Print Date & Time : 21 June 2025 Saturday 5:53 pm

অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসায় শীর্ষে রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিটক

হামিদুর রহমান : বেসরকারি একটি কোম্পানির শীর্ষ নির্বাহীর কাছে গত সপ্তাহে কানাডা থেকে একটি ফোনকল আসে। টেলিটক নাম্বার দেখে তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের ভেতর থেকেই ফোনটি এসেছে। তবে কথা বলতে গিয়ে বুঝতে পারেন, এ ফোনটি এসেছে দেশের বাইরে থেকে। অস্পষ্ট কথার মাঝেই কলটি কেটে যায়। পরে আরেকটি টেলিটক নাম্বার থেকে কল আসে। সেটিও কানাডা থেকে।

একই ধরনের অভিজ্ঞতার কথা জানান হাইকোর্টের এক আইনজীবী। সম্প্রতি তার সাবেক এক সহকর্মী ব্রিটেন থেকে ফোন করেন তাকে। টেলিটক নাম্বার দেখে প্রথমে বোঝা যায়নি কলটি কোথা থেকে এসেছে। তবে কথা বলতে গিয়ে জানতে পারেন, এটি দেশের বাইরে থেকে আসা কল।

এভাবে অহরহই অবৈধ পন্থায় ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রোটোকলÑভিওআইপির মাধ্যমে কল আসছে দেশে। এতে একদিকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের বৈধ আন্তর্জাতিক কলের ব্যবসায়ী আইজিডব্লিউ (ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে) প্রতিষ্ঠানগুলো। অন্যদিকে অবৈধভাবে দেশের অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে। আর অবৈধ এ ভিওআইপি ব্যবসার শীর্ষে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি টেলিটক।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারের পাশাপাশি অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা, প্রতারণা ও বিভিন্ন অপঃপ্রচার বন্ধে বায়োমেট্রিক পদ্ধতি চালু করা হয়। তবে বায়োমেট্রিক পদ্ধতি চালু করা হলেও ঠেকানো যাচ্ছে না অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা। অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা বন্ধে দেশের বেসরকারি মোবাইল ফোন অপারেটরগুলো কিছুটা সোচ্চার হলেও টেলিটকের মাধ্যমে এ ব্যবসা বেশি হচ্ছে। এজন্য চার বছরে প্রায় ৯৭ হাজার সিম জব্দ করা হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত এ কোম্পানির।

তথ্যমতে, গত চার বছরে সারা দেশে অবৈধ ভিওআইপির বিরুদ্ধে ১৬৯টি অভিযান পরিচালনা করে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। এর বিপরীতে প্রায় ১৪৬টি মামলা করা হয়। এসব অভিযানে দেশের মোবাইল ফোন অপারেটরগুলোর এক লাখ ৮১ হাজার ৮৭৫টি অবৈধ সিম জব্দ করা হয়।

অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসার জন্য ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশের চারটি অপারেটরের ৩০ হাজার ১৩৯টি সিম জব্দ করা হয়। সে বছর গ্রামীণফোনের চার হাজার ৯৫৬টি, বাংলালিংকের এক হাজার ৯১টি, রবি আজিয়াটার ১৩ হাজার ২৮৭টি ও টেলিটকের ১০ হাজার ৮০৫টি সিম জব্দ করা হয়।

২০১৬-১৭ অর্থবছরে ভিওআইপির জন্য জব্দ করা হয় প্রায় ৩২ হাজার ৮৫০টি অবৈধ সিম। এর মধ্যে গ্রামীণফোনের এক হাজার ২৭৫টি, বাংলালিংকের এক হাজার ৩৬টি, রবি আজিয়াটার পাঁচ হাজার ৯৮৯টি ও টেলিটকের ২৪ হাজার ৫৯০টি সিম জব্দ করা হয়।

অন্যদিকে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে জব্দ করা হয় ১৫ হাজার ৫৭৩টি অবৈধ সিম। এর মধ্যে গ্রামীণফোনের ৪৩৮টি অবৈধ সিম, বাংলালিংকের ৪৭৮টি, রবি আজিয়াটার পাঁচ হাজার ৩৩০টি ও টেলিটকের ৯ হাজার ৩৩০টি সিম জব্দ করা হয়।

