নাসির উদ্দিন চৌধুরী, কুমিল্লা: ভাষাসৈনিক শহিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি দীর্ঘদিন ধরে অযতœ-অবহেলায় পড়ে আছে। বাড়িটি দেখে বোঝার উপায় নেই এখানেই বসবাস করতেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। বর্তমানে বাড়িটি ভুতুড়ে বাড়িতে পরিণত হয়েছে। দীর্ঘদিনেও মহান ভাষাসৈনিকের স্মৃতি রক্ষায় নেয়া হয়নি প্রশাসনিক কোনো উদ্যোগ। এতে করে ভাষা সংগ্রামের সঠিক ইতিহাস জানা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে নতুন প্রজš§।
২০১০ সালে তৎকালীন তথ্য ও সংস্কৃৃতিমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ বাড়িটি পরিদর্শন করতে এসে এখানে ‘ভাষাসৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মৃতি জাদুঘর’ নির্মাণের আশ্বাস দিলেও গত প্রায় ১১ বছরেও এর বাস্তবায়ন হয়নি।
জানা যায়, ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের রাজধানী করাচিতে গণপরিষদের অধিবেশন শুরু হয়। ২৫ ফেব্রুয়ারি ওই অধিবেশনে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত-ই সর্বপ্রথম রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবিতে সোচ্চার হন। তিনি অধিবেশনে স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, গণপরিষদে যে কার্যবিবরণী লেখা হয় তা ইংরেজি ও উর্দু ভাষায় লিপিবদ্ধ হয়। গোটা পাকিস্তানের ৫৬ শতাংশ মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলেন।
অধিবেশনে ইংরেজি ও উর্দুর সঙ্গে বাংলা ভাষা ব্যবহারের দাবি তুলেন তিনি। তখনকার পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান এতে ক্ষিপ্ত হন। এতে তিনি তৎকালীন পাকিস্তান-সরকারের রোষানলে পড়ে কয়েকবার কারাবরণ করেন। ভাষা আন্দোলনে ভূমিকা রাখার জন্য আগে থেকেই টার্গেট হয়েছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ।

আর সে কারণেই ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ গভীর রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কুমিল্লা নগরীর ধর্মসাগরের পশ্চিম পাড়ের এই বাড়ি থেকে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ও তার ছেলে দিলীপ কুমার দত্তকে কুমিল্লা সেনানিবাসে ধরে নিয়ে যায়। সেখানে ৮৫ বছর বয়স্ক এই দেশপ্রেমিক রাজনীতিককে অমানবিক নির্যাতন চালিয়ে বাপ-ছেলে দুই জনকেই হত্যা করা হয়। পরবর্তী সময়ে তাদের লাশের সন্ধানও পায়নি পরিবার।
এরপর থেকে এ বাড়ির অবকাঠামো ক্রমেই ভেঙে পড়তে থাকে। এই বাড়ি দেখে এখন আর বোঝার উপায় নেই, এখানে একসময় অবিভক্ত পাকিস্তানের এক প্রথিতযশা বর্ষীয়ান রাজনীতিক বসবাস করতেন।
ইতিহাসবিদ, গবেষক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আহসানুল কবির বলেন, ধীরেন্দ্রনাথের বাড়িটি শুধু কুমিল্লাবাসী নয়, এটি সারাদেশের মানুষের অহংকারের জায়গা। কিন্তু দুঃখজনক বিষয়, আজ বাড়িটি জীর্ণ-শীর্ণ অবস্থায় পড়ে রয়েছে। বাড়িটিকে কেন্দ্র করে আরও আগেই অনেক কিছু হতে পারত। কেন হয়নি এটি না ভেবে, এখনি রাষ্ট্রীয়ভাবে সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
কুমিল্লাবাসীর পক্ষে সরকারের কাছে জোরদাবি জানিয়ে তিনি বলেন, বাড়িটি সংস্করণে যদি আইনগত কোনো বাধা থাকে, প্রয়োজনে অধিগ্রহণ করে এখানে শহিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নামে একটি জাদুঘর করা হোক। যেটি দেখে শত শত বছর বাংলা ভাষাভাষীর মানুষ অনুপ্রাণিত হবে; যা নিয়ে কুমিল্লার মানুষ গর্ব করতে পারবে।
শহিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মৃতি রক্ষা পরিষদের সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট নাজমুল বারী চৌধুরী বলেন, ‘বাংলা ভাষার প্রস্তাবক ও ভাষাসৈনিক শহিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের স্মৃতি রক্ষার দাবিতে বিভিন্ন সময়ে আমরা আন্দোলন সংগ্রহসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছি। জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্বারক লিপিও দিয়েছি। আমাদের দাবি বাড়িটি সংস্কার করে আগমী প্রজšে§র জন্য ইতিহাস রক্ষায় ধীরেন্দ্রনাথের নামে একটি ভাষা জাদুঘর স্থাপন করা হোক।
কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র মনিরুল হক সাক্কু বলেন, সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে সবকিছু করাও সম্ভব নয়। এর আগে আমরা ২২ লাখ টাকা খরচ করে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নামে স্টেডিয়ামের মূল গেটটি নির্মাণ করে দিয়েছি। ধীরেন্দ্রনাথ পরিবারে লোকজন বাড়িটি সংস্কারের দাবি তুললে সাংস্কৃৃতিক মন্ত্রণালয় ওয়ান-টুতে করে দেবে। যেমনিভাবে কুমিল্লায় শচীন দেব বর্মণের বাড়িটি সংস্কার করা হয়েছে।