আরফাতুর রহমান শাওন: কর্মব্যস্ত জীবনে অভিভাবকরা নিজ সন্তানের কতখানি খোঁজখবর রাখেন! সকালে সন্তানকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পৌঁছে দিয়ে অভিভাবকরা সারাদিন কাজের মধ্যে ডুবে থাকেন। শহুরে যান্ত্রিক জীবন আমাদের তা-ই শিখিয়েছে, যার ফলে অভিভাবকরা সন্তানদের প্রাত্যহিক জীবনের খোঁজখবর রাখার বেশি সময় পান না। পরিবারের মা-বাবা উভয়েই কর্মজীবী হলে তো কথাই নেই। আবার গৃহিণীরা গৃহস্থালি কাজের পর সন্তানকে দেখভাল করার মতো কতটুকুইবা সময় দিতে পারেন। তাই সন্তানকে নিয়ে অনেক উচ্চাকাক্সক্ষা থাকা সত্ত্বেও মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে অনেকেই হয়তো পারেন না। সন্তানের পেছনে প্রচুর অর্থ ব্যয় করেও অনেক অভিভাবকের স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়। অভিভাবকরা সন্তানের বিকাশের মূলে প্রবেশ না করে কেবল সন্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি করে তাকে প্রতিযোগী মানসিকতায় গড়ে তোলেন। অনেকেই সেই চাপ সহ্য করতে না পেরে হীনম্মন্যতায় ভোগে।
শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, নৈতিক, আবেগগত ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের জন্য সন্তানের উপযোগী একটি সুষ্ঠু, সুন্দর, নির্মল ও প্রাণবন্ত পরিবেশ দরকার, যে পরিবেশে সে অকপটে সামনে এগিয়ে যেতে শিখবে। এমন পরিবেশ সন্তানের সৃজনশীলতা বিকাশে সহায়ক ভূমিকা রাখে। আমাদের দেশের অনেক অভিভাবকই নিজ সন্তানের প্রতি বেশি যতœশীল নন। সন্তান কখন কোথায় যায়, কাদের সঙ্গে মেশে, কখন বাড়ি ফেরে, বাড়িতে কতক্ষণ কম্পিউটার, মোবাইল, ট্যাব ইত্যাদি নিয়ে সময় ব্যয় করে, ফেসবুকে কাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে, কত ঘণ্টা টিভির সামনে বসে, কী কী অনুষ্ঠান দেখে, লেখাপড়ার প্রতি কতটা আন্তরিক ও মনোযোগী, প্রাতিষ্ঠানিক পরীক্ষায় কেমন রেজাল্ট করছে, রেজাল্ট প্রত্যাশা অনুযায়ী হচ্ছে কি না, কোচিং সেন্টার বা গৃহশিক্ষকের কাছে পড়লে, সেই শিক্ষক সন্তানকে ঠিকমতো বোঝাতে পারছে কি না, সন্তান পড়ালেখার চাপ সামলাতে পারছে কি নাÑএসব বিষয় নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে। লেখাপড়ার বাইরেও যে তার একটা আলাদা জগৎ আছে, সেসব বিষয়ে খোঁজখবর রাখাও তার জন্য জরুরি। সংস্কৃতি তথা গান, ছবি আঁকা, নাচ, অভিনয়, আবৃত্তি প্রভৃতি সহপাঠ কার্যক্রমে সন্তানের আগ্রহ থাকলে তা বিকশিত করার সুযোগ অভিভাককেই তৈরি করে দিতে হবে। সন্তানকে উৎসাহিত করতে হবে। খেলাধুলার প্রতি আগ্রহ থাকলে তাকে সময় দিতে হবে। ভুল করলে তাকে শুধরিয়ে দিতে হবে। তবেই আপনার সন্তানের সুষ্ঠু বিকাশ হতে থাকবে। সন্তান বিপথগামী হলে হতাশা বা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত না হয়ে ধৈর্য ধরে সন্তানকে ভালো পথে ফিরিয়ে আনার সুদৃঢ় প্রচেষ্টা করতে হবে।
