নিজস্ব প্রতিবেদক: পদ্মা সেতুর মূল অবকাঠামোর নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে প্রায় ৯৭ শতাংশ। আগামী জুনে সেতুটি যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়ার প্রস্তুতিও নিচ্ছিল সেতু কর্তৃপক্ষ। এরই মাঝে গত সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা করেন বছরের শেষ দিকে উদ্বোধন করা হবে পদ্মা সেতু। মূলত ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে মালামাল আমদানি ব্যাহত হওয়ায় উদ্বোধন পিছিয়ে যাবে।
এর পর থেকেই সাধারণ মানুষের মধ্যে উৎকণ্ঠা তৈরি হয়Ñঠিক কবে নাগাদ সেতুটি উদ্বোধন হবে। তবে সে উৎকণ্ঠাকে দূর করে গতকাল সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ঘোষণা করেন আগামী জুনেই উদ্বোধন হতে পারে পদ্মা সেতু। আর প্রকল্প কর্তৃপক্ষ বলছে, যুদ্ধের জন্য কিছু সমস্যা থাকলেও জুনের মধ্যেই শেষ করা হবে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ। তবে উদ্বোধনের বিষয়টি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এ বিষয়ে তাদের কোনো বক্তব্য নেই।
তথ্যমতে, ১৯৯৮ সালের ২৩ জুন উদ্বোধন করা হয়েছিল দেশের সর্ববৃহৎ সেতু। যমুনা নদীর ওপর নির্মিত বঙ্গবন্ধু সেতুটি উদ্বোধন করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে বছর পদ্মা সেতু নির্মাণে প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু হয়। আর সে থেকেই পদ্মা সেতুর জন্য অপেক্ষার পালা। এরই ধারাবাহিকতায় সেতুটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছিল ২০০১ সালের ৪ জুলাই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাওয়ায় এ ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। তিনি কথা দিয়েছিলেন পরবর্তী নির্বাচনে জিতে আবারও ক্ষমতায় গেলে পদ্মা সেতু নির্মাণ শুরু করবেন। তবে তা হয়নি।
এদিকে পদ্মা সেতুর শেষ স্প্যান বসানো হয় ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর। আর সর্বশেষ ডেক স্লাযাব বসানো হয় গত বছর ২৩ আগস্ট। এর পর থেকেই মূলত সেতুটির উদ্বোধনের অপেক্ষার প্রহর গোনা শুরু। তবে সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে আগামী ২৩ জুন পদ্মা সেতু যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর উপহার হিসেবে ২৩ জুন তারিখটি নির্বাচন করা হয়। তবে গত জানুয়ারিতে এ সিদ্ধান্ত নেয়ার কিছুদিন পর শুরু হয় ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। এতে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে পদ্মা সেতুর নির্মাণসামগ্রী আমদানি বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে সেতুটির উদ্বোধন নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়। এর মাঝেই প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দেন পিছিয়ে যাচ্ছে উদ্বোধন।
যদিও গতকাল এক অনুষ্ঠানে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ঘোষণা দেন, শতভাগ সততার সঙ্গে পদ্মা সেতুর কাজ করা হচ্ছে। আগামী জুনেই সেতুটি উদ্বোধন করা হতে পারে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম শেয়ার বিজকে বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য কিছু সমস্যা হচ্ছে। তবে আমাদের লক্ষ্য জুনের মধ্যে মূল সেতুর কাজ শেষ করা। সেভাবেই কাজ এগিয়ে নেয়া হচ্ছে। তবে উদ্বোধনের বিষয়টি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। সে বিষয়ে সেতু কর্তৃপক্ষের কোনো বক্তব্য নেই।’
উদ্বোধন পিছিয়ে যাবে বলে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের এ ধরনের কিছু জানানো হয়নি। পত্রপত্রিকা দেখে বিষয়টি জেনেছি। তবে আমরা নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছি।’
প্রসঙ্গত, ২০০১ সালে সরকার পরিবর্তন হওয়ার পর বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সময় সেতুটি নির্মাণে চূড়ান্ত সম্ভাব্যতা যাচাই কাজ পরিচালনা করে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা)। এর ভিত্তিতে মাওয়া-জাজিরা রুটটি পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য চূড়ান্ত করা হয়। এরপর প্রকল্পটি বাস্তবায়নে অর্থায়ন সংগ্রহে বিভিন্ন দাতা সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করে চারদলীয় জোট সরকার। তবে অর্থায়ন প্রক্রিয়া চূড়ান্ত না হওয়ায় প্রকল্পটি আর এগোয়নি।
এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নিয়ে সেতু নির্মাণের কার্যক্রম আবার চালু করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে শুরু হয় পদ্মা সেতুর নকশা প্রণয়নের কাজ। এজন্য ২০০৮ সালের ১০ জুলাই এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সঙ্গে চুক্তি সই হয়। পদ্মা সেতুর নকশা প্রণয়নের দায়িত্ব পায় যুক্তরাজ্যভিত্তিক মনসেল-এইকম। যদিও পরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে রেলপথ সংযুক্ত করায় নকশা প্রণয়ন প্রক্রিয়া সংশোধন করা হয়।
ওই নকশার ভিত্তিতে পদ্মা সেতুর নির্মাণব্যয় আবার প্রাক্কলন করা হয়, যার ভিত্তিতে ২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি প্রথম দফায় পদ্মা সেতু প্রকল্পটি সংশোধন করা হয়। এতে সেতুর নির্মাণব্যয় দাঁড়ায় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি ২০ লাখ টাকা। তখন দুইতলা সেতু (নিচতলায় রেল এবং ওপরতলায় সড়ক) নির্মাণের বিষয়টি চূড়ান্ত হয়। এর পরপরই বিশ্বব্যাংকসহ চার সংস্থা প্রকল্পটিতে ঋণ দিতে চুক্তি সই করে।
যদিও দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগে বিশ্বব্যাংকসহ চার সংস্থাই ঋণ স্থগিত করে পদ্মা সেতু প্রকল্পে। পরে ঋণদাতা চার সংস্থাকে বাদ দিয়েই পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার একক সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়। তবে এতে দুই বছর পিছিয়ে যায় প্রকল্পের কাজ।
ঠিকাদার নিয়োগশেষে দেখা যায়, বেড়ে গেছে পদ্মা সেতুর নির্মাণব্যয়। এজন্য ২০১৬ সালে দ্বিতীয় দফা সংশোধনের পর ব্যয় দাঁড়ায় ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি। এরপর প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন না করলেও ২০১৮ সালের জুনে আবারও ব্যয় এক হাজার ৪০০ কোটি টাকা বাড়ানো হয়। সে সময় প্রকল্পটির ব্যয় দাঁড়ায় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা।
এদিকে ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর পদ্মা সেতুর মূল কাজ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর প্রথম স্প্যান বসানো হয় ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। জাজিরা প্রান্তে ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারের মাঝে প্রথম স্প্যান বসানো হয়েছিল। তবে নকশা জটিলতায় আবারও বিলম্বিত হয় পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ। এরপর করোনার জন্য আরেক দফা পেছানো হয় এর বাস্তবায়নকাল। তবে সর্বশেষ ২৩ জুনকে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের সময়কাল ধরেই কাজ করছে সেতু কর্তৃপক্ষ।