আমদানি নিষিদ্ধ হলেও দেশে নিয়মিতই স্বর্ণ চোরাচালান হয়। মাঝেমধ্যে বিমানবন্দরে কিছু ধরা পড়লেও বেশিরভাগ সময়ই তা থেকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা স্বর্ণের এসব চালানের বিষয়ে বিস্তারিত কখনোই জানা যায়নি। সম্প্রতি ‘কারনেগি ইনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস’ নামক এক সংস্থার গবেষণায় বাংলাদেশে অবৈধভাবে স্বর্ণ আমদানির বিষয়টি উঠে আসে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করে শেয়ার বিজ। এ নিয়ে আজ ছাপা হচ্ছে ধারাবাহিকের প্রথম পর্ব

ইসমাইল আলী: বাংলাদেশে বৈধপথে কখনোই স্বর্ণ আমদানি হতো না। বাংলাদেশ ব্যাংকে এর কোনো তথ্যও নেই। এছাড়া আইন অনুযায়ীও স্বর্ণ আমদানি ছিল নিষিদ্ধ। যদিও বাংলাদেশে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণে স্বর্ণ চোরাচালান হয়ে আসে। মাঝেমধ্যে বিমানবন্দরে বা উড়োজাহাজে স্বর্ণের এসব চালানের কিছুটা আটক করা হয়। তবে অবৈধভাবে আমদানি করা বাকি স্বর্ণ থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে।
সম্প্রতি ‘কারনেইজ এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস’ নামক এক বৈশ্বিক গবেষণা সংস্থার প্রকাশিত ‘দুবাই’স রোল ইন ফ্যাসিলিটিং করাপশন অ্যান্ড গ্লোবাল ইলিসিট ফিন্যান্সিয়াল ফ্লোস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে দুবাই থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্বর্ণ রপ্তানির চিত্র তুলে ধরা হয়। এতে দেখা যায়, আরব আমিরাত থেকে ২০১৬ সালে স্বর্ণ আমদানিতে চতুর্থ অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের স্বর্ণ আমদানির বিষয়ে অনুসন্ধানে উঠে আসে চাঞ্চল্যকর বিভিন্ন তথ্য।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, গত ছয় বছরে (২০১৪ থেকে ২০১৯ সাল) বাংলাদেশে অবৈধভাবে স্বর্ণ আমদানি হয়েছে এক লাখ ৭৯ হাজার ৬৯৫ কেজি বা এক কোটি ৫৪ লাখ ১১ হাজার ২৩৫ ভরি। এর পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণে গোল্ড পাউডার, অপরিশোধিত ও অর্ধপরিশোধিত (তরল) স্বর্ণও আমদানি করা হয়। আর সব মিলিয়ে স্বর্ণ আমদানিতে ছয় বছরে ব্যয় হয় প্রায় ২৫৫ কোটি ৭৯ লাখ ডলার।
প্রসঙ্গত, ‘কারনেগি ইনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস’ তাদের ‘দুবাই’স রোল ইন ফ্যাসিলিটিং করাপশন অ্যান্ড গ্লোবাল ইলিসিট ফিন্যান্সিয়াল ফ্লোস’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রণয়নে জাতিসংঘের বাণিজ্যবিষয়ক পরিসংখ্যান ‘ইউএন কমট্রেড’-এর তথ্য ব্যবহার করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে শেয়ার বিজ ‘ইউএন কমট্রেড’ থেকে বাংলাদেশে স্বর্ণ আমদানি-রপ্তানির ২০ বছরের তথ্য সংগ্রহ করে। এছাড়া ‘দুবাই’স রোল ইন ফ্যাসিলিটিং করাপশন অ্যান্ড গ্লোবাল ইলিসিট ফিন্যান্সিয়াল ফ্লোস’ প্রতিবেদনটির প্রণেতা দলের অন্যতম গবেষক ও গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভের সিনিয়র অ্যানালিস্ট মার্সেনা হান্টারের সঙ্গে ই-মেইলে যোগাযোগ করা হয়।
পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত ছয় বছরের মধ্যে পরিমাণের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি স্বর্ণ আমদানি হয় ২০১৭ সালে। সে বছর দেশে আসে ৭১ হাজার ১১৩ কেজি বা ৬০ লাখ ৯৮ হাজার ৮৮৫ ভরি স্বর্ণ। এছাড়া ২০১৬ সালে আমদানি করা হয় ৭০ হাজার ৬৯৩ কেজি বা ৬০ লাখ ৬২ হাজার ৮৬৪ ভরি স্বর্ণ। আর ২০১৫ সালে আমদানি করা হয় ২০ হাজার ৮২২ কেজি বা ১৭ লাখ ৮৫ হাজার ৭৬৩ ভরি স্বর্ণ।