সন্তান কেবল পরিবারেই নয়, আত্মীয়স্বজন, সমাজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমনকি রাষ্ট্রের কাছেও মনের উপযোগী পরিবেশ আশা করে। তবে সন্তানের প্রারম্ভিক পরিবেশ পরিবার থেকেই দিতে হবে। পরিবারে বাবা-মা যদি সন্তানের সংবেদনশীল মনকে উপলব্ধি করে তাকে সুন্দর পথে এগিয়ে যাওয়ার দিকনির্দেশনা দিতে পারে, সন্তানের পছন্দ-অপছন্দ জানতে পারে, তাহলে সেই সন্তান অবশ্যই সোনার মানুষ হয়ে গড়ে উঠবে। ছোটদের মন কাদামাটির মতো নরম। শিশুসন্তানকে আপনি যেভাবে গড়তে চান, সন্তানও ঠিক সেভাবেই গড়ে উঠবে। সন্তানের ওপর কোনো কারণেই হঠাৎ চটে যাওয়া ঠিক নয়। শিশু ভুল বা অন্যায় করলে রেগে না গিয়ে শান্ত মেজাজে তাকে ভুলটি বোঝাতে হবে।
আজকের শিশু দেশ, জাতি ও সামাজের আগামী দিনের কর্ণধার। সন্তানের সেই সুন্দরতম ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে আমরা অভিভাবকরা কতখানি আন্তরিক, যত্নবান ও দায়িত্বশীল? কেবল অর্থ ব্যয়ের মাধ্যমেই সন্তানের সুষ্ঠু বিকাশ সম্ভব নয়। অর্থের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। কিন্তু অর্থ ব্যয়ের পাশাপাশি সন্তানকে পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে। ব্যস্ততার কারণে বাবা তা না পারলে মাকে বা উভয়ই কর্মজীবী হলে দুজনকেই সময় ভাগ করে সন্তানকে সময় দিতে হবে। অভিভাবকের সুশিক্ষা ও সচেতনতা সন্তানের জন্যে কলাণকর। কারণ একজন শিক্ষিত মা চটজলদি শিশুর সমস্যা বুঝে উঠতে পারে। শিক্ষিত মায়ের সন্তানদের বিকাশটাও দ্রুত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই বলে নিরক্ষর মায়ের সন্তানদের সুষ্ঠু বিকাশ হয় না, তা কিন্তু নয়। আমাদের দেশে অসংখ্য নিরক্ষর মায়ের সন্তান আছে, যারা দেশের সেরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজসহ শীর্ষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ন করছে।
মানবশিশুর মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের ভিত্তিমূল তৈরি হয় শৈশবকাল থেকেই। একজন নবজাতক শিশুর প্রতি জন্মের প্রারম্ভ থেকেই যত্নবান হতে হয়। সন্তানের বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তার মৌলিক চাহিদা ও অধিকারের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। সন্তান যে পরিবেশে জন্মগ্রহণ করেছে, সেই পরিবেশ ও প্রতিবেশ সার্বিকভাবে তার বসবাসের সহায়ক কি না, সেদিকে সুদৃষ্টি রাখতে হবে। সন্তানের সুষ্ঠু শারীরিক বিকাশের ক্ষেত্রে তার স্বাস্থ্য, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও পরিবেশের প্রতি অভিভাবকদের মনোযোগী হতে হবে।
আপনার সন্তানের সামগ্রিক বিকাশ ও সামাজিক অবস্থান যথাযথ হচ্ছে কি না, তা আপনাকেই নির্ণয় করতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি সন্তানকে নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের শিক্ষাও দিতে হবে। সন্তানকে শিষ্টাচার শিক্ষা এমনভাবে দিতে হবে, যেন সে তার শিক্ষক ও গুরুজনদের সম্মান ও শ্রদ্ধা করতে শেখে। সন্তানের ধর্মীয় মূল্যবোধের বিকাশের দিকে সতর্ক ও সচেতন দৃষ্টি রাখতে হবে। ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করতে গিয়ে সন্তান যেন গোঁড়া বা সাম্প্রদায়িক না হয়, সেই শিক্ষা শৈশবকাল থেকেই দিতে হবে। কেননা আজকাল অনেক বিত্তশালী পরিবারের শিক্ষিত সন্তানরা ভুল পথে পা বাড়িয়ে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ছে, যার বাস্তব প্রমাণ এরই মধ্যে দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছে। যারা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মধ্যে ধর্মীয় গোঁড়ামির বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে, তারা আদৌ ধর্ম সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান রাখেন কি না, তা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ রয়েছে।
সন্তানের সুস্থ ও সবলভাবে বেঁচে থাকার জন্য সুষম খাদ্য অপরিহার্য। কিন্তু আমাদের মতো দারিদ্র্যপীড়িত দেশে সিংহভাগ শিশুরই সুষম খাদ্য চাহিদা মেটাতে পারে না পরিবারগুলো। ফলে ক্যালরিসম্পন্ন খাদ্য না খেয়ে শিশুরা জীবনের বিভিন্ন সময় রোগাক্রান্ত হয় এবং রোগ প্রতিরোধক শক্তি কমে যায়, যা তাদের সামগ্রিক বিকাশের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
বিনোদন আপনার শিশুসন্তানের বিকাশে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি মাধ্যম। বিনোদন শিশুর মানসিক অবস্থাকে আনন্দময়, গতিশীল ও প্রাণবন্ত করে তোলে। যদিও আমাদের শহরে পর্যাপ্ত বিনোদনের সুবিধা নেই, তথাপি এর মধ্যেই যতখানি সম্ভব শিশুদের বিনোদনের সুযোগ করে দিতে হবে। কেননা এই বিনোদনের মাধ্যমেই আপনার সন্তান অবারিতভাবে মেলামেশার সুযোগ পায়। তা থেকে তার মধ্যে এগিয়ে যাওয়ার মনোভাব গড়ে ওঠে। পাশাপাশি সে বেড়ে ওঠা ও বড় হওয়ার মানসিক প্রেরণা পায়।
বর্তমান প্রযুক্তির যুগে মানুষ যেমন খুব সহজেই অনেক শিখতে, জানতে ও বুঝতে পারছে, তেমনি আমাদের সন্তানরা কম্পিউটার, ট্যাব বা স্মার্টফোনে নিয়ন্ত্রণহীন গেমস খেলে প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ায় বিমুখ হয়ে পড়ছে। তাছাড়া ইন্টারনেটে আপত্তিকর ও অশালীন ছবি দেখে সন্তানের মধ্যে এক ধরনের অনৈতিক প্রবণতা গড়ে উঠতে পারে। সন্তান বেড়ে ওঠার পাশাপাশি তার মধ্যে এক ধরনের আবেগ তৈরি হয়। সামাজিক, পারিপার্শ্বিক, পারিবারিক ও প্রাকৃতিক বিভিন্ন ঘটনা থেকে শিশুর মনে যে আবেগ সঞ্চিত হয়, তা স্বাভাবিক মাত্রায় ধরে রাখতে পারলে শিশুর জীবনে সফলতা অনিবার্য। একটা নিয়ন্ত্রিত আবেগ শিশুর জীবন গঠনে যথার্থ ভূমিকা পালন করে।
সন্তানের বলিষ্ঠ বিকাশ হলে সন্তান পরিবার-সমাজ তথা রাষ্ট্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। সন্তানের মনোযোগ বাড়ানোর জন্য সন্তানের প্রতি নজর দিতে হবে। কৌশলে তাকে উৎসাহিত করতে হবে। আপনার সন্তান যদি কোনো কিছু দেখার সময়, পড়ার সময় ও শোনার সময় দৃঢ় মনোযোগী হতে পারে, তাহলে অবশ্যই তার মেধার বিকাশ যথার্থ হবে।
সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে বাবা-মায়ের আকাক্সক্ষা হতে হবে বাস্তবধর্মী। সন্তানের বিকাশ সিংহভাগ নির্ভর করে মা-বাবার ভালোবাসা, আদর-যত্ন, প্রেরণা ও দেখভালের ওপর। তাছাড়া পারিবারিক পরিবেশ শান্তিপূর্ণ ও আনন্দময় হতে হবে। সন্তানের সামনে কথাবার্তায় কখনোই অশিষ্ট হওয়া যাবে না। সুশৃঙ্খল ও নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ থেকে সে নিয়মানুবর্তী হয়ে গড়ে উঠবে।
শিক্ষক ও মুক্ত লেখক
বংশাল, ঢাকা