অবৈধ রেয়াত আর ভ্যাট ফাঁকিতে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো!

রহমত রহমান: নেয়া হয়েছে অবৈধ বা অতিরিক্ত রেয়াত। প্রতিষ্ঠানের ব্যয় বা কেনাকাটার ক্ষেত্রে সঠিকভাবে পরিশোধ করা হয়নি উৎসে মূসক। তামাক পাতা ক্রয়ে পরিশোধ করা হয়নি মোটা অঙ্কের ভ্যাট (মূসক)। চার বছরে অবৈধ রেয়াত গ্রহণ, উৎসে মূসক ও মূসক ফাঁকি দিয়েছে প্রায় ৩৩৩ কোটি টাকা। বহুজাতিক কোম্পানি ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ লিমিটেডের বিরুদ্ধে ভ্যাট ফাঁকি ও অবৈধ রেয়াত গ্রহণের অভিযোগ উঠেছে। মূসক নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের (ভ্যাট গোয়েন্দা) নিরীক্ষায় পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানটির এ অনিয়ম উঠে এসেছে। ব্যবস্থা নিতে সম্প্রতি এ প্রতিবেদন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) পাঠানো হয়েছে। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

সূত্রমতে, বাংলাদেশে বেনসন ও পলমল সিগারেটের মাধ্যমে বাজারে বড় ধরনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বিশ্ববাজারেও দাপটের সঙ্গে ব্যবসা করছে। ডানহিল, লাকি স্ট্রাইক, কেন্ট, পলমল, কুল, বেনসন ও রথম্যানস তামাকজাত পণ্যের উৎপাদনকারী এ প্রতিষ্ঠানটি তামাকজাত পণ্য বিক্রির দিকে থেকে বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহৎ প্রতিষ্ঠান। নিরীক্ষার মাধ্যমে বিএটি বাংলাদেশের ফাঁকি ও অনিয়ম উদঘাটনে ২০১৭ সালের ২৪ জানুয়ারি এনবিআর থেকে ভ্যাট গোয়েন্দাকে চিঠি দেয়া হয়। সে অনুযায়ী ২০১৭ সালের ২৮ মে নিরীক্ষা দল গঠন করে ভ্যাট গোয়েন্দা। ভ্যাট সংক্রান্ত দলিলাদি, বার্ষিক প্রতিবেদনসহ প্রয়োজনীয় দলিলাদি চেয়ে চিঠি দেয়া হলে প্রতিষ্ঠান থেকে পর্যায়ক্রমে সরবরাহ করা হয়। নিরীক্ষা দল ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানের দেয়া দলিলাদি ও এনবিআরের ভ্যাট সংক্রান্ত আদেশ, প্রজ্ঞাপনের আওতায় আড়াআড়ি যাচাই শেষে বিপুল পরিমাণ ফাঁকি ও অনিয়ম পায় নিরীক্ষা দল।

প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিএটি বাংলাদেশের সিগারেট উৎপাদনের মূল উপকরণ তামাক। এছাড়া সিগারেট উৎপাদনে সিগারেট পেপার, এসিটেট টো, টিপিং পেপার, অ্যাডিহেসিভ, অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল, গ্লিসারিন, কার্টন, বিওপিপি, কেমিক্যালস, শেল, সøাইড প্রভৃতি ব্যবহার করা হয়। এসব উপকরণ ও সেবার ওপর রেয়াত নেয় প্রতিষ্ঠানটি। যাচাই করার পর দেখা গেছে, চার বছরে অবৈধ ও অতিরিক্ত রেয়াত নিয়েছে ৯ কোটি ২৮ হাজার ৪৫১ টাকা। এর মধ্যে ২০১৫ সালে ৭৪ লাখ ৬১ হাজার ৫৬৭ টাকা, ২০১৬ সালে দুই কোটি ৮৫ লাখ ৪৫ হাজার ২২৮ টাকা, ২০১৭ সালে দুই কোটি ৮১ লাখ ৩১ হাজার ৩৮৬ টাকা ও ২০১৮ সালে দুই কোটি ৫৮ লাখ ৯০ হাজার ২৬৯ টাকা।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিএটি বাংলাদেশ বেনসন, গোল্ডলিফ (জেপিজিএল), ক্যাপস্টন, স্টার, রয়েল, ডারবি, লাকি, পাইলট, হলিউড ব্র্যান্ডের সিগারেট উৎপাদন ও বাজারজাত করে। এসব সিগারেট উৎপাদনে কী পরিমাণ তামাক পাতা ব্যবহƒত হয়েছে এবং কী পরিমাণ পাতা অপচয় হয়েছেÑতার হিসাব করা হয়েছে। ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি গোল্ডলিফ, বেনসনের কয়েকটি ব্র্যান্ড, স্টার, ডারবি, পাইলট, হলিউড উৎপাদন ও বাজারজাত করেছে। যাচাইয়ে দেখা গেছে, ২০১৫ সালে সিগারেট উৎপাদনে বিএটি ৩ কোটি ৪ লাখ ১ হাজার ৫২৫ কেজি (অবচয়সহ) তামাক ব্যবহার করেছে। এছাড়া ২০১৬ সালে ৩ কোটি ৫৩ লাখ ৯৮ হাজার ২৫২ কেজি, ২০১৭ সালে ৩ কোটি ৮০ লাখ ২৭৫ কেজি ও ২০১৮ সালে ৩ কোটি ৪৫ লাখ ৪৯ হাজার ৩৪৪ কেজি তামাক ব্যবহার করেছে। মূসক-১৫ অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটি চার বছরে তামাক ব্যবহার করেছে ১৩ কোটি ৩১ লাখ ১৯ হাজার ৮৭২ কেজি। মূসক-১ অনুযায়ী তামাক ব্যবহার করেছে ১৩ কোটি ৮৩ লাখ ৪৯ হাজার ৩৯৬ কেজি। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটি ৫২ লাখ ২৯ হাজার ৫২৬ কেজি তামাক ব্যবহার করলেও এর ওপর কোনো সম্পূরক শুল্ক, ভ্যাট ও স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ পরিশোধ করেনি। এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, উৎপাদন প্রক্রিয়াকরণের সময় তামাকের পাতাগুলো এমনভাবে গুঁড়া করা হয়, যা বাতাসে উড়ে যাওয়ায় ব্যবহার করা যায় না। ব্যবহার করতে না পারায় বিক্রিও করা যায় না।

