিরো ও জাভেদ এ মতিন। হিরো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার সময় থেকে পুঁজিবাজারে জড়িত থাকলেও দুই বছর আগে তিনি নিজের অস্তিত্ব জানান এবং জাভেদকে সঙ্গে নিয়ে সাকিবের সঙ্গে ব্যবসা শুরু করেন। তাদের একত্র করেন বিএসইসির এক কর্মকর্তা। হিরোর বিপক্ষে পুঁজিবাজারে কারসাজির অভিযোগ ছাড়া অন্য কোনো বিষয় না থাকলেও জাভেদের বিপক্ষে রয়েছে নানা অভিযোগ।
জাভেদ এ মতিন আন্তর্জাতিক প্রতারণার সঙ্গে জড়িত। দীর্ঘ ৪০ বছর যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী এই ব্যক্তি দুই বছর আগে বাংলাদেশে ফেরেন। যুক্তরাষ্ট্রে পুঁজিবাজারে নিজ কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কারসাজি করে তিনি ধরা পড়েন। এজন্য তাকে হাজার কোটি টাকা জরিমানা করা হয়। এছাড়া ২০২০ সালে এক অস্ট্রেলীয় নাগরিকের মালিকানাধীন হংকংয়ের একটি কোম্পানি থেকে প্রতারণা করে ১ কোটি ৩৩ লাখ ডলার হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ওই অর্থই তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাচার করে বাংলাদেশে এনেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। বাংলাদেশে আসার পর জাভেদ পুঁজিবাজারসহ অন্য খাতে অর্থ বিনিয়োগ করেন। তার সঙ্গে এ কাজে অংশীদার হন আবুল খায়ের হিরো ও সাকিব আল হাসান। তাদের সঙ্গে নিয়ে জাভেদ মোনার্ক হোল্ডিংস লিমিটেড নামে একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। একই সঙ্গে বাগিয়ে নেন স্টক এক্সচেঞ্জের ব্রোকারেজ হাউস লাইসেন্স। পাশাপাশি গড়ে তোলেন ই-কমার্স সাইট মোনার্ক মার্ট, মুন্সীগঞ্জে মোনার্ক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টসহ আরও বেশ কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
সাম্প্রতিক সময়ে পুঁজিবাজারে কারসাজির ১৭টি ঘটনায় এ পর্যন্ত ২০ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ২০ কোটি ৬ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এর মধ্যে ১১টি ঘটনাই হিরো সিন্ডিকেটের। তবে সরাসরি জরিমানার তালিকায় হিরোর নাম রয়েছে শুধু আইপিডিসির শেয়ার কারসাজিতে। অন্যগুলোয় হিরোর পরিবারের সদস্যদের নাম রয়েছে। বিএসইসির হিসাবে ২০ কোটি ১৬ লাখ টাকা জরিমানার বিপরীতে গ্রুপগুলো মোট রিয়ালাইজড (শেয়ার বিক্রি হয়েছে) মুনাফা করেছে ৮৫ কোটি ৯৯ লাখ। এছাড়া আনরিয়ালাইজড (শেয়ার বিক্রি করা হয়নি) মুনাফা ১০৯ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ তদন্তের দিন পর্যন্ত গ্রুপগুলোর মুনাফা ১৯৫ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, পুঁজিবাজারে কারসাজির কারণে কয়েক বছরে ছোট-বড় মিলিয়ে ৪৭টি ঘটনায় জরিমানা করেছে কমিশন। এছাড়া ৮১টি ঘটনা প্রক্রিয়াধীন। ওই তালিকায় হিরো সিন্ডিকেটের নাম রয়েছে।
সম্প্রতি যে বিষয়টি সামনে এসেছে তা হলো, সাকিব আল হাসানের শেয়ার কেলেঙ্কারি। এক্ষেত্রে এ পর্যন্ত ৬টি কোম্পানির শেয়ার কারসাজিতে সাকিব আল হাসানের সরাসরি জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে। এগুলো হলোÑএশিয়া ইস্যুরেন্স, ওয়ান ব্যাংক, ফরচুন শুজ, বিডিকম, আইপিডিসি ও এনআরবিসি ব্যাংক। এসব বিষয় নিয়ে ২০২০ সালের ১২ ডিসেম্বর একটি জাতীয় পত্রিকায় অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
পরবর্তীকালে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বিএসইসিতে একাধিক তদন্ত প্রতিবেদন পাঠায় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)। এসব কারসাজির ঘটনায় উচ্চ লেনদেনে হিরোর সঙ্গে আরও কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নাম উঠে এসেছে।
সাকিব আল হাসান নিজ নামে ৪টি বিও অ্যাকাউন্ট খুলে অস্বাভাবিকভাবে শেয়ার লেনদেন করেছেন। এর মধ্যে ট্রাস্ট ব্যাংক ইনভেস্টমেন্টে ১৬০৫৫৪০০৭৪১৪০৭১৯ বিও অ্যাকাউন্ট, ইবিএল সিকিউরিটিজে ১২০১৯৫০০৬৪৯৭৬২৩৭, এসবিএল ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্টে ১৬০৪৫৩০০৬৯৫৮৫৫৭৪, আইআইডিএফসিতে ক্লায়েন্ট কোড ০৮০৪৯ এবং মোনার্ক হোল্ডিংস লিমিটেডের অগ্রণী ইকুইটি অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টে ১৬০৫১১০০৭১২১২০১০ বিও অ্যাকাউন্টে শেয়ার লেনদেন করেছেন। তবে কারসাজি গ্রুপে তার নাম থাকলেও সরাসরি তাকে কোনো ধরনের শাস্তি দেয়নি কমিশন।
