অনাথ শিশুর মতো যার জীবনখানি নিস্তরঙ্গে নিথর হতে পারতো নিযুত জীবনের নিঠুর নিয়তিপাশে তিনি জুগিয়েছেন হৃৎস্পন্দনের খোরাক। দেশের জন্য লড়েছেন। শূন্য জমিনে গড়েছেন ব্যবসায় কাঠামো। জীবনের সব অর্জন লিখে দিয়েছেন মানুষের নামে। তিনিই দেশের সবচেয়ে সফল ট্রাস্টি প্রতিষ্ঠান ‘কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট’-এর জনক রণদা প্রসাদ সাহা। নারীশিক্ষা ও চিকিৎসায় নারী-পুরুষ কিংবা ধনী-গরিবের ভেদ ভেঙেছেন। তার জীবনেই রয়েছে সসীমকে ডিঙিয়ে অসীমে শক্তি সঞ্চারের কথামালা। এ জীবন ও কেতন যেন রোমাঞ্চিত হৃদয়েরই উদ্দীপ্ত প্রেরণা। পর্ব-১৪……
মিজানুর রহমান শেলী: এ শতকের প্রথম দিকে কিছু ইউরোপীয় এজেন্সির মাধ্যমে কলকাতায় ব্যবসায় কাঠামোর উন্নয়ন সাধিত হয়। যেখানে ভারতীয় অংশগ্রহণ ছিল। তারপরে ধীরে ধীরে সাদা আর কালোদের মধ্যে একটি ব্যবসায়িক ফারাক তৈরি হলো। ‘মোডাস ওপেরেন্ডি’ নামের এজেন্সি হাউজের নাম আর. এম. মার্টিনের ১৮৩২ সালের লেখনীতে পাওয়া যায়। তিনি উল্লেখ করেন, এটা অনেক বড় একটি মার্কেন্টাইল হাউজ। কলকাতায় প্রতিষ্ঠা হলো। লন্ডনে এর একটি শাখা ছিল। কোম্পানির অবসরপ্রাপ্ত একজন সিভিল সার্ভেন্ট, একজন মিলিটারিম্যান, একজন ডক্টর ও একজন লন্ডনি বণিকের অংশীদারত্বে এ এজেন্সি গড়ে ওঠে। এখানে নিজস্ব লগ্নি ছিল না। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চাকর-বাকরদের টাকায় গড়ে তোলা ব্যাংকের অর্থ দিয়ে তারা ব্যবসা চালিয়েছে। প্রথমে জাহাজ বানিয়েছে। তারপর ভারত সাগরে বাণিজ্য করেছে। তারপর ইন্স্যুরেন্স ব্যাংক কোম্পানি গড়ে তোলে। কলকাতায় তারা নীল, রেশম সংশ্লিষ্ট বড় বড় শিল্প-কারখানা গড়ে তোলে। এ এজেন্সি তিনটি কালপর্বে ব্যবসা চালিয়েছে। ১৮৪৭-এর পরে দ্বিতীয় পর্যায়ে, তারা অর্থ সংকটে পড়ে। তখন বাঙালিরা এ এজেন্সিতে ব্যবসায় অংশীদার হওয়ার সুযোগ গ্রহণ করে।
এজেন্সির সঙ্গে বিভিন্ন ব্রোকারের (যেসব বাঙালি এজেন্সির সঙ্গে দালালি কাজ শুরু করেন) ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ব্রোকারদের বেনিয়া বলে ডাকা হতো। পালমার অ্যান্ড কো.-এর বাঙালি বেনিয়া ছিলেন রঘুরাম গসাই, একজন ধনাঢ্য বণিক। মতিলাল ছিলেন জাহাজের মালিক ও বিজনেস ম্যাগনেট। উনিশ শতকের প্রথম ভাগের বানিয়া রামদুলাল দে ছিলেন এদের পথপ্রদর্শক। এ বেনিয়ারা ছিলেন ইংরেজি জানা ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ও বণিক শ্রেণির হিন্দু।