তামাক পাতার হিসাবে দেখা গেছে, তামাক পাতা ক্রয় এনবিআরের আদেশ দ্বারা অব্যাহতিপ্রাপ্ত হলেও ক্রয়ের ক্ষেত্রে মূসক চালান-১১ (ভ্যাট চালান) নেয়া বাধ্যতামূলক। ভ্যাট চালান ছাড়া ক্রয়ের ক্ষেত্রে উৎসে মূসক কর্তন করতে হবে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি সেই উৎসে মূসক কর্তন করে সরকারি কোষাগারে জমা দেয়নি। হিসাবে দেখা গেছে, বিএটি চার বছরে আমদানি ও স্থানীয়ভাবে তামাক পাতা ক্রয় করেছে। স্থানীয়ভাবে প্রায় তিন হাজার ২৬ কোটি টাকার বেশি তামাক পাতা ক্রয় করেছে। যোগানদার হিসেবে এর ওপর প্রযোজ্য মূসক ১৫ শতাংশ। মূসক-১১ না থাকায় ১৫ শতাংশ হারে এর ওপর প্রযোজ্য মূসক ১৫১ কোটি ২৯ লাখ ২৮ হাজার ৫৭৭ টাকা। ২ শতাংশ হারে প্রযোজ্য সুদ ১৬৯ কোটি ৬৩ লাখ ৮৫ হাজার ৮৫১ টাকা। সুদসহ তামাক পাতায় ভ্যাট ফাঁকি ৩২০ কোটি ৯৩ লাখ ১৪ হাজার ৪২৮ টাকা। তবে এ বিষয়ে বিতর্ক রয়েছে। এ নিয়ে দিকনির্দেশনা চেয়ে এনবিআরকে চিঠি দিয়েছে ভ্যাট গোয়েন্দা।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক প্রতিবেদন যাচাই করা হয়। লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে বিএটি বাংলাদেশ এর ব্যয় বা কেনাকাটার ওপর উৎসে মূসক প্রযোজ্য। যাচাইয়ে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন প্রকাশনা বা প্রিন্টিং, রিপেয়ার অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স, প্লান্ট অ্যান্ড মেশিনারি, সিকিউরিটি অ্যান্ড সেফটি, ট্রান্সপোর্টেশান, ক্লিয়ারিং, রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, ভাড়া, গাড়ি মেরামত, ফরিন ট্রেনিং, লোকাল ট্রেনিং, স্যানিটারি, লিগ্যাল অ্যান্ড প্রফেশনাল ফি, ইনফরমেশান টেকনোলজি, ট্রেড মার্কেটিংসহ বিভিন্ন খাতে ব্যয় বা কেনাকাটার ক্ষেত্রে মূসক কর্তন করে সরকারি কোষাগারে জমা দেয়নি। এতে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি চার বছরে ব্যয় করেছে ১০ হাজার ৬১৭ কোটি ১৫ লাখ ৯৪ হাজার ৫৭৫ টাকা। যার মধ্যে উৎসে মূসকযোগ্য ব্যয়ে প্রযোজ্য উৎসে মূসক ৩০৪ কোটি ৯৯ লাখ ৬১ হাজার ১৭১ টাকা। এর মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন খাতে এক কোটি ৬১ লাখ ১২ হাজার ৯৬৯ টাকা পরিশোধ না করে পরিহার বা ফাঁকি দিয়েছে। ২ শতাংশ হারে এর ওপর প্রযোজ্য সুদ দুই কোটি ১৭ লাখ ৮১ হাজার ৭৮৪ টাকা। সুদসহ ফাঁকি ৩ কোটি ৭৮ লাখ ৯৪ হাজার ৭৫২ টাকা।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটি ব্যয় বা কেনাকাটার ক্ষেত্রে সুদসহ ৩ কোটি ৭৮ লাখ ৯৪ হাজার ৭৫৩ টাকা, মূসক চালান ছাড়া তামাক ক্রয় করে সুদসহ ৩২০ কোটি ৯৩ লাখ ১৪ হাজার ৪২৮ টাকা ও অতিরিক্ত বা অবৈধ রেয়াত নেয়ার মাধ্যমে ৯ কোটি ২৮ হাজার ৪৫১ টাকাসহ চার বছরে মোট ৩৩৩ কোটি ৭২ লাখ ৩৭ হাজার ৬৩২ টাকা ফাঁকি দিয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী ফাঁকি দেয়া রাজস্ব আদায়ে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানানো হয়। তবে প্রতিষ্ঠানটি চার বছরে ৮৩৭ কোটি ৫১ লাখ ৫৪ হাজার টাকার তামাক রপ্তানি করেছে। রপ্তানির টাকা দেশে প্রত্যাবাসিত হয়েছে।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে বিএটি’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেহজাদ মুনীমের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন নম্বরে বেশ কয়েকবার ফোন দেয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। হোয়াটসঅ্যাপে বক্তব্যের বিষয় লিখে দেয়া হলে তিনি দেখেও কোনো জবাব দেননি। এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে লিখিত বক্তব্যে বিএটি বাংলাদেশের হেড অব এক্সটার্নাল অ্যাফেয়ার্স শেখ শাবাব আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, ‘বিএটি বাংলাদেশে ১১২ বছর ধরে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে। আমরা বরাবরই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে ব্যবসা পরিচালনা করি। এ ধরনের কোনো দাবির বিষয়ে আমরা এখনও অবগত নই। তবে ভ্যাট চালান ছাড়া তামাক পাতা ক্রয়ের সংক্রান্ত আমাদের একটি মামলা আদালতে বিচারাধীন থাকায় এটি একটি সাব জুডিস বিষয়। তাই এই বক্তব্যের ওপর কোনো মতামত পোষণ করা সমীচীন হবে না।’