এদিকে ২০১৮ সালে আমদানি করা হয় সাত হাজার ৮৩ কেজি বা ছয় লাখ সাত হাজার ৪৬১ ভরি স্বর্ণ। পাশাপাশি সে বছর প্রচুর অপরিশোধিত (তরল) স্বর্ণও আমদানি হয়, যার পরিমাণ পাওয়া যায়নি। এতে পরিমাণের দিক থেকে কম হলেও ওই বছরই স্বর্ণ আমদানি ব্যয় ছিল সবচেয়ে বেশি। এছাড়া ২০১৯ সালে ছয় হাজার ৪৩ কেজি বা পাঁচ লাখ ১৮ হাজার ২৬৮ ভরি এবং ২০১৪ সালে চার হাজার ১৭ কেজি বা তিন লাখ ৪৪ হাজার ৫১১ ভরি স্বর্ণ আমদানি করা হয়।
তথ্যমতে, ২০১৮ সালে স্বর্ণ আমদানিতে ব্যয় হয় ৬৯ কোটি ২২ লাখ ডলার। এরপর ২০১৫ সালে স্বর্ণ আমদানি ব্যয় ছিল বেশি। সে বছর আমদানি হয় ৬১ কোটি ৩৪ লাখ ডলারের স্বর্ণ। এছাড়া ২০১৬ সালে স্বর্ণ আমদানিতে ব্যয় হয় ৪২ কোটি ১৫ লাখ ডলার, ২০১৭ সালে ৩৯ কোটি ৯১ লাখ ডলার, ২০১৯ সালে ২৬ কোটি ৮৬ লাখ ডলার ও ২০১৪ সালে ১৬ কোটি ৩২ লাখ ডলার।
যদিও স্বর্ণ আমদানির বিষয়টি অস্বীকার করছেন স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা। এ বিষয়ে স্ব^র্ণ ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) সাধারণ সম্পাদক দিলীপ কুমার আগারওয়ালার কাছে জানতে চাইলে তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, ‘বাংলাদেশে এত বিশাল পরিমাণ স্বর্ণ আমদানির বিষয়টি সঠিক নয়। কোথাও ভুল হয়ে থাকতে পারে। কেননা ১৯৯৭ সালের আইন অনুযায়ী এত পরিমাণ স্বর্ণ আমদানির সুযোগ নেই।’
তিনি বলেন, ‘২০১৮ সালে সরকার স্বর্ণ আমদানি নীতিমালা করেছে। এর আওতায় চলতি অর্থবছর প্রথম স্বর্ণ আমদানি করেছে আমাদের প্রতিষ্ঠান ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড। এর আগে স্বর্ণ আমদানির কোনো রেকর্ড নেই। তবে অবৈধভাবে স্বর্ণ এসে থাকলে সে তথ্য আমাদের জানা নেই।’
এদিকে বাংলাদেশে সব ধরনের পণ্য আমদানির তথ্য ও পরিসংখ্যান সংরক্ষণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে দেশে স্বর্ণ আমদানির কোনো তথ্য নেই বাংলাদেশ ব্যাংকেও। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগে যোগাযোগ করা হলে তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
এ বিষয়ে গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভের সিনিয়র অ্যানালিস্ট মার্সেনা হান্টার ই-মেইল বার্তায় শেয়ার বিজকে জানান, স্বর্ণের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য ইউএন কমট্রেডের তথ্য বিশ্বব্যাপী ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়। তবে ইউএন কমট্রেডে সব দেশ স্বর্ণ আমদানি-রপ্তানির তথ্য প্রদান করে না। আবার কখনও কখনও এক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, যাতে তথ্যের কিছুটা গড়মিল দেখা যায়। আর এ গড়মিলটাই মূলত স্বর্ণ চোরাচালান।
উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের আগেও দেশে স্বর্ণ আমদানি হয়েছে, যদিও পরিমাণের ও মূল্যের দিক থেকে তা ছিল তুলনামূলকভাবে কম। এর মধ্যে ২০১৩ সালে প্রায় পাঁচ কোটি ডলার ব্যয়ে এক হাজার ২৯৭ কেজি বা এক লাখ ১১ হাজার ২৩৫ ভরি স্বর্ণ আমদানি করা হয়। তবে এর আগে কখনোই কোটি ডলারের স্বর্ণ আমদানি হয়নি।