রহমত রহমান: নেয়া হয়েছে অবৈধ বা অতিরিক্ত রেয়াত। তাও আবার এক, দুই টাকা নয়Ñপ্রায় ৯ কোটি টাকা। যে পণ্যে রেয়াত প্রযোজ্য নয়, সেই পণ্যেও রেয়াত নেয়া হয়েছে। ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ লিমিটেড (বিএটিবি) এই অবৈধ রেয়াত নিয়েছে। নিরীক্ষায় অবৈধ রেয়াত নেয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে। বৃহৎ করদাতা ইউনিটের (এলটিইউ) কারণ দর্শানো নোটিশ জারির পর অবৈধ রেয়াত নেয়ার বিষয়টি স্বীকার করে দেশের সবচেয়ে বড় সিগারেট উৎপাদন ও বাজারজাতকারী কোম্পানি বিএটিবি। অবশেষে অতিরিক্ত সেই রেয়াতের টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিয়েছে। সম্প্রতি বিএটিবি কর্তৃপক্ষ এই টাকা জমা দিয়েছে। অবৈধ রেয়াত ছাড়াও বহুজাতিক এই কোম্পানির ব্যয় বা কেনাকাটাসহ চার বছরে প্রায় ২৫৯ কোটি টাকা অনিয়ম খুঁজে পেয়েছে মূসক নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর (ভ্যাট গোয়েন্দা)। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
এনবিআর সূত্রমতে, নিরীক্ষার মাধ্যমে বিএটি বাংলাদেশের ফাঁকি ও অনিয়ম উদ্ঘাটনে ২০১৭ সালের ২৪ জানুয়ারি এনবিআর থেকে ভ্যাট গোয়েন্দাকে চিঠি দেয়া হয়। সে অনুযায়ী ২০১৭ সালের ২৮ মে নিরীক্ষা দল গঠন করে ভ্যাট গোয়েন্দা। ভ্যাট-সংক্রান্ত দলিলাদি, বার্ষিক প্রতিবেদনসহ প্রয়োজনীয় দলিলাদি চেয়ে চিঠি দেয়া হলে প্রতিষ্ঠান থেকে পর্যায়ক্রমে সরবরাহ করা হয়। নিরীক্ষা দল ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানের দেয়া দলিলাদি ও এনবিআরের ভ্যাট-সংক্রান্ত আদেশ, প্রজ্ঞাপনের আওতায় আড়াআড়ি যাচাই শেষে অবৈধ রেয়াতসহ প্রায় ৩৩৩ কোটি টাকার অনিয়ম পায় নিরীক্ষা দল। পরে ২০২২ সালের ২৫ অক্টোবর এলটিইউকে ব্যবস্থা নিতে ভ্যাট গোয়েন্দা প্রতিবেদন দেয়। প্রতিবেদনের কিছু অংশের বিষয়ে আপত্তি তোলা হলে ভ্যাট গোয়েন্দা আবার যাচাই করে। এতে ফাঁকির পরিমাণ কিছুটা কমে প্রায় ২৫৯ কোটিতে দাঁড়ায়, যার মধ্যে প্রায় ৯ কোটি টাকার বেশি অবৈধ বা অতিরিক্ত রেয়াত রয়েছে। পরে চলতি বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি এলটিইউকে ব্যবস্থা নিতে সংশোধিত প্রতিবেদন দেয়া হয়।
সূত্র আরও জানায়, ভ্যাট গোয়েন্দার প্রতিবেদন অনুযায়ী, দাবিনামা-সংবলিত কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করে এলটিইউ। এতে বিএটি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আইন ও বিধিবহির্ভূতভাবে অতিরিক্ত ৯ কোটি ২৮ হাজার ৪৫১ কোটি টাকা রেয়াত নেয়ার বিষয়টি স্বীকার করা হয়। ২২ জুন বিএটি অবৈধভাবে নেয়া এই রেয়াতের টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিয়ে ২৫ জুন এলটিইউকে চিঠি দিয়ে জানায়। বিএটি বাংলাদেশ এর সিগারেট উৎপাদনের মূল উপকরণ হলো তামাক। এছাড়া সিগারেট উৎপাদনে সিগারেট পেপার, এসিটেট টো, টিপিং পেপার, অ্যাডহেসিভ, অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল, গ্লিসারিন, কার্টন, বিওপিপি, কেমিক্যালস, শেল ও সøাইড প্রভৃতি ব্যবহƒত হয়। এসব উপকরণ ও সেবার ওপর রেয়াত নেয় প্রতিষ্ঠানটি। ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত চার বছরে অবৈধ ও অতিরিক্ত রেয়াত নিয়েছে ৯ কোটি ২৮ হাজার ৪৫১ টাকা। এর মধ্যে ২০১৫ সালে ৭৪ লাখ ৬১ হাজার ৫৬৭ টাকা, ২০১৬ সালে দুই কোটি ৮৫ লাখ ৪৫ হাজার ২২৮ টাকা, ২০১৭ সালে দুই কোটি ৮১ লাখ ৩১ হাজার ৩৮৬ টাকা ও ২০১৮ সালে দুই কোটি ৫৮ লাখ ৯০ হাজার ২৬৯ টাকা।
