অভিভাবকশূন্য দেশের আর্থিক খাত!

শেখ আবু তালেব: দেশের ব্যাংক ও আর্থিক খাতের অন্যতম অভিভাবক বাংলাদেশ ব্যাংক। গতকাল মেয়াদ শেষ হওয়ায় শূন্য হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর পদ। অপরদিকে রাষ্ট্রের অর্থ ব্যবস্থা পরিচালিত হয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে। অর্থমন্ত্রীও এক মাসের ছুটিতে লন্ডন অবস্থান করছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। ফলে করোনা মহামারির এ সময়ে কার্যত দেশের আর্থিক খাত অভিভাবকশূন্য হয়ে পড়েছে।

২০১৬ সালের ২০ মার্চ গভর্নর হিসেবে নিয়োগ পান সাবেক আমলা ফজলে কবির। তাকে যখন নিয়োগ দেওয়া হয়, তখন তিনি রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র সফরে ছিলেন। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে যোগ দিতে চার দিনের মতো সময় লেগেছিল। প্রথম মেয়াদে ফজলে কবিরকে চার বছরের জন্য গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। গত ১৯ মার্চ তার মেয়াদ শেষ হয়। কিন্তু গত ১৬ ফেব্রুয়ারি সরকার তাকে আরও তিন মাস ১৩ দিনের জন্য মেয়াদ বাড়িয়ে দ্বিতীয় দফায় নিয়োগ দেয়।

বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার, ১৯৭২ অনুযায়ী, ৬৫ বছর বয়স পর্যন্ত কোনো ব্যক্তি গভর্নরের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। গত ১৯ মার্চ গভর্নর হিসেবে মেয়াদ শেষ হওয়ার সময়ে ফজলে কবিরের বয়স ৬৫ হতে তিন মাস ১৩ দিন বাকি ছিল। তার বয়স ৬৫ বছর হওয়ার শেষ দিন পর্যন্ত নিয়োগ দেয় সরকার। অর্থাৎ শেষ দিন শুক্রবার হওয়া সত্ত্বেও তাকে তিন মাস ১৩ দিনের জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়। সে হিসাবে গতকাল তার মেয়াদ শেষ হয়। যদিও দাপ্তরিক কাজের শেষ কর্মদিবস ছিল গত বৃহস্পতিবার। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন অভিভাবকশূন্য।

এমন পরিস্থিতিতে একজন ডেপুটি গভর্নরকে রুটিন দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। গত ২ জুলাই এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দেওয়া হয়। এতে উল্লেখ করা হয়, গভর্নর পদ শূন্য থাকা অবস্থায় দুই ডেপুটি গভর্নর (ডিজি) এসএম মনিরুজ্জামান ও আহমেদ জামাল নিজ দায়িত্ব পালন করে যাবেন। তারা কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আলোচনা করতে পারবেন।

ডিজি মনিরুজ্জমান সিনিয়র হওয়ায় তাকে গভর্নরের কাজগুলো করে যেতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নতুন গভর্নর দায়িত্ব নেওয়ার পর আলোচিত সময়ে নেওয়া সিদ্ধান্তগুলোর বিষয়ে অনুমোদন নিতে হবে।

জানা গেছে, ফজলে কবিরকে আবার গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দিতে সংশোধন করা হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার। সংশোধিত বিধান কার্যকর হলে কোনো ব্যক্তি ৬৭ বছর বয়স পর্যন্ত গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। আইনটি সংশোধন করা হলে প্রথম সুবিধা পাবেন ফজলে কবির।

আইনটির খসড়া মন্ত্রিসভায় অনুমোদন হয়েছে। এখন জাতীয় সংসদে পাস হলে রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের পর গেজেট প্রকাশিত হবে। আগামী ৮ জুলাই পর্যন্ত সংসদ মুলতবি ঘোষণা করা হয়েছে। সংসদ অধিবেশন শুরু হলে আইনটির সংশোধনী অনুমোদন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর পরই নতুন করে গভর্নর হিসেবে নিয়োগ পেতে পারেন ফজলে কবির। সে হিসাবে আরও এক সপ্তাহের বেশি সময় গভর্নর পদ শূন্য থাকবে বাংলাদেশ ব্যাংকের।

মুদ্রানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, সরকারের ঋণের জোগান এবং সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগে অর্থের সরবরাহ ও বৈদেশিক লেনদেন কার্যক্রম বাংলাদেশ ব্যাংকই করে থাকে। রাষ্ট্রের পক্ষে মুদ্রা তৈরি, প্রচলন ও ব্যবস্থাপনার মতো গুরুদায়িত্ব ও দেশের বাইরে সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এছাড়া ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে কাজ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