এদিকে গত অর্থবছর অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসার জন্য সবচেয়ে বেশি অভিযান চালানো হয়। এর সংখ্যা ছিল ৯৩টি আর মামলা করা হয় ৭৭টি। এসব অভিযানে জব্দ করা হয় এক লাখ পাঁচ হাজার ৩১০টি অবৈধ সিম। এর মধ্যে গ্রামীণফোনের ছয় হাজার ৩০১টি অবৈধ সিম, বাংলালিংকের আট হাজার ৭৪১টি, রবি আজিয়াটার ৩৭ হাজার ৯৬৭টি ও টেলিটকের ৫২ হাজার ৫১টি সিম জব্দ করা হয়। এছাড়া গত অর্থবছর র‌্যাংগস টেলের ২২০টি সিমও জব্দ করা হয়।

গত চার বছরে সবচেয়ে বেশি সিম জব্দ হয় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অপারেটর টেলিটকের। অপারেটরটির চার বছরে ৯৬ হাজার ৭৭৬টি অবৈধ সিম জব্দ করা হয়। অর্থাৎ অর্ধেকের বেশি অবৈধ ব্যবসা হয়েছে টেলিটকের মাধ্যমে। আর গ্রামীণফোনের চার বছরে জব্দ করা হয় ১২ হাজার ৯৭০টি ও বাংলালিংকের ১১ হাজার ৩৪৬টি। এছাড়া রবি আজিয়াটার জব্দ করা হয় ৬২ হাজার ৫৩৩টি।

এ বিষয়ে টেলিটকের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেয়ার বিজকে বলেন, ‘বিষয়গুলো নিয়ে আমরা অত্যন্ত দায়িত্বের সঙ্গে কাজ করছি। কোনো সিমের বিরুদ্ধে অবৈধ ব্যবহারের অভিযোগ পেলে আমরা সঙ্গে সঙ্গে তা বন্ধ করছি। আসলে অবৈধ ভিওআইপির কাজে সিম ব্যবহারের বিষয়গুলো সহজে ধরা যায় না। যারা অবৈধ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত তারা কৌশলে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতেই সিমগুলো সংগ্রহ করে থাকে, যা তাৎক্ষণিক ধরার উপায় নেই। তবে আমাদের কেউ অভিযোগ করলে বা অন্য যে কেউ এর সঙ্গে জড়িত থাকলে আমরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করি। এছাড়া বর্তমানে সিম বিক্রিতে নজরদারি অতীতের তুলনায় অনেকাংশই বৃদ্ধি পেয়েছে।’

সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশ ও ব্যক্তির নিরাপত্তা জোরদার করতে বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে বায়োমেট্রিক পদ্ধতি চালু করা হলেও অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসায়ীরা ভিন্ন কৌশলে এসব সিম সংগ্রহ করে ব্যবসা পরিচালনা করছে। যদিও বিটিআরসির অতীতের যে কোনো সময়ে চেয়ে তৎপর। এরপরও টেলিটকের সিম ব্যবহার করে এ ব্যবসা করা যাচ্ছে না।

তারা জানান, অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসার ফলে সরকার প্রতি বছর বিপুল পরিমাণে রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কিছু অসৎ ব্যবসায়ীদের ফলে দেশের এমন ক্ষতি প্রত্যাশিত নয়। যারা অবৈধভাবে দেশে ভিওআইপি ব্যবসা করছে তাদের তালিকা খুব বড় নয়। সবাই সচেতন হলে ভিওআইপি ব্যবসা বন্ধ করা সম্ভব।

বিটিআরসি জানায়, একজন গ্রাহকের সিম সুরক্ষার জন্য মোবাইল ফোনে অপারেটরদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আর অবৈধ সিমের জন্য আমাদের জরিমানা নির্দেশনা রয়েছে। নির্দেশনা অনুযায়ী, যে কোনো মোবাইল ফোন অপারেটরের প্রতিটি অবৈধ সিমের জন্য ৫০ ডলার করে জরিমানা করা হচ্ছে। এসব অবৈধ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।