সূত্রমতে, ব্রিটিশ আমেরিকান ট্যোবাকো চলতি হিসাব বছরের প্রথম নয় মাসের (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) মুনাফার ওপর ভিত্তি করে অন্তর্বর্তীকালীন লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। কোম্পানিটি আলোচিত সময়ের জন্য শেয়ারহোল্ডারদের ১০০ শতাংশ লভ্যাংশ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এছাড়া চলতি হিসাব বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে কোম্পানির শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে ৭ টাকা ৫৯ পয়সা। গত বছর একই সময় ইপিএস হয়েছিল ৫ টাকা ৪৫ পয়সা। হিসাব বছরের প্রথম নয় মাসে কোম্পানিটির ইপিএস হয়েছে ২৪ টাকা ৫২ পয়সা। গত বছর একই সময় যা ২১ টাকা ৪১ পয়সা ছিল। ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো ১৯৭৭ সালে দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। কোম্পানির অনুমোদিত মূলধন ৫৪০ কোটি টাকা এবং পরিশোধিত মূলধন ৫৪০ কোটি টাকা। এতে কোম্পানির মোট শেয়ার সংখ্যা ৫৪ কোটি। কোম্পানির রিজার্ভে ৩ হাজার ১৪১ কোটি ৮২ লাখ টাকা রয়েছে। কোম্পানিটির মোট শেয়ারের ৭২ দশমিক ৯১ শতাংশ উদ্যোক্তা ও পরিচালক, দশমিক ৬৪ সরকার, ১২ দশমিক ৭৩ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী, ৬ দশমিক ৫২ শতাংশ বিদেশি বিনিয়োগকারী এবং ৭ দশমিক ২০ শতাংশ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে রয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার লেনদেন শেষে কোম্পানির শেয়ারের সর্বশেষ দর ছিল ৫১৮ টাকা ৭০ পয়সা।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০