করোনা মহামারির প্রাদুর্ভাব চলাকালে নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটিতেও গভর্নরকে অফিস করতে হয়েছে প্রতিনিয়ত। বাকি খাত সচল থাকায় বাংলাদেশ ব্যাংককেও কাজ করতে হয়েছে শুক্রবারেও। বর্তমানে এক লাখ তিন হাজার কোটি টাকার ঋণ ও প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের দায়িত্বও বাংলাদেশ ব্যাংকের। এ সময়ে গভর্নর পদ দীর্ঘ সময়ের জন্য শূন্য থাকলে ব্যাংক খাতের স্বাভাবিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

অপরদিকে জাতীয় পর্যায়ে নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাজেট প্রণয়নের মাধ্যমে দেশের অর্থ ব্যবস্থাকে পরিচালিত করে থাকে অর্থ মন্ত্রণালয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নর নিয়োগের ক্ষেত্রেও অর্থ মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা রয়েছে। এ জন্য মন্ত্রিসভার অন্য সদস্যদের তুলনায় অর্থমন্ত্রীর গুরুত্ব এক্ষেত্রে অনেক বেশি। অর্থমন্ত্রী দেশে না থাকলে করোনাকালে অনেক গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত গ্রহণ মন্ত্রীর অনুমোদনের প্রয়োজনে পিছিয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিশেষত ভিন্ন মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দকৃত অর্থ ছাড় নিয়ে কালক্ষেপণ হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চিকিৎসার প্রয়োজনে লন্ডনে গেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এক মাস তিনি দেশের বাইরে থাকবেন। তার অনুপস্থিতিতে করোনার দোহাই দিয়ে অনেক কর্মকর্তাই অফিসে গরহাজির থাকতে পারেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। অতীতেও তা-ই হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গুরুত্বপূর্ণ খাত দুটির অভিভাবক বলতে নেই এখন। স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে করোনাকালেও সম্মুখে থেকে অর্থনীতির সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছে এ দুটি বিভাগ। এখন বিশেষ কোনো পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হবে। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, সাময়িক সময়ের দায়িত্ব পালনকালে কেউ ঝুঁকি নিয়ে ফাইল অনুমোদন করবেন না। পরবর্তীকালে কোনো সময়ে এসব নিয়ে অপত্তি ওঠার সম্ভাবনা থেকে যায়। তখন ওই কর্মকর্তাকেই অভিযুক্ত করা হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত ১১ গভর্নর দায়িত্ব পালন করেছেন। সর্বপ্রথম ১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারি গভর্নর হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন এএন হামিদুল্লাহ। তার পর থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত ছয়জনই পূর্ববর্তী গভর্নরের মেয়াদ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্বে যোগ দেন। এ সময়ে গভর্নর পদ শূন্য ছিল না বাংলাদেশ ব্যাংকে।

তারা হচ্ছেন ১৯৭৪ সালের ১৯ নভেম্বর যোগ দেওয়া একেএন আহমেদ, ১৯৭৬ সালের ১৩ জুলাই যোগ দেওয়া এম নুরুল ইসলাম, ১৯৮৭ সালের ১২ এপ্রিল যোগ দেওয়া সেগুফতা বখত চৌধূরী, ১৯৯২ সালের ২০ ডিসেম্বর খোরশেদ আলম ও ১৯৯৬ সালের ২১ নভেম্বর লুৎফর রহমান সরকার।

এরপরই ছন্দপতন ঘটে। ১৯৯৮ সালের ২১ নভেম্বর লুৎফর রহমান গভর্নর পদ থেকে বিদায় নেন। এর তিন দিনের মাথায় ২৪ নভেম্বর গভর্নর হিসেবে যোগ দেন ড. মোহাম্মাদ ফরাসউদ্দিন। তার মেয়াদ শেষ হওয়ার চার দিন পরে ২০০১ সালের ২৯ নভেম্বর গভর্নর হন ড. ফখরুদ্দিন আহমেদ। তার মেয়াদ শেষ হওয়া মাত্রই ২০০৫ সালের ১ মে গভর্নর হন ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। ২০০৯ সালের ৩০ এপ্রিল সালেহউদ্দিনের মেয়াদ শেষ হলে ১ মে গভর্নর নিযুক্ত হন ড. আতিউর রহামান।

২০১৬ সালের ১৫ মার্চ ড. আতিউর পদতাগ করলে ২০ মার্চ গভর্নর হিসেবে যোগ দেন ফজলে কবির। এ তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ১১ গভর্নরের আটজনই যথাসময়ে নিয়োগ পেয়েছেন। বাকি তিনজনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব হয়েছে নানা কারণে।

এই দীর্ঘ সময়ে তিনবারে সর্বোচ্চ চার দিন গভর্নর শূন্য ছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। সাবেক গভর্নর লুৎফর রহমানের বিদায় ও ফরাস উদ্দিনের যোগদানের মধ্যে ব্যবধান ছিল দুই দিন। ফরাস উদ্দিন ও ফখরুদ্দীন আহমেদ এর মধ্যে ব্যবধান ছিল চার দিন। একই ব্যবধান ছিল ড. আতিউর রহমানের পদত্যাগ ও ফজলে কবিরের যোগদানে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০