ইসমাইল আলী: সেতু নির্মাণে বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে পদ্মা নদীর দুই পাড়ে। নির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী এগিয়ে চলছে দেশের সর্ববৃহৎ প্রকল্প পদ্মা বহুমুখী সেতুর নির্মাণকাজ। তাই নির্ধারিত সময়ের আগেই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে বলে আশা প্রকাশ করেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের সুবিধার্থে মূল সেতু, নদী শাসন, মাওয়া ও জাজিরা সংযোগ সড়ক নির্মাণ, সার্ভিস এরিয়া এবং তদারকি পরামর্শকসংক্রান্ত মোট পাঁচটি প্যাকেজে ভাগ করে প্রকল্পের নির্মাণকাজ চলছে।
পদ্মার দুই পাড়ের সংযোগ সড়কসহ প্রকল্পের নির্মাণকাজ প্রায় ৩৯ শতাংশ শেষ হয়েছে। এছাড়া মূল সেতুর নির্মাণে পাইলিংয়ের কাজ চলছে। পরীক্ষামূলক পাইলিংয়ের কাজ এরই মধ্যে শেষ। এর পরেই শুরু হবে মূল পাইলিংয়ের কাজ। এছাড়া পুনর্বাসন, নদী শাসন, তদারকি ও পরিবেশ কার্যক্রমসহ প্রকল্পের অন্যান্য উন্নয়নমূলক কাজও চলছে একই সঙ্গে। দেশি-বিদেশিসহ প্রতিদিন প্রায় কয়েক হাজার শ্রমিক নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন পদ্মা সেতুর বিভিন্ন প্রকল্পে।
ছয় দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে দ্বিতলবিশিষ্ট সেতুটি নির্মিত হবে কংক্রিট আর স্টিল দিয়ে। এর ওপর দিয়ে গাড়ি ও নিচ দিয়ে ট্রেন চলাচল ব্যবস্থা থাকবে। মূল সেতু, সংযোজ সড়ক ও নদী শাসন সব প্যাকেজ মিলে সেতু প্রকল্পের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে মূল সেতু নির্মাণের কাজ করছে চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানি। এছাড়া অন্যান্য প্রকল্পে কাজ করছে আলাদা ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। তাই পদ্মা সেতু নির্মাণকে কেন্দ্র করে মুন্সীগঞ্জ জেলার মাওয়া এবং শরিয়তপুর জেলার জাজিরার বিশাল এলাকাজুড়ে চলছে ব্যাপক কর্মতৎপরতা।
সরেজমিনে পদ্মা সেতু এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, পদ্মা নদীর দুই পারে চলছে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ। চলছে সেতুর সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের জন্য রাস্তা নির্মাণ, মাটি পরীক্ষা, নদীর ওপর প্লাটফর্ম নির্মাণ, পাইল তৈরিসহ বিভিন্ন কাজকর্ম। এছাড়া নদী তীর থেকে বিশাল ক্রেনের মাধ্যমে মালপত্র ওঠানামার কাজ চলছে। পদ্মা নদীর দুই পাড়ে সেতুর সংযোগ সড়ক নির্মাণকাজ পুরোদমে এগিয়ে চলছে। ওপাড়ে শরীয়তপুর জেলার জাজিরা থানার নাওডোবা ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে সাড়ে ১০ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক নির্মাণকাজ শেষ পর্যায়ে। এই সড়কের মধ্যে ৯৭০ মিটারের পাঁচটি ছোট সেতু, ১৯টি বক্স কালভার্ট, আটটি আন্ডার পাস ও টোলবুথ নির্মাণ প্রক্রিয়া চলছে।
এদিকে প্রায় দুই দশমিক ৫০ কিলোমিটার মাওয়ার সংযোগ সড়কের নির্মাণে মাটি ফেলার কাজ প্রায় ৮০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। এরই মধ্যে টোল বুথ, কলভাটসহ অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ শেষ।
এ ব্যাপারে পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ স্বাভাবিক গতিতেই চলছে। ইতোমধ্যে দুই পাড়ের সংযোগ সড়কসহ অন্যান্য স্থাপনার প্রাথমিক কাজ এগিয়ে চলছে। এছাড়া মূল সেতু নির্মাণে সয়েল টেস্টের কাজ চলছে। তাই পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজের এই ধারা অব্যাহত থাকলে চার বছরের মধ্যেই সেতু নির্মাণের কাজ শেষ হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
সেতু সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার সঙ্গে ঢাকাসহ সারা দেশের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে ২০১৪ সালের নভেম্বর মাসে শুরু হয়েছিল পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ। ২০১৮ সালে পদ্মা সেতু দিয়ে চলাচল করবে যানবাহন ও রেল এই কর্মপরিকল্পনা নিয়েই এগোচ্ছে সবকিছু। ছয় দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে পদ্মা সেতু ৪২টি পিলারের ওপর নির্মিত হবে। ১৫০ মিটার পর পর পিলার বসানো হবে।
নিরলসভাবে এগিয়ে যাচ্ছে সংযোগ সড়ক, ইঞ্জিনিয়ার ও শ্রমিকদের আবাসন, সংযোগ সড়কে থাকা কালভার্ট, সংযোগ সড়কের পাশের সার্ভিস রোড় তৈরি, ওয়ার্কশপ, টোল প্লাজা, ড্রেজিং ও ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন কাজ। ভারী ভারী নির্মাণ যন্ত্র দিয়ে চলছে পাথর কাটা, মাটি কাটা, মাটি ভরাট, রাস্তা সমান করার কাজ। ওয়েল্ডিংয়ের আলোর ঝলকানি আর ভারী যন্ত্রপাতির শব্দে মুখরিত জাজিরার পদ্মাপাড়। চীন থেকে ইতোমধ্যে তিন শতাধিক প্রকৌশলী এসেছেন আরও কয়েক শতাধিক আসার কথা রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট সূত্র।
এ বিষয়ে সেতু বিভাগের সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, পদ্মা সেতুর নির্মাণে আগেই কর্মপরিকল্পনা করা আছে। সে অনুযায়ী এগিয়ে চলেছে প্রকল্পের বাস্তবায়ন। এখন পর্যন্ত ১৭ শতাংশ বাস্তব অগ্রগতি হয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০১৮ সালের ডিসেম্বরেই এর উদ্বোধন করা যাবে আশা করা যায়।
জানা গেছে, প্রকল্পের আওতায় মূল সেতুর জন্য ১২ হাজার ১৩৩ কোটি ব্যয় ধরা হয়েছে। দুই পাড়ের ১৩ কিলোমিটার নদী শাসনের জন্য আট হাজার ৭০৭ কোটি টাকার কাজ করছে চীনের সিনোহাইড্রো করপোরেশন।
এদিকে ৩৯ হাজার কোটি টাকা ব্যয় নির্ধারণ করে ঢাকার গেণ্ডারিয়া থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত ৮২ দশমিক ৩২ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হবে। এজন্য রেল বিভাগ ৩৬৫ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করছে। জাজিরার নাওডোবায় সার্ভিস এরিয়া-২-এর অধীনে পদ্মা রিসোর্ট নির্মাণ করা হবে। এখানে একটি মোটেল ম্যাস, একটি রিসোর্ট অভ্যর্থনা কেন্দ্র, একটি সুপারভেশন অফিস ও ৩০টি ডুপ্লেক্স ভবন নির্মাণের কাজও দ্রুত গতিতে এগোচ্ছে, যা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সম্পন্ন হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা। এদিকে প্রকল্পের সকল কাজ তদারকির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার কোরিয়ান এক্সপ্রেসওয়ে ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে।