Print Date & Time : 24 June 2025 Tuesday 10:09 am

অবৈধ দখলের কারণে ভৈরব নদ খনন নিয়ে সংশয়

মীর কামরুজ্জামান মনি, যশোর: প্রায় তিনশ কোটি টাকা ব্যয়ে যশোরের ভৈরব নদ খনন ও পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ নেওয়া হলেও শহরাংশের পরিকল্পিত প্রশস্ততা অর্জনে দেখা দিয়েছে সংশয়। কেননা যশোর শহর অংশের ১১৮ স্থাপনার মধ্যে ৩৫ স্থাপনা উচ্ছেদে নিষেধাজ্ঞা এসেছে জেলা প্রশাসনের কাছে। ওই স্থাপনাগুলোতে স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে বলা হয়েছে।
অবৈধ দখলদারদের কাছ থেকে ভৈরব নদ মুক্ত রাখতে ও নাব্য ফেরাতে যশোরাঞ্চলের গণমানুষের দাবি ছিল ভৈরব পুনঃখনন। যশোরবাসীর দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস উদ্বোধন করতে গিয়ে ভৈরব খননের প্রতিশ্রুতি দেন। এরপর পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ভৈরব নদের রিভার বেসিন এলাকার জলাবদ্ধতা দূরীকরণ ও টেকসই পানি ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন প্রকল্প নামে প্রকল্প গ্রহণ করে।
এ প্রকল্পের আওতায় চুয়াডাঙ্গা জেলার মাথাভাঙ্গা নদী থেকে যশোরের অভয়নগর উপজেলার আফরাঘাট পর্যন্ত ১২৯ কিলোমিটার নদী খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এজন্য ২৭২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। গত বছরের ১ জুলাই খননকাজ শুরু হয়ে ২০২১ সালের মধ্যে শেষ করার টার্গেট গৃহীত হলেও ঠিকাদারি জটিলতায় অগ্রগতি হোঁচট খায়।
গত অর্থবছরের শুরুতেই যশোর শহর অংশের বাবলাতলা সেতু থেকে ভাটির দিকে ছয় কিলোমিটার খননের জন্য দুটি টেন্ডার আহ্বান করা হয়। তিন কিলোমিটার খননের জন্য সরকারি খরচের টার্গেট ছয় কোটি টাকা। আর ছয় কিলোমিটারের জন্য ১২ কোটি টাকা। টেন্ডারে চারটি বড় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দরপত্র জমা দিলেও তারা দর দেয় দ্বিগুণ, অর্থাৎ তিন কিলোমিটারের জন্য তারা দর হাঁকে ১০ কোটি টাকা করে। এতে ওই দরপত্র পাউবো গ্রহণ করতে পারেনি। তাই পুনঃটেন্ডার আহ্বান করে পাউবো। এতে পাউবো চাহিদামতো ঠিকাদার পেয়ে যায়, কার্যাদেশও দেওয়া হয়। শহর অংশে প্রথম খনন শুরু করার টার্গেট থাকলেও ভৈরবের দু’পাড়ের ১১৮টি কাঁচা-পাকা অবৈধ স্থাপনা বহাল থাকায় খনন প্রথম শুরু হয় শহরতলির কনেজপুর থেকে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যানুযায়ী ওইসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ না হওয়া পর্যন্ত কাজ চলবে অন্য অংশে।
এক বছরেরও বেশি সময় অপেক্ষার পর গত মার্চে কনেজপুর থেকে কাক্সিক্ষত ভৈরব নদ খনন শুরু হলেও শহর অংশের অবৈধ স্থাপনার কারণে লক্ষ্য অর্জিত হচ্ছে না। এখনও শুরু করা যায়নি শহর অংশে খননকাজ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বহু চেষ্টার পরও নদসীমানার চিহ্নিত ১১৮টি অবৈধ স্থাপনা অপসারণ করা যায়নি। ফলে নদের শহরের অংশে চার কিলোমিটার বাদ রেখেই এ খননকাজ চলছে। অথচ আগামী জুনের মধ্যেই অধিকাংশ খননকাজ শেষ করতে হবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে। এ অবস্থায় শহর অংশের খনন সম্পন্ন হওয়া নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
এরই মধ্যে ফতেপুর ঘোড়াগাছি অংশের ১৩ কিলোমিটারের ৭০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। আগামী বছরের জুনের মধ্যে বেশিরভাগ কাজ সম্পন্ন করতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বেশি করে এক্সক্যাভেটর নামানোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া কনেজপুর থেকে চৌগাছার তাহেরপুর অংশের ৫০ কিলোমিটারের জন্য দ্রুত টেন্ডার আহ্বান করা হচ্ছে।
ভৈরব নদের পাড়ের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে আইনগত বাধা না থাকলেও অজ্ঞাত কারণে জেলা প্রশাসন কালক্ষেপণ করেছে বলে দাবি পাউবোর। আর উচ্ছেদে কালক্ষেপণ হওয়ায় শেষমেশ শহরের অংশ খনন কবে হবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে বলে জানিয়েছেন পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী। ওইসব অবৈধ স্থাপনার ছবি তুলে এবং অবৈধ দখলদারদের নাম-ঠিকানা ও অবস্থান জেলা প্রশাসকের দফতরে দেওয়া হলেও গত ছয় মাসেও উচ্ছেদ ত্বরান্বিত হয়নি।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী প্রবীর কুমার গোস্বামী জানান, ভৈরব পুনঃখনন এগিয়ে চললেও সার্বিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ না হওয়ায়। ফতেপুর ঘোড়াগাাছি অংশের ১৩ কিলোমিটারের কাজ প্রায় শেষের পথে। অন্য অংশের কাজ দ্রুত শেষ করতে ঠিকাদারদের কমপক্ষে ১৫টি এসকেভেটর নামাতে বলা হয়েছে। আগামী বছরের জুনের মধ্যে ২৩ কিলোমিটারের কাজ শেষ করা হবে। এছাড়া অবশিষ্ট প্রায় ৫০ কিলোমিটার কাজ কনেজপুর থেকে তাহেরপুর পর্যন্ত টেন্ডার আহ্বান করা হবে। শহরের চার কিলোমিটার অংশে শুধু বাধা দু’পাড়ের ১১৮ অবৈধ স্থাপনা। জেলা প্রশাসন দ্রুত এসব স্থাপনা উচ্ছেদ করলে খনন ত্বরান্বিত হবে। স্থাপনা উচ্ছেদ না হলে ভৈরব নদের শহর অংশ খনন সম্ভব হবে না। আর শহরের অংশ খনন না হলে এই পুনঃখনন কার্যত কোনো কাজেই আসবে না।
এদিকে ভৈরব নদ সংস্কার কমিটির উপদেষ্টা ইকবাল কবির জাহিদ জানান, ভৈরব নদ বাঁচিয়ে রাখতে না পারলে গোটা শহরে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হবে। ফলে যেকোনো মূল্যে নদের নাব্য ফিরিয়ে আনতে হবে।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মুহাম্মদ রেজায়ে রাব্বি জানান, আইনি জটিলতা আইন দিয়েই মোকাবিলা করা হবে। মূলত অবৈধ দখলদাররা আদালতে যে দাবি তুলেছেন তা অযৌক্তিক। নদীসংক্রান্ত ঐতিহাসিক সিএস ম্যাপ রায় অনুযায়ী এগোবে আইনি প্রক্রিয়া। নদী কমিশন, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও জেলা প্রশাসন যৌথভাবে আইনি লড়াইয়ে নামছে। দ্রুততম সময়ে নিষেধাজ্ঞা বাতিল করিয়ে উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। আর শুরু হবে বহু কাক্সিক্ষত শহর অংশে খননকাজ। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক আবদুল আওয়াল জানান, কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।