এলটিইউ সূত্র জানায়, দাবিনামা-সংবলিত কারণ দর্শানো নোটিশ জারির পর বিএটি অবৈধভাবে নেয়া এই রেয়াত সরকারি কোষাগারে জমা দিয়েছে। যেহেতু প্রতিষ্ঠান অবৈধ বা অতিরিক্ত রেয়াত নেয়ার বিষয়টি স্বীকার করে সরকারি কোষাগারে টাকা জমা দিয়েছে, সেহেতু ভ্যাট গোয়েন্দার আনীত অভিযোগের সত্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ফলে ‘মূল্য সংযোজন কর আইন, ১৯৯১’-এর ধারা ৯(২) অনুযায়ী বিএটির এই রেয়াত বাতিল করা হয়েছে।
ভ্যাট গোয়েন্দার সংশোধিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিএটি ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যয় বা কেনাকাটার ক্ষেত্রে এক কোটি ৬১ লাখ ১২ হাজার ৯৬৯ টাকা উৎসে মূসক পরিশোধ করেনি। ফাঁকি দেয়া এই ভ্যাটের ওপর দুই শতাংশ হারে সুদসহ দাঁড়ায় তিন কোটি ৭৮ লাখ ৯৪ হাজার ৭৫৩ টাকা। এছাড়া মূসক চালান ছাড়া তামাক ক্রয় করার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি ১২১ কোটি ৯০ লাখ ৫৬ হাজার ৫০৯ টাকার উৎসে মূসক ফাঁকি দিয়েছে, যা সুদসহ দাঁড়িয়েছে ২৪৬ কোটি ২৮ লাখ ৭৯ হাজার ৩৭৫ টাকা। এছাড়া অতিরিক্ত বা অবৈধ রেয়াত নেয়া হয়েছে ৯ কোটি ২৮ হাজার ৪৫১ টাকা। চার বছরে বিএটি ২৫৯ কোটি আট লাখ দুই হাজার ৫৭৯ টাকার রাজস্ব ফাঁকি বা অনিয়ম প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিএটি বাংলাদেশ বেনসন, গোল্ডলিফ (জেপিজিএল), ক্যাপস্টন, স্টার, রয়েল, ডারবি, লাকি, পাইলট, হলিউড ব্র্যান্ডের সিগারেট উৎপাদন ও বাজারজাত করে। এসব সিগারেট উৎপাদনে কী পরিমাণ তামাক পাতা ব্যবহƒত হয়েছে এবং কী পরিমাণ পাতা অপচয় হয়েছে, তার হিসাব করা হয়েছে। ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে প্রতিষ্ঠানটি গোল্ডলিফ, বেনসনের কয়েকটি ব্র্যান্ড, স্টার, ডারবি, পাইলট, হলিউড উৎপাদন ও বাজারজাত করেছে।
প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১৫ সালে সিগারেট উৎপাদনে বিএটি তিন কোটি চার লাখ এক হাজার ৫২৫ কেজি (অবচয়সহ) তামাক ব্যবহার করেছে। এছাড়া ২০১৬ সালে তিন কোটি ৫৩ লাখ ৯৮ হাজার ২৫২ কেজি, ২০১৭ সালে তিন কোটি ৮০ লাখ ২৭৫ কেজি এবং ২০১৮ সালে তিন কোটি ৪৫ লাখ ৪৯ হাজার ৩৪৪ কেজি তামাক ব্যবহার করেছে। মূসক-১৫ অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটি চার বছরে তামাক ব্যবহার করেছে ১৩ কোটি ৩১ লাখ ১৯ হাজার ৮৭২ কেজি। আর মূসক-১ অনুযায়ী তামাক ব্যবহার করেছে ১৩ কোটি ৮৩ লাখ ৪৯ হাজার ৩৯৬ কেজি। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটি ৫২ লাখ ২৯ হাজার ৫২৬ কেজি তামাক ব্যবহার করলেও এর ওপর কোনো সম্পূরক শুল্ক, ভ্যাট ও স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ পরিশোধ করেনি। এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, উৎপাদন প্রক্রিয়াকরণে তামাকের পাতাগুলো এমনভাবে গুঁড়ো করা হয়, যা বাতাসে উড়ে যাওয়ার ফলে ব্যবহার করা যায় না। ব্যবহার করতে না পারায় বিক্রিও করা যায় না।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ লিমিটেডের (বিএটি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেহজাদ মুনীমের ব্যবহার্য ফোন ব্যক্তিগত নম্বরে ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। হোয়াটসঅ্যাপে বক্তব্যের বিষয় লিখে দেয়া হলে তিনি সিন করেন। তবে জবাব দেননি।