তথ্য মতে, এসব বিষয়ে সাকিবের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলেও দীর্ঘদিন তিনি দেশের বাইরে থাকায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। বিএসইসির সর্বোচ্চ কর্মকর্তা, হিরো ও জাভেদের কারণে ফেঁসে যাচ্ছেন সাকিব ও তার প্রতিষ্ঠান মোনার্ক।
বিনিয়োগকারীদের মতে, নিয়ন্ত্রক সংস্থা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়লে সরকারের পদক্ষেপ নেয়া উচিত, যাতে দেশের কোনো প্রতিষ্ঠানের এবং জনগণের বড় ক্ষতি না হয়। অন্যথায় পুঁজিবাজার ও বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এদিকে পুঁজিবাজারে মার্কেট মেকার কাজ করতে ডিএসই’র কাছে আবেদন জানিয়েছে ব্রোকারেজ হাউস মোনার্ক হোল্ডিংস লিমিটেড। তাই প্রতিষ্ঠানটির সক্ষমতা যাচাই করে নিবন্ধন সনদ দেয়ার জন্য বিএসইসিকে সুপারিশ করে ডিএসই। তবে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক জাভেদ এ মতিন ঋণখেলাপি হওয়ায় মোনার্ক হোল্ডিংসের মার্কেট মেকারের নিবন্ধন সনদ দেয়ার কাজ স্থবির হয়ে গেছে। সম্প্রতি ডিএসইর কাছে বিএসইসি এ-সংক্রান্ত একটি চিঠি পাঠিয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। একই সঙ্গে মোনার্ক হোল্ডিংসের পরিচালক জাভেদ এ মতিনকেও বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে।
মার্কেট মেকার হিসেবে কাজ করার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মোনার্ক হোল্ডিংসের পরিচালকদের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো (সিআইবি) ক্লিয়ারেন্স পেতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে চিঠি দেয় বিএসইসি। ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবি মোনার্ক হোল্ডিংসের পরিচালক জাভেদ এ মতিনের ঋণখেলাপির বিষয়টি নিশ্চিত করে। এরপর প্রতিষ্ঠানটির মার্কেট মেকারের নিবন্ধন সনদ দেয়া স্থগিত করে বিএসইসি।
বিএসইসির চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, মোনার্ক হোল্ডিংসের মার্কেট মেকার রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট দেয়ার বিষয়ে ডিএসইর কাছ থেকে গত ১৪ সেপ্টেম্বর পাঠানো একটি চিঠি ১৫ নভেম্বর বিএসইসির কাছে এসেছে। এর মধ্যে এ বিষয়ে গত ১১ অক্টোবর বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবি রিপোর্ট হাতে পায় বিএসইসি। রিপোর্ট অনুসারে জানা গেছে, মোনার্ক হোল্ডিংসের পরিচালক জাভেদ এ মতিন একজন ঋণখেলাপি।
এ বিষয়ে জানতে বিএসইসির কমিশনার ড. শেখ শামসুদ্দিন আহমেদের কাছে শেয়ার বিজ থেকে যোগাযোগের জন্য একাধিকবার কল করা হলে তিনি ফোন ধরেননি। পরে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ করা হলে, এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তিনি উত্তর দেননি।
বিএসইসিতে পাঠানো ডিএসইর চিঠিতে জানানো হয়, মোনার্ক হোল্ডিংস ডিএসইর সদস্যভুক্ত ট্রেকহোল্ডার (ট্রেক নম্বর-২৫২)। গত ৮ মে প্রতিষ্ঠানটি ডিএসইতে মার্কেট মেকারের নিবন্ধনের জন্য আবেদন জানিয়েছে। ওই আবেদনের ভিত্তিতে ডিএসই বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (মার্কেট মেকার) বিধিমালা, ২০১৭-এর প্রয়োজনীয় কল শর্ত পূরণ করেছে কিনা, তা যাচাই করে দেখেছে। সার্বিক দিক বিবেচনায় প্রতিষ্ঠানটির মার্কেট মেকার হিসেবে কাজ করার জন্য সক্ষমতা রয়েছে বলে মনে করে ডিএসই। তাই প্রতিষ্ঠানটির মার্কেট মেকারের আবেদন বিবেচনা করা যেতে পারে।
এদিকে গত ৮ মে মোনার্ক হোল্ডিংসের বজানা গেছে, মোনার্ক হোল্ডিংস লিমিটেড প্রতিষ্ঠিত হয় ২০২০ সালের ১৯ অক্টোবর। কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদে চেয়ারম্যান হিসেবে সাকিব আল হাসান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী সাদিয়া হাসান (সমবায় অধিদপ্তরের উপ-নিবন্ধক ও বিনিয়োগকারী মো. আবুল খায়ের হিরোর স্ত্রী), পরিচালক জাভেদ এ মতিন ও পরিচালক আবুল কালাম মাতবর (মো. আবুল খায়ের হিরোর বাবা) রয়েছেন। কোম্পানিটির মোট পরিশোধিত মূলধন ১০ কোটি টাকা। কোম্পানিটির শেয়ার সংখ্যা ১০ লাখ, যার প্রতিটির মূল্য ১০০ টাকা করে।