দ্বারকানাথ ঠাকুর ছিলেন উনিশ শতকের মধ্যভাগের একজন উদ্যোক্তা। তার নিজস্ব উদ্যোক্তা কৌশল ছিল পরবর্তী বাঙালিদের জন্য পথনির্দেশনা। পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত ঠাকুর ১৮৩০ ও ১৮৪০’র দশকে কলকাতার সিভিক লিডারের স্বীকৃতি পান। তিনি তার ব্যবসায় রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থানকে কাজে লাগান। তিনি মূলত একটি পশ্চিমা ধাঁচের শিল্পোন্নত ভারতের স্বপ্ন দেখেছিলেন। তার ‘কার, ট্যাগর অ্যান্ড কোং’ই ছিল প্রথম ভারতীয় ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান, যেখানে ইউরোপীয় এবং বাঙালির সমান সমান অংশীদারত্ব ছিল। এ প্রতিষ্ঠানের ছিল জমিদারি, কারবারিসহ আমদানি-রফতানি বাণিজ্য, নীল ও রেশম প্রস্তুত, চিনি পরিশোধন, সামুদ্রিক নৌযান, ডকিং ও খবরের কাগজের ব্যবসা। ১৮৩৪ সালে কলকাতা চেম্বার অব কমার্সের প্রতিষ্ঠাকালেই এর সদস্য হন দ্বারকানাথ ঠাকুর।
এ সময় সমাজসংস্কারকরা ইউরোপ ও আমেরিকার সঙ্গে বাঙালিদের প্রতিযোগিতার আহবান জানান। কেবল সাহিত্যে নয়, বরং শিল্প, বিজ্ঞান ও বাণিজ্যে তারা এগিয়ে চলার যোগ্য। উদ্যোগ গ্রহণের জন্য তারা যথেষ্ট আলো পেয়ে গেছে। এ মর্মে ‘জ্ঞানান্বেষণ’ পত্রিকা থেকে নিয়মিত আহবান জানানো হচ্ছিল, বাঙালিরা তাদের সমৃদ্ধির শত্রুদের সামনে ব্যবসা, বাণিজ্য ও শিল্পায়নের অস্ত্র তুলে নেবে।
এ উত্তাল সময়ে দ্বারকানাথের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানটাই হয়ে গেল নজির। আর দ্বারকানাথ হলেন বাঙালির কাছে অনুসরণীয় পুরুষ। তিনি কিনলেন সর্বোচ্চ লগ্নির ৭০ হাজার রুপির কয়লাখনি। পরের বছর কোল ইউটিলাইজিং এন্টারপ্রাইজ প্রতিষ্ঠা করেন। তারপর যৌথ পুঁজির ছয়টি কোম্পানি খুললেন: দ্য ক্যালকাটা স্টিম টাগ অ্যাসোসিয়েশন, দ্য বেঙ্গল সল্ট কম্পানি, দ্য ক্যালকাটা স্টিম ফেরি ব্রিজ কম্পানি, দ্য বেঙ্গল টি অ্যাসোসিয়েশন, দ্য বেঙ্গল কোল কোম্পানি ও ইন্ডিয়ান জেনারেল স্টিম নেভিগেশন কোম্পানি। তিনি তার শেষ জীবনে গ্রেট ওয়েস্টার্ন অব বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানিতেও যোগ দিয়েছিলেন।
এ বাবু সংস্কৃতির পাশাপাশি ছিল ভদ্রলোক সংস্কৃতি। ভদ্রলোকেরাই আজকের সমাজের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত গোষ্ঠী। এ শ্রেণি ব্রিটিশ আমল থেকেই ব্রিটিশের কেরানি হতে অহংকার বোধ করে। কিন্তু কোনো ব্যবসায় উদ্যোগে তাদের মন ছিল না। ব্রাহ্ম ও কায়স্থরা নিজেদের উচ্চবর্ণের মর্যাদা বিচারে বাণিজ্যের মতো নিম্নবর্ণের কাজে উন্নাসিকতা প্রকাশ করত। ফলে বাংলার এ উচ্চবিত্ত সমাজ কলকাতার ব্যবসায় উদ্যোগে উনিশ শতকের শুরুর কাল থেকেই পিছিয়ে পড়ল।
এ দ্বাদ্বিক দশা থেকে বাঙালির উত্তরণ ঘটতে শুরু করে ১৮৭০’র দশকের পরে। এটাকে স্বদেশি এন্টারপ্রাইজের সময়কাল বলা হয়। এ ধারণা বাংলার আর্থিক খাতে নতুন জোয়ার এনেছিল। হস্তশিল্প আবার জেগে উঠল। আধুনিক শিল্প-কারখানা গড়ে উঠল। নতুন নতুন প্রযুক্তি শিক্ষাঙ্গনে প্রতিষ্ঠা পেল। কিন্তু এ পরিবর্তনের ধামাকা খুব বেশি সুবিধা করে উঠতে পারছিল না। কেননা এর সঙ্গে রাষ্ট্রীয় প্রণোদনা ছিল না। নিজস্ব বিচারবুদ্ধি আর নৈতিক দায়বদ্ধতা নিয়েই স্বদেশিরা এগিয়ে চলছিলেন। উপনিবেশবাদীরা কেবলই কামিয়াবি স্বার্থ নিয়ে মত্ত ছিল। ভারত থেকে সম্পদ আহরণ ও ব্রিটেনকে সমৃদ্ধ করার সাম্রাজ্যবাদী কর্মযজ্ঞ তারা চালাতে থাকে ওরিয়েন্টালিজম, এভানগালিজম বা লিবারেলিজমের ঘোমটা পরে। তারা কেবল পছন্দের কিছু খাতে শিল্প বাণিজ্যকে উৎসাহ দিত। ফলে উনিশ শতকের এ স্বদেশি শিল্প-বাণিজ্য লেসে-ফেয়ার বা অবাধনীতির সুবিধা ভোগ করেছিল, তা বলা চলে না। কার্যত বাঙালির ব্রিটিশ ও মাড়োয়ারি উভয়ের সঙ্গেই সমঝোতা ও প্রতিযোগিতা করে ব্যবসা চালিয়ে যেতে হয়েছে। বিশেষ করে মধ্য ও নি¤œ পুঁজিপতি বাঙালিরা কোনোরূপ সহযোগিতা পাননি। তারা ব্রোকারও ছিল না, না ছিল বিদেশি পুঁজির মধ্যস্বত্বভোগী। নিজের পায়েই তাদের দাঁড়াতে হয়েছে। পুঁজি, ব্যবস্থাপনা ও বাজারজাতকরণের প্রশ্নে তারা ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ, তবে আধুনিক প্রযুক্তির সংকট তাদের পোহাতে হয়েছে।
স্বদেশিদের এ জাগরণের পেছনে ছিলেন নবগোপাল মিত্র। তিনি ১৮৬৭ সাল থেকে ৪০ বছর অবধি নিয়মিত দেশি পণ্যের ‘হিন্দু মেলা’ আয়োজন করেছেন। রাজনীতিক রাজনারায়ণ বোসের প্রেরণায় তিনি এ আয়োজন করতেন। উদ্দেশ্য ছিল দেশি কাপড়ের চল বাড়ানো, আর বিদেশি কাপড় বর্জন করা। এক্ষেত্রে ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ নামের একটি সাময়িকী প্রকশনার কাজে সহায়তা করে। এ ধারাবাহিকতায় উনিশ শতকের শেষে কিছু বাঙালি ব্যবসায় উদ্যোগে নেমে আসে। তাদের মধ্যে হেমেন্দ্র মোহন বোস, কিশোরী মোহন বাগচি উল্লেখযোগ্য।
হেমেন্দ্র মোহন বসু বা এইচ. বোসই ছিলেন ভারতের প্রথম সফল সুগন্ধী ব্যবসায়ী। তার চুলে মাখা তেল ‘কুন্তালীন’, সুগন্ধী ‘দিলখোশ’, হরেক রকমের ফলের সিরাপ, ‘তাম্বুলিন’ এবং চুল ধোয়ার বিভিন্ন প্রসাধনী বিশাল বাজার দখল করতে সক্ষম হয়। এমনকি ভোগ্যপণ্য প্রচারণায় বোসই প্রথম ভারতীয়, যিনি বিজ্ঞাপন ধারণা নিয়ে আসেন। আর পি. সি. ঘোষ নামের এক নারী শিল্পীকে তিনি প্রথম বিজ্ঞাপনশিল্পী হিসেবে পরিচয় করিয়েছেন ভারতের বুকে।
সেকালের আরেক বাঙালি উদ্যোক্তা ছিলেন কিশোরীমোহন বাগচি। ১৮৮৩ সালে উত্তর কলকাতার এক ভাড়া দোকানে তিনি ‘পি. এম. বাগচি অ্যান্ড কোং’ প্রতিষ্ঠা করেন। এ কোম্পানি হরেক রকমের ঝরনা কলমের কালি, তার বোতল, ডাই ও পট প্রস্তুত করত।
উনিশ শতকের শেষ চতুর্থাংশে কলকাতায় অনেক গ্যাস কোম্পানি গড়ে ওঠে। বেঙ্গল গ্যাস ওয়ার্কস, ক্যালকাটা গ্যাস ওয়ার্কস ও দি ইন্ডিয়ান গ্যাস ওয়ার্কস লি. প্রভৃতি। এছাড়া রাবার, সুগন্ধী, বই ও বিজ্ঞাপন প্রিন্টিংয়ের মতো বিভিন্ন কারিগরি শিল্প উত্তর কলকাতায় গড়ে উঠতে থাকে।
স্বদেশি চেতনা থেকেই কলকাতায় বাঙালিরা জোটবদ্ধ হয়ে নিজস্ব শিল্পকাঠামো গড়ে তোলে। ফলে কলকাতার শিক্ষিত যুবাদের নতুন নতুন কর্মসংস্থান হয়। স্বদেশি চেতনায় গড়ে ওঠা কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে তারা শিক্ষা লাভ করে। একই সঙ্গে গ্রাম থেকে আসা অশিক্ষিত শ্রমিক শ্রেণিরও কর্মসংস্থান হয়।
এর চ‚ড়ান্ত পর্বই হলো বিশ শতকের শুরুর সময়। তখন অনেকেই পূর্ব বাংলা থেকে কলকাতা গিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করেন। তখনও অবশ্য অসংগঠিত বা প্রান্তিক মানুষের ব্যবসায় কাঠামো গড়ে তোলার চল শুরু হয়নি। বিশ শতকের প্রথম চতুর্থাংশ অতিক্রম করার পরে শ্রমিক শ্রেণির যুবকেরা ধীরে ধীরে পুঁজি গঠন করে নেন। তারপর অনেকেই ব্যবসায় কাঠামো গড়ে তোলেন। তাদের মধ্যে গুটি কতক সফল উদ্যোক্তা হতে পেরেছেন। রণদা প্রসাদ সাহা তাদের মধ্যে সুনামে পরিচিত ব্যবসায় উদ্যোক্তা।
প্রান্তিক গোষ্ঠীর মানুষ হয়েও সফল ব্যবসায় উদ্যোগ গড়ে তোলা উদ্যোক্তাদের নাম এলে আকিজ গ্রæপের মালিক সেখ আকিজ উদ্দিনের নাম চলে আসে। কেননা তার উঠে আসার গল্প রণদার মতোই কঠিন মনোবল, পরিশ্রম আর সততার ভেতর দিয়ে। সেখ আকিজ উদ্দিন কলকাতা গিয়েছিলেন রেলপথে। বেজেরডাঙ্গার তার গ্রামের বাড়ি থেকে পশ্চিমে যে পাড়াপথটি আগান-বাগানের ভেতর দিয়ে ফসলি মাঠের দিকে এগিয়ে গেছে, সেই মাঠখানি পাড়ি দিলেই রেলপথ। রেলপথ ধরে সোজা উত্তরে এক নিঃশ্বাস হাঁটলেই পৌঁছে যাওয়া যায় বেজেরডাঙ্গা রেলস্টেশন। এ রেলস্টেশনেই সেখ আকিজের শৈশব কেটেছে বাদাম, চানাচুর, লজেন্স বিক্রি করে। এমনকি শিশু আকিজ ফেরি করতে করতে মাঝেমধ্যেই রেলে চড়ে কলকাতা চলে যেতেন। ১৭ টাকা নিয়ে এক সন্ধ্যায় তিনি কলকাতার উদ্দেশে ঘর ত্যাগ করেন। এ অজানার উদ্দেশে পাড়ি জমানোটা ছিল তার বয়সের এক বালকের জন্য দুঃসাহসিক অভিযাত্রা বটে।
এমন অজানার উদ্দেশে সে সময় পূর্ব বাংলা থেকে যুবারা ভাগ্য অনুসন্ধানে কলকাতা অভিযানে বেরিয়েছেন। স্বপ্নের আবাদ করেছেন। গড়ে তুলেছেন ব্যবসায় উদ্যোগ। তার ওপরই দাঁড়িয়ে রয়েছে এ অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্য।
গবেষক, শেয়ার বিজ
mshelleyjuÑgmail.com
Add Comment